আসুন ডেঙ্গুর ব্যাপারে সচেতন হই
একজন ডেঙ্গু রোগীর রক্ত লাগবে। পাঁচ বছরের বাচ্চা। আমার রক্তের সাথে মেলে। ১৪ ঘণ্টা আগের ফেসবুক পোস্ট। ফোন করলাম। ওপাশ থেকে রিসিভ করে ভদ্রলোক হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। শিশুটি আর নেই।
সাত সকালে বিবিসির সাংবাদিক প্রিয় আরিফ ভাইয়ের স্ট্যটাস দেখে শক্ত হয়ে সোফায় বসে আছি। আরিফ ভাই লিখেছে, আমার স্ত্রী এই গভীর রাতে ছাদে উঠে ছোটাছুটি করছে। কোনো টবের গোড়ায় বৃষ্টির পানি জমে নেইতো? আমার শিশুটি দুর্বার, দুরন্ত। সারাদিন ছুটে বেড়ায়। কীভাবে আমি রক্ষা করব তাকে? কীভাবে? একই প্রশ্ন আমারও।
কারণ, আমার ছেলেটার বয়স আড়াই। ছেলেটার চেয়ে এই মুহূর্তে পৃথিবীতে আমার প্রিয় আর কে আছে, সেটা খুঁজে বের করা কঠিন। বাসার কোথাও মশা দেখলে আমি ভয়ে আঁতকে উঠি। ছেলেটার শরীর একটু গরম হলে ভয়ে থাকি। আমার ধারণা, প্রত্যেক বাবা-মায়ের এখন একই অবস্থা। এই দেশে আমাদের কখনো সড়ক দুর্ঘটনা, কখনো নিপীড়নকারী, কতো রকমের ভয়ে থাকতে হয়। এখর আমরা সবাই ভয়াবহ ডেঙ্গু আতঙ্কে দিন পার করছি।
এখন কথা হলো ডেঙ্গু থেকে কীভাবে বাঁচবো? আমি আমার বাসা বাড়িটা সর্বোচ্চ পরিচ্ছন্ন রাখছি। পাশের বাড়ির লোকটা রাখছে তো? সিটি করপোরেশন তার দায়িত্ব ঠিক মতো পালন করছে তো? আবার কীভাবে বুঝতে পারবো ডেঙ্গু?
ভয়ের কথা হলো, ডাক্তাররা বলছেন, আলাদা চেহারা নিয়ে এবার হাজির হয়েছে ডেঙ্গু৷ জ্বরের মাত্রা কম৷ র্যাশ দেখা যায় না, ব্যথাও হয় না। অনেকে বুঝতেই পারেন না যে তিনি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত। একে ‘শকড সিনড্রম ডেঙ্গু' আখ্যা দিয়ে ঝুঁকিও বেশি বলে সতর্ক করেছেন চিকিৎসকরা৷
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বলছে, এই মৌসুমে সারাদেশে প্রায় পাঁচ হাজার লোক ডেঙ্গুতে আক্রান্ত। তারা এ পর্যন্ত তিনজনের মৃত্যুর কথা স্বীকার করলেও বিভিন্ন সূত্র বলছে শিশুসহ ১২ জন মারা গেছেন।
আরও ভয়ের বিষয় হলো, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কমিনিউকেবল ডিজিজ শাখা কয়েক মাস আগে ঢাকার দুই সিটি এলাকার ৯৭টি ওয়ার্ডে একটি জরিপ চালানো হয়। জরিপে ১০০টি জায়গার ৯৯৮টি বাড়ি থেকে পানির নমুনা সংগ্রহ করা হয়। আর সেই নমুনায় ডেঙ্গুর জন্য দায়ী এডিস মশার উচ্চমাত্রায় লার্ভা পাওয়া যায়। পরিত্যক্ত টায়ার, প্লাস্টিক ড্রাম, বালতি, নির্মানাধীন বাড়ির খোলা ট্যাঙ্ক, ফুলের টব থেকে যে পানির নমুনা নেয়া হয় সেই পানিতে এডিস মশার লার্ভা ছিলো সর্বোচ্চ।
কথাগুলো পড়েই আমার বুক শুকিয়ে আসছে। মেডিসিন বিবেশষজ্ঞ লেলিন চৌধুরী বলছেন, আগে আমরা বলতাম তিন দিন দেখার জন্য। কিন্তু এবার যে ধরনের ডেঙ্গু তাতে কারুর সামান্য জ্বর হলেই চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। কোনো দেরি করা যাবে না। জ্বরের সাথে বমি ও লুজ মোশনও ঙেঙ্গুর লক্ষণ।
এগুলো পড়লে বুক কেঁপে ওঠে। বর্তমান ডেঙ্গু পরিস্থিতিকে উদ্বেগজনক বলেছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ খান আবুল কালাম আজাদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘২০০০ সালে এই শহরে প্রথম ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দেয়। ২০০৯ সাল থেকে ঢাকার এই প্রতিষ্ঠানে কাজ করছি। এখন দিনে গড়ে ৩০ থেকে ৩৫ জন ডেঙ্গুর রোগী ভর্তি হচ্ছে ঢাকা মেডিকেলে। এত রোগী কখনো ভর্তি হতে দেখিনি।’
আমি সত্যি খুব ভয় পাচ্ছি। আপনি হয়তো ভাবছেন সিটি করপোরেশনকে মশা মারতে বলবেন। কিন্তু এবার জানলাম, সিটি করপোরেশন যে ওষুধ ছিটায় তা অকার্যকর। এখন কী করবো আমরা? কাজেই কারও জন অপেক্ষা না করে নিজেই নেমে পড়ুন।
প্রথম কাজ, নিজের বাসাবাড়ি ও আশপাশে যুদ্ধ। কারণ, ডেঙ্গু রোগের বাহক এডিস মশা কিন্তু ময়লা আবর্জনায় বংশ বিস্তার করে না। এটি সম্পূর্ণ স্বচ্ছ পানিতে বংশ বিস্তার করে। কাজেই সেই পানি পরিষ্কার করতে হবে।
বিশেষ করে বাসাবাড়ির ফুলের টব, পরিত্যক্ত ড্রাম, বোতল, ছাদবাগানে বালতি ও বাটিতে জমে থাকা পানিতে মশার লার্ভা জন্মায়। এক থেকে দুই দিনের জমে থাকা পানিতেই ডেঙ্গু মশার লার্ভা পাওয়া যায়। এসব লার্ভা এক সপ্তাহের মধ্যেই মশায় পরিণত হয়। কাজেই কোথাও যেন পানি জমতে না পারে।
নিজের বাসা তো পরিষ্কার করলেন? পাশের বাসা? এই শহরে দুই ভবনের মাঝখানে ফাঁকা জায়গায় বা কার্নিশে যতো ধরনের আবর্জনা ফেলা হয় সেগুলো দেখলে চমকে উঠতে হয়। কাজেই নিজেরা এবং প্রতিবেশীদেরকেও সচেতন হতে হবে। ভবন মালিক বা সমিতিকে সক্রিয় হতে হবে যাতে দুদিনের বেশি পানি না জমে। পারলে প্রতি পাড়ায় স্বেচ্ছাসেবী কমিটি করুন। তারা এই কাজে যুক্ত হোক।
আরেকটা কথা, ডেঙ্গুতে আক্রান্তদের চিকিৎসায় জ্বর নিয়ন্ত্রণে প্যারাসিটামল ছাড়া অন্য কোনো ওষুধ বা চিকিৎসা, যেমন অ্যান্টিবায়োটিক বা অ্যাসপিরিনজাতীয় ওষুধ, এনএসএআইডি, স্টেরয়েড, ফ্রেশ ফ্রোজেন প্লাজমা, প্লাটিলেট কনসেনট্রেট চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া দেওয়া যাবে না।
সবশেষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, দুই নগরপিতাসহ সব কর্তৃপক্ষকে বলবো, আপনারা প্লিজ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিন। এই শহরের সব বাসিন্দাদের কাছে করজোড়ে বলছি, আপনারা সচেতন হোন। মনে রাখবেন প্রতিটা শিশুর মৃত্যু মানে আমরা কেউ না কেউ দায়ী। আর যে বাবা-মা তার সন্তান হারাচ্ছে তার কাছে পুরো পৃথিবী অর্থহীন। কোনো সান্ত্বনা কাজে আসবে না। কাজেই চলুন আমরা সম্মিলিতভাবে লড়াই করি। যুদ্ধ করি। আর একটা শিশুও যেন না মারা যায়। শুভ সকাল, সবাইকে ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ সফল হোক। প্রতিটা শিশু ভালো থাকুক।
লেখক: সাংবাদিক ও উন্নয়ন কর্মী