শশীকাহন: পৌরাণিক উপাখ্যান ফ্যান্টাসি থ্রিলার সিরিজ,পর্ব-দুই

প্রকাশ | ১৫ জুলাই ২০১৯, ২২:৩৬

ড.রাজুব ভৌমিক

পরের দিন রাজসভায় মহারাজ শশাঙ্ক তার পরবর্তীতে কে লাগগিন্তা রাজ্যের রাজা হবে সে বিষয়ে আলোচনা শুরু করে। মহারাজা শশাঙ্ক এর আগের দিন বিকালে মন্ত্রী সিনাতিকে ডেকে পাঠায়। মন্ত্রী সিনাতিকে মহারাজা শশাঙ্ক আদেশ দেন যাতে রাজ্যের সব গুন মান্য রাজসভায় উপস্থিত হন। মন্ত্রী সিনাতি সারারাজ্যে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে রাজার আদেশ জারি করে। রাজসভায় একে একে সবাই উপস্থিত হচ্ছে। বহুদেশের রাজা ও তাদের মন্ত্রীরা আসছে। 

এসে সবাই সভাতে গুন-গুন করছে। সবার মনে একটি প্রশ্ন, ‘কে হবে লাগগিন্তা মহারাজ্যের ভবিষ্যত মহারাজা?’ এত বড় বিশাল রাজ্যের ভার মহারাজ শশাঙ্ক কার উপরে দিবে। 

কিছুক্ষণ পর রাজসভায় মহারাজের বড় পুত্র অখিল সন্ন্যাস বেশে হাজির। সভায় উপস্থিত সবাই বড় রাজপুত্র অখিলকে দেখে অবাক। রাজপুত্র অখিল আজ সভাতে কেন এসেছে? সবার মনে প্রশ্ন জাগে। কেননা অখিল আগেই ঘোষনা দেয় যে তার রাজা হবার কোন ইচ্ছে নেই। সে সন্ন্যাসধর্ম গ্রহণ করেছে। এখন সে হিরাসী পর্বতে তার স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে থাকে। বনের ফল-মূল খেয়ে কোনরকমে একটি কুঁড়ো ঘরে দিনানিপাত করে। অখিল হিরাসী পর্বতে বহু বছর ধরে সাধনা করে আসছে। অনেক সাধনার সিদ্ধিও লাভ করেছে। তার সাধনার দ্বারা চন্দ্রগ্রহের সর্বোত্তম অস্ত্র অখিলাস্ত্র তৈরি করেছে। অখিলাস্ত্র অনেক শক্তিশালী একটি অস্ত্র। এই অস্ত্র দিয়ে শশীরা দেবতাকেও বধ করতে পারবে। অখিল মূলত এই অস্ত্র তৈরি করে আকাশের মেঘকে আঘাত করে বৃষ্টি আনার জন্য যাতে করে গ্রীষ্মের ক্ষরায় শশীদের না খেয়ে থাকতে। প্রতিবছর বৃষ্টির অভাবে বহু শশীদেক ফসল ধ্বংস হয়ে যায়। কিন্তু অখিলাস্ত্র আকাশে ছুঁড়ে মারলে বৃষ্টি হয়। 

‘মহারাজ আমার প্রণাম গ্রহণ করুন। আপনার ঘোষণা শুনে আজ আমিও সবার মত এই ঐতিহাসিক রাজসভায় এসে হাজির। আজকের দিনটি লাগগিন্তা রাজ্যের জন্য স্মরণীয় একটি দিন। লাগগিন্তা রাজ্যের পরবর্তী রাজাকে আজ আমি আশির্বাদ দিয়ে যেতে চাই।’ অখিল বলল। 

রাজসভায় সবার ইচ্ছা বড় রাজপুত্র অখিল রাজা হোক। কিন্তু অখিল আগেই বলে দিয়েছে যে তার রাজা হবার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নাই।  সে তার পুরো জীবন সৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করে কাটাতে ইচ্ছুক। সংসার তাকে আকৃষ্ট করে না। 

মেজ রাজপুত্র নিম্ব সভায় এসে হাজির। নিম্ব সৃষ্টির সবচেয়ে সুদর্শন একজন পুরুষ। রাজসভায় সব নারী ও পুরুষ নিম্বকে দেখে অভিভূত। যেমন কোন মায়া দিয়ে সৃষ্টিকর্তা আপন হাতে খোদাই করেছে। অস্ত্রবিদ্যায়ও নিম্ব কম পারদর্শী নয়। অখিলের পরে নিম্বই চন্দ্রগ্রহের সবচেয়ে বড় যোদ্ধা। সভার সবাইকে প্রণাম করে নিম্ব তার আসন গ্রহণ করে। 

অবশেষে রাজসভায় ছোট রাজপুত্র মঞ্জট আসে। দেখতে স্থূলকায়, উচ্চতায় পাঁচফুট দুই ইঞ্চি এবং গায়ের রঙ কালো। তার অস্ত্রবিদ্যায় পারদর্শিতা কম। গুরুগৃহে পড়াশুনায় মঞ্জটের মন যেত না। কিন্তু মঞ্জট খুবই ধূর্ত স্বভাবের শশী। সে সহজেই শশীদের বোকা বানিয়ে দিতে পারে। লাগগিন্তা রাজ্যে প্রায় সবাই মঞ্জটের ধূর্ততা স্বভাবের কথা জানে। ছোট ছেলে বলে মহারানী কুর্নষা এবং মহারাজ শশাঙ্ক মঞ্জটকে তেমন কোন শাসন করতেন না। এতে মঞ্জট সহজেই একটু বখাটে ধরনের হয়ে যায়। মঞ্জট রাজসভায় আসার পর রাজসভায় উপস্থিত সবাই কেমন নিশ্চুপ হয়ে যায়। মঞ্জট সভার সবাইকে প্রণাম জানিয়ে তার আসন গ্রহন করে। চারিদিকে মঞ্জট তাকিয়ে আজকের সভায় কে কে এসেছে তা দেখছে। 

কিছুক্ষণ পর মহারাজ শশাঙ্ক রাজসভায় উপস্থিত সবাইকে আজ আসার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ‘আজ আমি আপনাদেরকে দুইটি সু-খবর দিতে চাই। আমি লাগগিন্তা রাজ্যের জন্য দুইটি গুরত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমার সিদ্ধান্তে কারও আপত্তি থাকলে আমাকে সবাই কৃপা করে জানাবেন।’

রাজসভায় সবাই ভাবতে শুরু করে মহারাজের দ্বিতীয় সুখবরটি কি হতে পারে? 

‘আমি আগামী মাসে একটি শুভ-দিন ঠিক করে যুবরাজ নিম্বের সাথে যুদ্ধ ও বিচারের দেবী আজ্রিয়ার বিবাহ সম্পন্ন করার ঘোষণা দিচ্ছি। আরেকটি সু-খবর হচ্ছে যুবরাজ নিম্বের বিয়ের এক মাস পরে যুবরাজ নিম্বের রাজ্য অভিষেক হবে।’ মহারাজ শশাঙ্ক আনন্দের সহিত এ সমাচার রাজ সভায় উপস্থিত করে। মহারাজার ঘোষণা শুনে রাজসভার সবাই জোরে করতালি দেয়। কনিষ্ঠ যুবরাজ মঞ্জট মহারাজের ঘোষণা শুনার পরে রাগে তার শরীর যেন জ্বলতে থাকে। কিন্তু উপায়ন্তর না দেখে মঞ্জট সবার সাথে করতালি দিতে থাকে। কিন্তু সে মনে মনে ভাবতে থাকে এর একটা উচিত সমাধান সে করবে। সে নিম্বকে কোনভাবে রাজা হতে দিবে না বলে মনে মনে পণ করে। 

বড় যুবরাজ অখিল মহারাজের ঘোষনা শুনে আনন্দিত হয়। যুবরাজ নিম্ব অখিলের কাছে যায়। অখিলকে প্রণাম করে বলে, ‘দাদা আমায় আশীর্বাদ করুন যাতে আমি পিতাশ্রীর মত সততা আর নিষ্ঠা দিয়ে রাজ্য পরিচালনা করতে পারি।’ অখিল নিম্বকে আশীর্বাদ করে বলে, ‘তোকে আমি প্রাণ ভরে আশীর্বাদ করি যাতে প্রজাদের যোগ্য রাজা হতে পারিস।’ অখিল কিছুক্ষণ পরে রাজসভা ত্যাগ করে হিরাসী পর্বতে চলে যায়। রাজকর্ম শেষে একে একে সবাই রাজসভা ত্যাগ করে।

মহারানী কুর্নষা এবং মহারাজা শশাঙ্ক দ্বিপ্রহরের ভোজন করছে। আজ মহারাজা শশাঙ্ক অনেক খুশি। এত খুশি যে তিনি রাজ প্রাসাদের সব কর্মচারীদেরকে প্রচুর স্বর্ণ-মুদ্রা বখসিস দেয়। মহারাজা রানী কে বলল, ‘জানো রাণী আজকে আমি অনেক খুশি। তুমিই ঠিক ছিলে।  নিম্ব এবং দেবী আজ্রিয়া মিলে আমার রাজ্য নতুনভাবে আলোকিত করবে। আজ তুমি যা চাইবে আমি তোমাকে তাই দিব।’ 

রাণী কুর্নষা রাজাকে আনন্দিত দেখে নিজেও অনেক আনন্দিত হয়। তিনি বলেন, ‘মহারাজা আমার আর এ জগতে চাওয়ার কিছু নেই। নিম্বের হাতে রাজ্যটি সমর্পণ করার পর চলুন আমরা আমাদের বংশ রক্ষার জন্য বাকিটা জীবন সাধনা করে কাটিয়ে দেই।’ মহারাণীর কথা শুনে রাজা শশাঙ্ক অত্যন্ত খুশি হয়। ‘ঠিক বলেছ রাণী। তোমার মত এতজ্ঞাণী সহধর্মিণী পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। নিম্বের অভিষেকের পর আমরা হিরাসী পর্বতে সাধন করতে চলে যাব।’ 

মহারাণীর ও মহারাজার কথাগুলো মঞ্জটের বিশ্বস্ত গুপ্তচর ঘুতনা সব গোপনে শুনে ফেলল। রাজপ্রাসাদে এবং সারারাজ্যে রাজকুমার মঞ্জটের বহু গুপ্তচর আছে। তারা সবসময় মঞ্জটকে রাজ্যের সব ঘটনা সম্পর্কে অবগত রাখে। গুপ্তচর ঘুতনা পরের দিন রাজকুমারে কক্ষে এসে হাজির। ‘রাজকুমার মঞ্জটের জয় হোক। রাজকুমার আমি আপনার জন্য একটি বার্তা নিয়ে এসেছি।’ গুপ্তচর ঘুতনা তখন রাজকুমার মঞ্জটকে মহারাজ ও মহারাণীর কথোপকথন খুলে বলল। রাজকুমার মঞ্জট গুপ্তচর ঘুতনাকে বখসিস দিয়ে বিদায় করে। সে মনে মনে ফন্দি আঁটতে থাকে। 

অন্যদিকে রাজসভায় বিয়ের ঘোষণা শুনে দেবী আজ্রিয়া অনেক খুশি হয়। দেবী আজ্রিয়া যুবরাজ নিম্বের সাথে দেখা করার জন্য রাজপ্রাসাদে আসে। রাজপ্রাসাদর প্রধান ফটকে দেবীর সাথে লাগগিন্তা রাজ্যের সেরা দশ যোদ্ধার একসাথে দেখা হয়। লাগগিন্তা রাজ্যের সেরা এই দশ যোদ্ধার বীরত্ব সারা চন্দ্রগ্রহবাসীর জানা। তাদের বিচক্ষণতার জন্যই লাগগিন্তা রাজ্য সারা চন্দ্রগ্রহে মাথা উঁচু করে আছে। তাদের বীরত্বের কথা নিয়ে কবিরা কত কবিতা ও গান লিখেছে। 

দশ যোদ্ধা একসাথে দেবীকে প্রণাম করে বলে, ‘মহারাণী, আমরা আপনার সেবক। আদেশ করুন। আপনার আশীর্বাদ দিন।’ খুশিতে লাগগিন্তা রাজ্যের দশজন সেরা যোদ্ধাকে আজ্রিয়া সেনা উপাধি দেয় এবং প্রত্যেক যোদ্ধাকে একহাজার হাতির শক্তি বর দেয়। দেবী বলেন, ‘যখন তোমরা এ রাজ্যের জন্য লড়বে তখন তোমাদের প্রত্যেকের একহাজার হাতির শক্তি হবে। আজ থেকে তোমাদেরকে আমার আশীর্বাদ রক্ষা করবে।’  এই বলে দেবী আজ্রিয়া রাজপ্রাসাদের ভিতরে চলে যায়। পথে মহারাজা শশাঙ্কের সাথে তার কক্ষের সামনে দেখা হয়। দেবী আজ্রিয়া মহারাজকে প্রণাম করে আশীর্বাদ চায়। 

মহারাজ বলল, ‘দেবী দয়া করে আমাকে পাপের ভাগীদার করবেন না। আমি একজন সামান্য শশীদের রাজা। আর আপনি সাক্ষাৎ একজন দেবী।’  দেবী আজ্রিয়া বলল, ‘মহারাজ, আপনি আমার পিতার সমান। যুবরাজ নিম্বের পিতা। আমাদের জন্য আশির্বাদ করবেন যাতে আমরা সবসময় জগতের কল্যাণে কাজ করতে পারি।’ দেবী আজ্রিয়ার কথায় মহারাজ মুগ্ধ হয়। আর মনে মনে বলে, ‘আহা, কত লক্ষী মেয়েটি।’ দেবী মহারাজের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যুবরাজ নিম্বের কক্ষের দিকে অগ্রসর হয়। পথে যুবরাজ মঞ্জটের সাথে দেখা হয়। মঞ্জট দেবী আজ্রিয়াকে রাজপ্রাসাদে দেখে তেলেবেগুনে জ্বলছে। দেবীর চোখে চোখ পড়তেই কনিষ্ঠ যুবারাজ মঞ্জট দেবীকে বলল, ‘যুদ্ধের দেবীর জয় হোক।’ তারপর সে আবার বলল, ‘একজন যোদ্ধা নারী কি সংসারী হতে পারে? দেবী আজ্রিয়াকে আর যাই হোক গৃহবধু হওয়া একদম শোভা পায় না। সারা সংসারের হাহকার লেগে যাবে যুদ্ধের দেবী!’ এই বলে মঞ্জট হো হো করে শয়তানি হাসি দেয়। 

যুবরাজ মঞ্জটের কথা শুনে দেবী আজ্রিয়ার মন খারাপ হয়ে যায়। তিনি মঞ্জটকে বলেন, ‘একজন নারীর অনেক পরিচয় আছে। সে একজন স্ত্রী, মাতা, এবং ভালবাসার প্রতীকও বটে। আশির্বাদ করুন যাতে আমি একজন স্ত্রী হিসেবে আমার ধর্ম পালন করতে পারি।’ এই বলে দেবী আজ্রিয়া চলে যায়। আর মঞ্জট মনে মনে ফুঁসতে থাকে। 

দেবী আজ্রিয়া যুবরাজ নিম্বের কক্ষে প্রবেশ করে। দেবীকে দেখে যুবরাজ বলে, ‘তাহলে তোমার কাছে মহারাজের ঘোষনা পৌঁছে গেল। মহারাজ যে এত তাড়াতাড়ি আমাদের বিয়ের ঘোষনা দিবে আমি কখনো চিন্তাও করতে পারিনি।’

‘হুম শুনেছি তবে বেশিক্ষন হয় নি। লাগগিন্তা থেকে অনেক দূরে এক রাজ্যে দু-পক্ষ যুদ্ধ করছে। আমি যুদ্ধের ধর্মপক্ষে সহায়তা করার সময় আমার এক ভক্ত যোদ্ধা এসে আমাকে এই খবর দেয়। আমি এই সংসাদ শোনার পর খুশিতে তোমার সাথে দেখা করতে চলে এসেছি। এই বিষয়ে বিস্তারিত তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই।’ দেবী আজ্রিয়া বলল। যুবরাজ নিম্ব তখন দেবী আজ্রিয়াকে মহারাজার ঘোষনা খুলে বলল। দেবী তখন নিম্বকে বলল, ‘এখন আমি আসি তাহলে। মহালয়ে যেতে হবে। দেবরাজ কৃতনু এবং মহাদেবী উষাকে এ সুখবরটি দিতে হবে।’ এই বলে দেবী আজ্রিয়া আকাশপথে সূর্যগ্রহের দিকে চলল। সূর্যগ্রহে পৌঁছে দেবী মহালয়ে প্রবেশ করে। 

দেবী আজ্রিয়া মহালয়ের সুরী সমুদ্রের উপর বিশাল অট্টালিকায় দেবরাজ ও মহাদেবীর সাথে দেখা করার জন্য দেবতাদের সভাকক্ষে যায়। সভাকক্ষে দেবরাজ কৃতনু, মহাদেবী উষা, ভালবাসা ও কামনার দেবী মুকি, ও পাপের দেবতা কিতমু উপস্থিত। দেবী আজ্রিয়াকে অনেকদিন পরে দেখে দেবরাজ কৃতনু আদরের আজ্রিয়াকে বুকে টেনে নেয়। সারা চন্দ্রগ্রহে আজ্রিয়ার জয়গান সূর্যগ্রহেও অনেক পরিচিত। সে জন্য দেবরাজ কৃতনু তার মেয়ে আজ্রিয়াকে নিয়ে সবার সাথে অনেক গর্ব করে। ‘আমার মেয়ে আজ্রিয়া একজন আদর্শ নারীর প্রতীক। কি নেই আজ্রিয়ার? রূপে গুনে বীরত্বে আজ্রিয়া কোন পুরুষের চেয়ে কম নয়। তার বীরত্বের কাছে দেবসেনারা মাথা নত করে থাকে। সত্যিই আজ্রিয়া আমি তোরে নিয়ে অনেক গর্ব করি।’ দেবরাজ বলল। 

‘পিতাশ্রী, আপনার আশীর্বাদ থাকলে একটি কীট ও মহান হয়ে যায়। আশীর্বাদ করবেন যাতে আমি আপনার মুখ সবসময় উজ্জ্বল রাখতে পারি।’ আজ্রিয়া বলল। 

আজ্রিয়া মহাদেবী উষাকে প্রণাম করে। এরপর দেবী আজ্রিয়া বলল, ‘পিতাশ্রী, মাতাশ্রী আজ আপনাদেরকে একটি সুসংবাদ দিতে এসেছি। আপনারা শুনে খুশি হবেন যে আমার সাথে লাগগিন্তা মহারাজ্যের যুবরাজ নিম্বের সাথে বিবাহ ধার্য করা হয়েছে।’

এ কথা শুনে দেবরাজ কৃতনুর মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। ‘দেবী আজ্রিয়া!’ দেবরাজ বলল। ‘অভদ্রতার একটা সীমা থাকা দরকার! কোন শশীর এত বড় সাহস যে আমার মেয়েকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেয়! আমি তাকে ধ্বংস করে দিব!’ দেবরাজ কৃতনু বলল। 

‘পিতাশ্রী, আমি যুবরাজ নিম্বকে অনেক ভালবাসি। নিম্বকে নিয়ে আমি সংসারী হতে চাই। নিম্বকে প্রথম দেখার পরই আমি তাকে মনে প্রাণে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করি পিতাশ্রী।’ দেবী আজ্রিয়া কেঁদে কেঁদে বলল। ‘কোন দেবতার সাথে শশীর বিয়ে কখনোই হতে পারে না। এ অসম্ভব! দেবতাদের বিয়ে দেবকুলেই হয়।’ দেবরাজ কৃতনু রেগে বলল। 

‘কিন্তু পিতাশ্রী আমি নিম্বকে অনেক আগেই মনে প্রাণে আমার স্বামী হিসেবে বেছে নিয়েছি।  নিম্বই আমার প্রাণের স্বামী।’ দেবী আজ্রিয়া কাকুতি মিনতি করে বলল। ‘তুই যদি আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে নিম্বকে বিয়ে করিস তাহলে তোর সূর্যগ্রহে আর কখনো স্থান হবে না।’ দেবরাজ বলল। 

‘আজ থেকে তুই আমার মেয়ে না। যা তুই আমার সামনে থেকে দূর হয়ে যা।’ দেবরাজ কৃতনু রাগে ও ক্ষোভে আজ্রিয়াকে বলল। মহাদেবী উষা দেবরাজ কৃতনুকে বারবার বোঝাতে ব্যর্থ হয়। মহাদেবী উষার চোখের জল কিছুতেই থামছে না। তিনি আজ্রিয়াকে বলেন, ‘মা, আমার লক্ষী মেয়ে, তোকে দেবকূলের সবচেয়ে ভাল পাত্র দেখে বিয়ে দিব। একজন শশীকে বিয়ে করে আমাদের দেবকূলের মান সম্মান নিয়ে খেলা করিস না।’ দেবী আজ্রিয়া উত্তরে বলেন, ‘মাতাশ্রী, আমি কখনো তোমাদের অবাধ্য হয়নি। আমি সত্যিকারে নিম্বকে ভালবাসি। সেই আমার অন্তরের স্বামী। আমি এই মহালয় ও শান্তিকুঞ্জ চাই না।’ এই বলে দেবী আজ্রিয়া গভীর দুখে সূর্য গ্রহ ছেড়ে চন্দ্রগ্রহে চলে আসে। 

আকাশ পথে দেবী আজ্রিয়া কেঁদে কেঁদে যাবার সময় তার এক একটা অশ্রুর ফোটা ভূমিতলে বিস্ফোরকের মত হয়ে পড়ছে। দেবী আজ্রিয়ার বেশিরভাগ অশ্রু সূর্যগ্রহের নার্কে পড়ে। আর সে অশ্রু থেকে নার্কে চিরস্থায়ী অগ্নিকুণ্ড তৈরি হয়। সূর্যগ্রহের দ্বিতীয় বিভাগ নার্ক হল পাপীদের স্থান। মৃত্যুর পর সব পাপী আত্মাকে তাদের পাপের সাজা এখানে ভোগ করতে হয়। নার্কের রাজা জিগি দেবী আজ্রিয়ার সৃষ্টি আগুনে অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে। নার্কের সব আত্মার হাহাকারে ও চিৎকারে পরিবেশ ভারী হয়ে আসছে। আগুনের এত প্রকোপ এর আগে কারো জানা ছিল না। 

নার্কের রাজা জিগি আগুনের দেবতা বানহিকে স্মরণ করে। বানহি সাথে সাথে হাজির। ‘ভ্রাতাশ্রী হঠাৎ এ অসময়ে আমাকে স্মরণ করছেন। সবকিছু ঠিক আছে তো? বলুন ভ্রাতাশ্রী, আপনার জন্য এই অনুজ কি সেবা করতে পারে?’ বানহি বলল। ‘ভ্রাতা, তুমি আগুনের দেবতা। আমরা দুজনে একসাথে বড় হয়েছি। তোমার আগুনের প্রকোপ সম্বন্ধে আমার চেয়ে কারও বেশি ধারনা নাই। কিন্তু দেবী আজ্রিয়া অশ্রু থেকে সৃষ্টি আগুনের তাপ এই পাপী আত্মাদেরতো দূরের কথা আমি নিজেও সহ্য করতে পারছি না। তুমি একটা কিছু কর।’ দেবতা জিগি বলল। ‘ঠিক আছে ভ্রাতাশ্রী, আমি দেখছি।’ এই বলে আগুনের দেবতা বানহি অনেক চেষ্টা করে সে আগুনকে নিভানোর জন্য। কিন্তু সে বারবার ব্যর্থ হয়। তখন সে বুঝতে পায় এ আগুন সাধারণ নয়। এ আগুন দেবী আজ্রিয়ার অশ্রুতে সৃষ্টি। ‘ভ্রাতাশ্রী, ক্ষমা করবেন। আমি বহুবার চেষ্টা করেছি এ আগুন নিভাতে এবং নিয়ন্ত্রণ করতে কিন্তু আমি বারবার ব্যর্থ হলাম। এ আগুন আমার সৃষ্টি নয়। তাই এর উপর আমার কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। এ আগুনের কোন শেষ নেই।’ আগুনের দেবতা বানহি বলল। 

‘তাহলে কি এর কোন প্রতিকার নেই? নার্কের সব আত্মার চিৎকার সহ্য করা যাচ্ছে না। আমি জানি নার্কে পাপীরা তাদের পাপের সাজা ভোগ করতে আসে। কিন্তু এ জগতে এমন কোন পাপ নেই যার জন্য একটি আত্মাকে এমন সাজা ভোগ করতে হবে।’ নার্কের রাজা জিগি বলল। 

‘আছে ভ্রাতাশ্রী আছে। আজ থেকে যে তার ভালবাসার নামে ছলনা করবে বা ভালোবাসার প্রিয়শশীকে শারীরিক বা মানসিক ভাবে আঘাত করবে তাদের সে পাপের প্রায়শ্চিত্ত এখানে করতে হবে।’ দেবতা বানহি বলল। ‘আজ থেকে নার্কের এই অংশের নাম হবে আজ্রিয়াকুন্ড।’ নার্কের রাজা জিগি বলল। ‘ভ্রাতাশী, দেবী আজ্রিয়ার সৃষ্ট এই অগ্নিকুন্ডের প্রভাব যাতে নার্কের অন্য অংশে না পৌঁছে সেজন্য আমার তৈরি আগুন বেড়া এর চারিপাশে দিচ্ছি।’ এই বলে দেবতা বানহি তার চক্ষু থেকে আগুনের রশ্মি তৈরি করে এবং আজ্রিয়াকুন্ডের চারিদিকে তার আগুন ছড়িয়ে দেয়। 

চলবে...

...

লেখক: কবি ও লেখক, অধ্যাপক: অপরাধবিদ্যা, আইন ও বিচার বিভাগ, জন জে কলেজ, সিটি ইউনিভার্সিটি নিউইর্য়ক, মনস্তাত্তিক বিভাগ, হসটস কলেজ, সিটি ইউনিভার্সিটি, নিউইর্য়ক। কাউন্টার টেরোরিজম কর্মকর্তা, নিউইর্য়ক সিটি পুলিশ ডিপার্টমেন্ট (এনওয়াইপিডি)।