ছোট্ট ওহি এখনো জানে না বাবা নেই

প্রকাশ | ১৬ জুলাই ২০১৯, ২০:০৫ | আপডেট: ১৬ জুলাই ২০১৯, ২০:১৯

বোরহান উদ্দিন, ঢাকাটাইমস

‘স্যার মিকেল যেমন আছে তেমন থাকুক। ও বেঁচে থাকলেই হবে। আমি আর কিছু চাই না। মিকেলকে ছাড়া তো থাকতে পারবো না।’- পুলিশের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তাকে এভাবে বিলাপ করে কথাগুলো বলছিলেন ট্রাকচাপায় প্রাণ হারানো সার্জেন্ট গোলাম কিবরিয়া মিকেলের স্ত্রী মৌসুমী মৌ। মিকেলের স্ত্রী মৌসুমীও একজন সার্জেন্ট।

মঙ্গলবার ঢাকা মেডিকেলের লিফটে যখন অঝোরে কান্না করতে করতে স্বামীকে বাঁচানোর আকুতি করছিলেন মৌসুমী তখন তার কোলে প্রায় দুই বছরের একমাত্র ছেলে ওহি। ছোট্ট ওহি কিছু না বুঝলেও বারবার এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিল। আর হাত দিয়ে একবার মুখ ঢেকে ধরে, আরেকবার মায়ের কাঁধে মাথা রেখে চুপ করে থাকে। ও তখনও জানে না কিছুক্ষণ পরই আনুষ্ঠানিকভাবে চিকিৎসকরা তার প্রিয় বাবাকে মৃত্যু ঘোষণা করবেন। বেলা ১১টার দিকে তার আগেই মিকেলের মৃত্যু হয় বলে জানা যায়।

আইসিইউতে যাওয়ার লিফট চার তলায় আসার পর আর বেশিদূর আগাতে পারেননি মৌসুমী। কারণ তার পা চলছিল না। সঙ্গে থাকা দুজন নারী সার্জেন্ট তাকে একটি চেয়ার দিলে সেখানে বসেই প্রিয়তম স্বামীর জন্য ডুকরে কাঁদতে থাকেন তিনি। তখনও মায়ের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল ওহি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী সার্জেন্ট গোলাম কিবরিয়া মিকেল বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে দায়িত্ব পালনের সময় যমুনা গ্রুপের কাভার্ডভ্যানের চাপায় সোমবার গুরুতর আহত হন। নলছিটি থানা পুলিশ কাভার্ডভ্যান ও চালক জলিল সিকদারকে আটক করে। জলিল সিকদারের গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলের মির্জাপুর। এ ঘটনায় একটি মামলা হয়েছে।

দুর্ঘটনার পর আহত পুলিশ সার্জেন্ট কিবরিয়াকে উদ্ধার করে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকা মেডিকেলে আনা হয়। সেখানে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান এই পুলিশ কর্মকর্তা।  গোলাম কিবরিয়া দীর্ঘদিন ধরে বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগে কর্মরত ছিলেন। তার বাড়ি পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জে।

এদিকে দুই ভাই বোনের মধ্যে বড় গোলাম কিবরিয়া। কিবরিয়ার বাবা উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা ইউনুস আলী সরদার সাবেক কলেজ শিক্ষক। নাম সাহিদা বেগম। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে শোকে পাথর হয়ে গেছেন তারা। হাসপাতালে ছুটে আসা অসংখ্য বন্ধু বান্ধব ও শুভানুধ্যায়ীরা কিবরিয়ার এভাবে চলে যাওয়া কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না। অনেকেই এসময় কান্নায় ভেঙে পড়েন।

চার বছর আগে পুলিশে যোগ দেন কিবরিয়া

২০০৪ সালে সুবিদখালী রহমান ইসহাক পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন কিবরিয়া। তারপর সুবিদখালী ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে পাড়ি জমান রাজধানী ঢাকায়। ২০১৫ সালে পুলিশে চাকরি হয় কিবরিয়ার। প্রথমে ঢাকায় থাকলেও পরে বরিশালে পুলিশের সার্জেন্ট পদে ছিলেন তিনি।

তিন বছর আগে কিবরিয়ার বিয়ে হয়ে মৌসুমির সঙ্গে। বিয়ের পর থেকে তারা বরিশালে থাকতেন।

সদা হাসিখুশি গোলাম কিবরিয়া বন্ধু মহলের কাছে মিকেল নামে পরিচিত ছিলেন। জানা গেছে, ইচ্ছা ছিল বাংলাদেশ পুলিশে চাকরি করবেন। সেজন্য অন্য কোনো চাকরির পরীক্ষা না দিয়ে বাংলাদেশ পুলিশে সার্জেন্টে হিসেবে যোগ দেন তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের ২০০৭-২০০৮ সেশনের শিক্ষার্থী কিবরিয়া থাকতেন এসএম হলের ১৯ নম্বর রুমে। কিবরিয়ার মৃত্যুর খবর শুনে হাসপাতালে আসা অনেকেই আফসোস করে বলছিলেন, এই ছোট্ট বাচ্চার কী হবে? ও তো কিছুই বোঝে না। কোনো দিন জন্মদাতা বাবাকে বাবা বলে ডাকতেও পারবে না।

কিবরিয়াকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ব্যাচমেট কামরুল ইসলাম বলেন, ‘ও সবসময় যেমন হাসিখুশি থাকত। ওর ছেলে ওহিও খুব হাসিখুশি ও দূরন্ত। ডিউটি না থাকলেও ছেলেকে নিয়ে ঘুরে বের হতো। ছেলেকে আমরা ‘জুনিয়র কিবরিয়া’ বলে ডাকতাম।’

মঙ্গলবার বাদ আসর রাজারবাগ পুলিশ লাইনস মাঠে গোলাম কিবরিয়ার প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। সেখান থেকে লাশ নেওয়া হয় বরিশাল পুলিশ লাইনসে। সেখানে বুধবার দ্বিতীয় দফা জানাজার পর লাশ নেওয়া হবে গ্রামের বাড়ি সুবিদখালীতে। সেখানে তৃতীয় ও শেষ দফা জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হবে।

রাজারবাগের জানাজায় পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ছাড়াও তার সহকর্মী, বন্ধুবান্ধব ও ঢাকায় অবস্থানরত মির্জাগঞ্জের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশ নেন।

এদিকে গোলাম কিবরিয়ার মৃত্যুতে শোক জানিয়েছে ঢাকাস্থ মির্জাগঞ্জ উপজেলা স্টুডেন্ট’স ফোরাম ও মির্জাগঞ্জ উপজেলা স্টুডেন্ট’স ওয়েব, ঢাকা। সংগঠন দুটির পক্ষ থেকে তার রুহের মাগফেরাত কামনা ও শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানানো হয়েছে। কিবরিয়া স্টুডেন্ট’স ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।

ঘাতক চালকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি

সার্জেন্ট গোলাম কিবরিয়াকে কভার্ডভ্যান চালক ইচ্ছাকৃত চাপা দিয়েছে এমন অভিযোগ করে ঘাতকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন। মিকেলের বন্ধু নাজিব ফরায়েজী ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘এটা একটি হত্যা। আমরা ঘাতক চালকের ফাঁসি চাই।’

গোলাম কিবরিয়ার ব্যাচমেট শরিফুল হাসান বলেন, ‘সিগনাল অমান্য করে সাজেন্টরে উপর গাড়ি তুলে দেওয়া মানে তাকে ইচ্ছে করে হত্যা করা হয়েছে। আমরা বলবো কিবরিয়াকে খুন করা হয়েছে। খুনের বিচার কী হবে? রাষ্ট্রের কাছে বিচার চাচ্ছি।’

(ঢাকাটাইমস/১৬জুলাই/বিইউ/জেবি)