দক্ষ শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রী গড়ে তোলার সময় এখনই

প্রকাশ | ১৫ জুলাই ২০১৯, ১২:৩৭

তানিয়া আক্তার, ঢাকাটাইমস

উচ্চশিক্ষাতেও পাঠ্যক্রম শিক্ষার্থীদের প্রয়োজন এবং যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তৈরি করা যায়নি বলে মনে করেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রাইমএশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আবদুল হান্নান চৌধুরী। তার মতে, যোগ্য শিক্ষকের অভাব, গবেষণার অপ্রতুলতা, শিক্ষাখাতে অপর্যাপ্ত বিনিয়োগ ও ফলাফলকেন্দ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থার উন্মাদনায় শিক্ষার কাঙিক্ষত লক্ষ্য পূরণ হচ্ছে না। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা, শিক্ষার মান ও উচ্চশিক্ষার সংকট এবং সম্ভাবনা নিয়ে এই শিক্ষাবিদ কথা বলেছেন দৈনিক ঢাকা টাইমসের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তানিয়া আক্তার।

উচ্চশিক্ষায় সাধারণত কোন ধরনের শিক্ষার্থী পেয়ে থাকেন?

উচ্চশিক্ষা দানে শ্রেণিভেদে উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নি¤œমধ্যবিত্ত, নি¤œবিত্ত এমনকি সুবিধাবঞ্চিত এবং অবস্থানভেদে গ্রাম, শহর ও  দেশের একেবারে প্রান্তিক এলাকা থেকেও শিক্ষার্থী আমাদের মতো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পেয়ে থাকি। প্রতিষ্ঠানভেদে ভোকেশনাল, টেকনিক্যাল এবং ডিপ্লোমাসহ সব মাধ্যমের শিক্ষার্থীরাই উচ্চশিক্ষা নিতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসে। এ ছাড়া শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষেত্রে  প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকেই কেউ বাংলা, কেউ ইংরেজি, আবার কেউ বাংলা-ইংরেজি মিশ্রমাধ্যম এবং মাদ্রাসা থেকে উচ্চশিক্ষা নিতে আসা খুব মেধাবী বা মধ্যমমানের শিক্ষার্থীদের আমাদের পরবর্তী জীবনের জন্য প্রস্তুত করতে হয়। গুণগত কিংবা ফলাফলের দিক বিবেচনা করলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে অত্যন্ত মেধাবী, মধ্যম এবং নি¤œমধ্যম ফলাফল করা ছাত্রছাত্রীদের ভর্তি করে থাকি। যে মানের ছাত্র-ছাত্রীকেই ভর্তি করে থাকি না কেন আমাদের লক্ষ্য হলো তাদের আধুনিক জ্ঞান দিয়ে প্রকৃত মানুষ হিসেবে তৈরি করা। সব শিক্ষার্থীদেরই জীবনে সফল হবার স্বপ্ন রয়েছে এবং সেই স্বপ্নপূরণের সুযোগটাই কিন্তু আমরা দিয়ে থাকি।

মিশ্রমাধ্যমের শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা দানে চ্যালেঞ্জগুলো কেমন?

দেশের অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই মিশ্রমাধ্যমের শিক্ষার্থীরা ভর্তি হয়ে থাকে। তাদের মধ্যে যারা প্রাইমএশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়, আমাদের প্রায় দুই শতাধিক শিক্ষক তাদের পরিচর্যা করেন। কিন্তু বাস্তবতা বিবেচনা করলে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষাদানে উপযোগী দক্ষ শিক্ষকের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। চেষ্টা করছি ভালো শিকক্ষকদের দ্বারা শিক্ষা কার্যক্রম চালাতে। প্রতিনিয়ত আমরা সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, আলোচনা সভা কিংবা কনফারেন্স আয়োজন করে থাকি। বিষয়ভিত্তিক ক্যারিয়ার নিয়ে বিভিন্ন কোম্পানির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বা অভিজ্ঞদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সমন্বয় করে দিচ্ছি যাতে তারা কর্মজীবনে উপকৃত হয় এবং এতে শিক্ষার্থীরা প্রতিনিয়ত উপকৃত হচ্ছে।

উন্নত বিশ্বের সঙ্গে এদেশের শিক্ষাব্যবস্থার মূল পার্থক্য কী?

উন্নত দেশে একজন শিক্ষার্থী ছোটবেলা থেকে যেকোনো বিষয়ে নিজস্ব মতামত জানানোর সুযোগ পায় এবং শিক্ষাব্যবস্থা কিংবা সমাজ তা সাদরে গ্রহণ করে। কিন্তু আমাদের দেশে উচ্চশিক্ষা নিতে আসা অনেক শিক্ষার্থীই এই গুণগুলি থেকে প্রকৃত অর্থেই অনেক দূরে রয়েছে। আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা এখনো পুঁথিগত শিক্ষার মধ্যেই আটকে আছে। জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত কোনো জ্ঞান না দেওয়াটাই এই ব্যর্থতার বড় কারণ। মেধার উৎকর্ষতার বৃদ্ধি কিংবা ব্যক্তির লব্ধ জ্ঞানের প্রায়োগিক ব্যবহারের সুযোগ আমাদের কর্মক্ষেত্র যেমনি দিতে চায় না, তেমনি এদেশের ফলাফলকেন্দ্রিক উন্মাদনায় শিক্ষার প্রকৃত অর্থটাই অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হারিয়ে ফেলেছে যা উন্নত বিশ্বে নেই বললেই চলে।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে প্রাইমএশিয়ায় উচ্চশিক্ষা ফলপ্রসূ হওয়ার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতাগুলো কী?

প্রাইমএশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে ৭ থেকে ৮ হাজার শিক্ষার্থীর ধারণক্ষমতা রয়েছে। বর্তমানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে যা আমাদের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে স্বল্প। শিক্ষার উন্নয়ন খাতে বিনিয়োগের জায়গায় উন্নয়ন বাজেটের স্বল্প বরাদ্দের কারণে আমরা অনেকের চেয়ে কিছুটা পিছিয়ে আছি। তবে আমাদের টিউশন ফিও তুলনামূলকভাবে কম। ফলে বিষয়ভিত্তিক আধুনিক জ্ঞান দেওয়ার জন্য যেসব সুযোগ-সুবিধা দরকার যেমন শিক্ষক, গবেষণাগার, অবকাঠামো, বিজ্ঞানাগার, আধুনিক বই পুস্তক এবং সরঞ্জামাদির যোগান দিতে বেগ পেতে হয়। এসব ক্ষেত্রে বিভিন্ন সময় আমাদের কিছুটা কৃচ্ছ্রতা সাধন করতে হয়। যার ফলে সঠিক সময়ে সঠিক ও প্রায়োগিক শিক্ষা দেওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না।

ব্যয়বহুল হলেও মধ্যবিত্ত বা নি¤œমধ্যবিত্তের সন্তানেরা কেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসছেন বলে মনে করেন?

প্রথমত, বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পর্যাপ্ত আসন সংখ্যা নেই। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক ক্ষেত্রেই নিজের পছন্দমতো বিষয়ে পড়ার সুযোগ পাওয়া যায় না। ফলে অনেকেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে আসে। এ ছাড়া সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস রাজনীতিসহ নানান কারণে ক্লাস বন্ধ থাকার কারণেও শিক্ষার্থীরা বর্তমানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার প্রতি আগ্রহী হচ্ছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশনজট নেই বললেই চলে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণত অল্প শিক্ষার্থী নিয়ে ক্লাস করানো হয় ফলে শিক্ষকেরা সব শিক্ষার্থীদের পরিমিত পরিচর্যা করতে পারেন। শিক্ষার মাধ্যম, শিক্ষা প্রদানের পদ্ধতি, ছাত্র-শিক্ষকের তুলনামূলক হার কম হওয়ায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া এখন ছাত্র-ছাত্রী তথা তাদের পরিবারের কাছে অধিক গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে। এ ছাড়া বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তুলনামূলকভাবে অনেক অবদান রাখছে যা এখন সর্বজন গৃহীত।

উপাচার্য হিসেবে কোন বিষয়গুলোর প্রতি গুরুত্ব দিচ্ছেন?

উপাচার্য হিসেবে একটি বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দিতে চাই। সেটা হলো নিম্নবিত্ত, সুবিধাবঞ্চিত, দেশের প্রান্তিক জায়গা এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী থেকে যেসব শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারছে না অথচ মেধাবী এমন কোনো শিক্ষার্থী যদি আমার কাছে আসে তাহলে তার অবস্থা অনুযায়ী অন্তত একটা ব্যবস্থা হলেও আমি করব। যাতে করে সে উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত না হয়। এই বঞ্চিত শিক্ষার্থীদের যদি কোনভাবে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলা যায় তাহলে তারাই এক দিন দেশের সম্পদ হয়ে উঠবে। ইতোমধ্যে এ ধরনের উদাহরণও আমাদের সকলের চোখের সামনে রয়েছে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগে সামাজিকভাবে বঞ্চিত শিক্ষার্থী রয়েছে যাদেরকে নিয়ে আমরা গর্বিত। তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ দেওয়ার পর তারা এখন দেশের সফলদের একজন।

শিক্ষার্থীর দক্ষতা বাড়ানোর জন্য  নতুন আরও কোন ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন?

প্রাইমএশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অচিরেই সেন্টার ফর মডার্ন ল্যাঙ্গুয়েজ করার পরিকল্পনা রয়েছে। ইতোমধ্যে মধ্যে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং চীনের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে কথা বলেছি তারা এসব দেশের ভাষা শেখানোর জন্য যে সহায়তা লাগবে তা আমাদের দিবে। এর ফলে আমাদের শিক্ষার্থীরা যেমন বিদেশি ভাষা শিখতে পারবে পাশাপশি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের শিক্ষার্থীদেরাও এতে অংশগ্রহণ করতে পারবে। এ ভাষাগুলো শিখতে পারলে চাকরির বাজারে আমাদের শিক্ষার্থীরা প্রচুর এগিয়ে থাকবে। এ ছাড়াও ছাত্রদের দক্ষতা বাড়ানোর জন্য প্রাইমএশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিনিয়ত নানান ধরণের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে যাচ্ছি। একটি ছাত্রকে শুধু বাংলাদেশের জন্যই প্রস্তুত হতে হবে তাতে বিশ্বাস না করে- তাকে বৈশ্বিক বাজারের জন্য প্রস্তুত করতে হবে এই লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছি।

এই যাত্রাপথে প্রাইমএশিয়ার অগ্রগতি কেমন?

প্রাইমএশিয়া বিশ্ববিদ্যালয় বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে অনেক পরে এসেও অগ্রগতিতে উল্লেখযোগ্যভাবে এগিয়ে রয়েছে। এখানে বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক যেমন, ইলেকট্রিক ও ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং, মাইক্রোবায়োলজি, টেক্সটাইল, আইন, পাবলিক হেল্থ নিউট্রিশন, ফার্মেসী, আর্কিটেকচার, কম্পিউটার সায়েন্স এ্যন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, বিবিএ, এমবিএ, ইন্টারন্যাশনাল ট্যূরিজম এ্যন্ড হসপিটালিটি মেনেজম্যান্ট, বায়োক্যামিস্ট্রিসহ আরও অনেক বিষয়ে শিক্ষাদান করছি যেগুলোর মধ্যে অধিকাংশরই শুধু ব্যাচেলর প্রোগ্রাম আছে আবার কোন কোনটার মাস্টার্স প্রোগ্রামও আছে।

সব মিলিয়ে সামগ্রিকভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছি যে একটা আধুনিক ও বিশ্বমানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার। যে প্রতিষ্ঠানটি আগামী প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের দিয়ে কর্পোরেট, বিজনেস এবং শিল্প ক্ষেত্রসহ সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন খাতে অবদান রাখবে। ইতোমধ্যেই এ বিশ্বদ্যিালয়ের শিক্ষার্থীরা যুক্তরাজ্যের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়, গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়সহ যুক্তরাষ্ট্রের স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করছে। টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রী চীন ও দক্ষিন কোরিয়ায় পড়তে গিয়েছে। এ ছাড়া সরকারের বিভিন্ন বিভাগে বিসিএস ক্যাডারে আমাদের শিক্ষার্থীরা চাকরি করছে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাত হাজার গ্রাজুয়েটদের সবাই বিভিন্ন জায়গায় সাফল্যের সাথে চাকরি করছে এবং বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য বিশেষ ভূমিকা রাখছে। সামগ্রিকভাবে বলতে পারি যে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় মানব সম্পদকে উন্নতকরণে যেভাবে কাজ করে যাচ্ছে আমরাও কোন অংশে তাদের চেয়ে কম অবদান রাখছিনা।

প্রাইমএশিয়ার নিজস্ব ক্যাম্পাসের কাজ কতদূর এগুলো?

রাজধানীর বসুন্ধরা এলাকায় ঢাকা-পূর্বাচল তিন’শ ফিট রাস্তার পাশে প্রায় নব্বই কোটি টাকা ব্যয়ে সুন্দর একটা জায়গায় প্রাইমএশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাসের জমি ক্রয় করা হয়েছে। বর্তমান বোর্ড অব ট্রাস্টিজের নেতৃত্বে একটি আধূনিক ক্যাম্পাসের পরিকল্পনা এবং এর অবকাঠামোগত সমস্ত পরিকল্পনা চলছে। অচিরেই আংশিক কাজের শেষে আমাদের স্থায়ী ক্যাম্পাস থেকে পুরোপুরিভাবে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হবে বলে আশা  করছি। একটি পূর্নাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ক্যাম্পাস খবই জরুরি। অচিরেই আমরা সেই কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌছাতে পারবো বলে আশা করছি।

ঢাকাটাইমস/১৫এপ্রিল/টিএ/এমআর