শেরপুরে বন্যার অবনতি

প্রকাশ | ১৬ জুলাই ২০১৯, ১৯:২০

শেরপুর প্রতিনিধি, ঢাকাটাইমস

টানা বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে শেরপুরের পাঁচ উপজেলার বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। রবিবার দিবাগত গভীর রাত থেকে আজ মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত টানা বৃষ্টিতে জেলার সদরসহ নকলা, নালিতাবাড়ী, শ্রীবরদী ও ঝিনাইগাতীর নিম্নাঞ্চলের শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। প্রায় লাখো মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছেন। পাশাপাশি বৃষ্টি অব্যাহত থাকায় নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে।

এছাড়া বন্যার পানি প্রবেশ করায় ঝিনাইগাতী ও শেরপুর সদর উপজেলার ৪২টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে বলে জানান ঝিনাইগাতী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মোফাখখারুল ইসলাম। বন্যার পানিতে ডুবে গত তিন দিনে শ্রীবরদীতে দুজন ও ঝিনাইগাতীতে এক শিশুসহ তিনজন মারা গেছে।

এদিকে এখন পর্যন্ত সরকার থেকে কোন ত্রাণ সহায়তা না পাওয়ার অভিযোগ করেছেন পানিবন্দি মানুষেরা। তবে বেশ কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের পক্ষ থেকে বেশ কিছু এলাকায় শুকনো খাবার বিতরণের খবর পাওয়া গেছে।

ঝিনাইগাতী সদর ইউপি চেয়ারম্যান মোফাজ্জল হোসেন জানান, উপজেলার চারটি ইউনিয়নের প্রায় ২৫টি গ্রামের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। ফলে ঝিনাইগাতী সদর, ধানশাইল, মালিঝিকান্দা ও হাতিবান্ধা ইউনিয়নের প্রায় ২৫ হাজার মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় মানবেতর জীবন-যাপন করছে। বিশেষ করে গৃহপালিত পশু নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন গৃহস্থরা। বিভিন্ন এলাকার রোপা আমন ধানের বীজতলা ও সবজি বাগান পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে। এছাড়া কাঁচা ঘরবাড়ি, কালভার্ট ও গ্রামীণ সড়কের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। প্রায় দুইশতাধিক পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। বাড়িতে পানি উঠায় চুলা জ্বালাতে পারছেন না প্লাবিত এলাকার মানুষ। শুকনো খাবার খেয়েই দিন পার করছেন তারা।

তিনি আরো জানান, পাহাড়ি ঢলের পানির প্রবল তোড়ে মহারশি নদীর বাঁধের পূর্ব দিঘিরপাড় এলাকায় ১৫০ মিটার অংশে ভাঙন দেখা দিয়েছে। যে কোন সময় এটি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যেতে পারে। তবে ভাঙনরোধে স্থানীয় এলাকাবাসী স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে কাজ করছে। বন্যায় তার ইউনিয়নের দিঘিরপাড়, সুরিহারা, কালিনগর, সারিকালিনগর, দড়িকালিনগর, বালিয়াগাঁও, কোনাগাঁও ও জরাকুড়া গ্রামের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে।

ধানশাইল ইউপি চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম জানান, সোমেশ্বরী নদীর পানির প্রবল তোড়ে তার ইউনিয়নের নয়াপাড়া, দাড়িয়ারপাড়, কান্দুলী, মাঝাপাড়া ও বাগেরভিটা গ্রামের অধিকাংশ এলাকা প্লাবিত হয়েছে।  যে কারণে পাঁচ কিলোমিটার দীর্ঘ ধানশাইল-বাগেরভিটা-ভটপুর সড়কের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সড়কের অধিকাংশ স্থানে ভেঙে গেছে এবং পিচ ওঠে গিয়ে গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। বাগেরভিটা এলাকায় সোমেশ্বরী নদীর ওপর নির্মিত ১০০ ফুট দীর্ঘ সেতুটির দুপাশের মাটি সরে গেছে। ফলে সেতুটি এখন হুমকির সম্মুখিন হয়ে পড়েছে এবং এলাকাবাসী ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে।

মালিঝিকান্দা ইউপি চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম জানান, তার ইউনিয়নের আটটি গ্রামের অধিকাংশ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। অনেক বাড়িঘরে পানি প্রবেশ করেছে। ফলে এলাকাবাসী নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য অন্যত্র সরে যাচ্ছে। মালিঝি নদীর পাগলারমুখ বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে হাতিবান্ধা-কামারপাড়ার মধ্যে সড়ক যোগযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। নিম্নাঞ্চলের শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়ে এখন প্রায় লাখো মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে। এছাড়া, বন্যার পানিতে ডুবে গত তিন দিনে শ্রীবরদীতে দুজন ও ঝিনাইগাতীতে এক শিশুসহ তিনজন মারা গেছে।

নালিতাবাড়ী: উপজেলার মরিচপুরান এলাকায় দুটি স্থানে ভোগাই নদীর সাড়ে ৬০০ ফুট বাঁধ ভেঙে সাতটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ফলে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়ে সড়ক ডুবে গেছে। এবং বাড়ি ঘরে পানি প্রবেশ করায় গত তিনদিন যাবত সাত গ্রামের মানুষ কষ্টে রয়েছেন।

স্থানীয় আকবর হোসেন, মতিউর রহমান ও আব্দুর রহমান জানান, নালিতাবাড়ীর উত্তর কুন্নগন রাজারখালপাড় এলাকায় ভোগাই নদীর ২০০ফুট বাঁধ ও ফকিরপাড়া চেয়ারম্যানের বাড়ির পেছনে ভোগাই নদীর সাড়ে ৪০০ ফুট বাঁধ ভেঙে গেছে। ভাঙন অংশ দিয়ে ভোগাই নদীর ঢলের পানি প্রবেশ করে  মরিচপুরান, বাঁশকান্দা, ফকিরপাড়া, খলাভাঙ্গা, ভোগাইরপাড়, মরিচপুরান পুর্বপাড়া ও উল্লারপাড়  গ্রামের আশপাশে এলাকাগুলোতে বন্যা দেখা দিয়েছে। সড়কে পানি থাকায় ফকিরপাড়া উচ্চবিদ্যালয়, খলাভাঙা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা স্কুলে যেতে পারছে না। মরিচপুরান থেকে ফকির পাড়া উচ্চবিদ্যালয়ের সড়ক এবং মরিচপুরান চৌরাস্তা বাজার থেকে ছনটাল হয়ে রাবার ড্যাম সড়ক ও মরিচপুরান পুর্বপাড়া থেকে খালভাঙা উচ্চবিদ্যালয়ের সড়ক তিনদিন ধরে পানিতে ডুবে আছে।

এছাড়া পাহাড়ি ঢলের কারণে প্রায় ৩০টি পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। যাতায়াতের সড়কে পানি থাকায় এলাকাবাসী ঠিকমত চলাচল করতে পারছেন না।

মরিচপুরান ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান খন্দকার শফিক আহমেদ জানান, দুটি অংশে সাড়ে ৬০০ ফুট ভোগাই নদীর বাঁধ ভেঙে গেছে। ভাঙণ অংশ দিয়ে পানি প্রবেশ করায় সড়কসহ সাতটি গ্রামে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। নদীর পানি কমলেই বাঁধ সংস্কারের দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে তিনি জানান।

নালিতাবাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুবেল মাহমুদ বেশ কয়েকটি এলাকা পরিদর্শন করে বলেন, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ১০ মেট্রিক টন জিআর চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া যাদের বাড়িঘর ক্ষতি হয়েছে তাদেরকে অর্থ সহায়তা প্রদান করা হবে।

নকলা: উপজেলার চন্দ্রকোনা ইউনিয়নের ব্রহ্মপুত্র নদের শাখা মৃগী নদীর পানির তীব্র স্রোতে ভাঙন শুরু হয়েছে। এতে বাছুর আলগা দক্ষিণপাড়া, চকবড়ইগাছি গ্রামের আফাজ উদ্দিন ও আছিয়া বেগমের বাড়ি ঘরসহ বেশি কিছু আবাদি জমি ও চলাচলের রাস্তা নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। অনেকেই নদী ভাঙন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বাড়ি-ঘর অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছে।

স্থানীয় কবির মিয়া ও বাচ্চু শেখ জানান, দীর্ঘদিন যাবৎ মৃগী নদীতে অবৈধভাবে বেশ কয়েকটি ড্রেজার মেশিন বসিয়ে প্রচুর পরিমাণে বালু উত্তোলনের কারণে নদীটি অধিক গর্ত হয়ে যায় ফলে বর্তমান অতি বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পানির ঢলে নদীর উত্তরপাড়ে চকবড়ইগাছী ও বাছুর আলগা এলাকায় এ ভাঙন শুরু হয়েছে। এ কারণে ঐ এলাকার একটি ঘাট সংলগ্ন পাকা রাস্তার নিচের মাটি সরে যাওয়ায় ঝুঁকিতে যাতায়াত করছেন এলাকাবাসী।

পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদে পানি বৃদ্ধির ফলে শেরপুর সদর উপজেলার চরপক্ষিমারী ইউনিয়নের বেপারীপাড়া সংলগ্ন চরের ঘরবাড়িতে পানি প্রবেশ করেছ। এখানকার ৫০টি পরিবার বেপারীপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আশ্রয় নিয়েছে।

এ ব্যাপারে নকলা উপজেলা নির্বাহী অফিসার জাহিদুর রহমান বলেন, নদী ভাঙনে জানমাল রক্ষায় সতর্ক থাকার জন্য ভাঙন কবলিত এলাকার লোকজনকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সম্ভব হলে অন্যত্র বাড়িঘর সরিয়ে নিতে বলা হয়েছে। সেই সাথে ভাঙনের বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্মকর্তাসহ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।

শ্রীবরদী: উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নের ১৫টি গ্রামের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এছাড়া বর্ষণের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। প্লাবিত গ্রামগুলোর কাঁচা ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, রোপা আমন ধানের বীজতলা, সবজি বাগান, পুকুরের মাছ পানিতে তলিয়ে গেছে। আবহাওয়া অপরিবর্তিত থাকলে বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

তবে বন্যার পানি দ্রŮত নেমে গেলে কৃষি ক্ষেত্রে তেমন ক্ষতি হবে না বলে দাবি করেন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নাজমুল হাসান।

এ ব্যাপারে শ্রীবরদী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সেঁজুতি ধর বলেন, বন্যার্ত এলাকার মানুষের খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। প্রয়োজনে ত্রাণের ব্যবস্থা করা হবে

বন্যায় নদী ভাঙন ঠেকাতে রবিবার সকাল থেকে ব্যবস্থা নেয়া শুরু হয়েছে বলে জানান শেরপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মাজহারুল ইসলাম।

ঢাকাটাইমস/১৬জুলাই/ইএস