মশা নিয়ে মশকরা

প্রকাশ | ১৮ জুলাই ২০১৯, ১৮:২৬

অরুণ কুমার বিশ্বাস

মশারা ইদানীং আর মানুষের ওপর আস্থা রাখতে পারছে না। মানুষের অবিমৃষ্যকারিতা বস্তুত তাদের জ্বালিয়ে মারছে। তারা না পারছে ধীরেসুস্থে মরতে, না বাঁচতে। কী কী সব ভুয়া দুর্গন্ধযুক্ত ওষুধপাতি ছিটিয়ে তাদের জান একেবারে জেরবার করে রেখে দিচ্ছে। মশারা বুঝতে পারছে না যে, মানুষ কী করে এমন বেকুব হয়! তারা না সৃষ্টির সেরা জীব, আশরাফুল মখলুকাত! না না, তারা আর মোটেও সেরা জীব নেই, তারা এখন ‘ছেঁড়া’ জীবে পরিণত হয়েছে। 

ঘটনা এক। মশাদের মাঝে সবচে সম্ভ্রম জাগানিয়া যারা, তারা হলো গিয়ে এডিস মশা। কেউ কেউ আবার সভয়ে তাদের ‘এসিড’ মশাও বলে থাকে। কারণ এরা কারো শরীরে হুল ফুটিয়ে তাকে এসিডের মতোই জ্বালিয়ে মারে। হয় ডেঙ্গু, নয়তো চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে অন্তত মাস ছয়েক শুয়ে শুয়ে তাকে দিন গুনতে হয়। ঘটনা হলো গিয়ে, এডিস মশারা এখন আর শান্তিতে শুয়ে একটু ঘুমোতে পারছে না। সিটি করপোরেশন থেকে কী এক আজব বস্তু বের করেছে। তাতে মেলা শব্দ হয়, মশার কানের বারোটা বাজে, কিন্তু তাতে কাজের কাজ আদতে কিছুই হয় না। কারণ ওষুধে বিস্তর ভেজাল। মশরারাও জানে, এই ভেজালের দেশে বেশি দিন বাঁচার চেয়ে শান্তিতে শুয়ে মরা ভালো। কিন্তু এই ভেজাল ওষুধের কারণে তারা ঠিকঠাক মরতেও পারছে না, অথচ আধমরা হয়ে পড়ে থাকতে হয়। মানুষের শরীরে যে জুতমতো একটু হুল ফোটাবে, তারও উপায় নেই। কারণ মশাদের নিজেদের শরীরই এখন বেজায় দুর্বল।

তবে মশারা কিন্তু মহামান্য হাইকোর্টের ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করছে। কারণ মহামান্য হাইকোর্ট মানী লোকের মান মারতে নিষেধ করেছেন। তাঁদের বক্তব্য এই, মশার ওষুধে কে ভেজাল মিশিয়েছে, বা কে বা কারা এই দুনম্বরি ওষুধ ক্রয়ের সঙ্গে জড়িত, তাদের চটজলদি খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনতে হবে।

কিন্তু মশাদের আবার আঁতে ঘা লেগেছে। কারণ, তাদের ওপর ভেজাল ওষুধ প্রয়োগ করা হয়েছে। ওদিকে মেয়র মহোদয় মানুষদের আবার বলছেন, ‘আপনারা মোটেও ভয় পাবেন না, মনোবল হারাবেন না। এডিসদের আমরা দেখছি!’

কী! কত্ত বড় সাহস দেখেছো! বলে কিনা মশাদের থেকে ভয়ের কিছু নেই! আমাদের বিষাক্ত হুল নিয়ে মশকরা! আমরা কি টাকা খেয়ে ভেজাল ওষুধ কিনি যে আমাদের ভয় না পেলেও চলে! উঁহু! এডিসের হুলে কোনো দুনম্বরি নেই। এরা গুঁতোতে জানে।

উদাহরণ হিসেবে জনৈক মশা আবার বলল, ম্যায় মশা হু! আমরা সেই মহিলা কাউন্সিলর শিরিনের মতো নই যে, স্বামী বেঁচে থাকতেও নিজেকে বিধবা দেখিয়ে ভাতা তুলে খাবো! কী ছোঁচা দেখুন! জলজ্যান্ত স্বামীটিকে খাতাকলমে অমনি মেরে ফেলল! টাকার কী লোভ দ্যাখো! 

কিন্তু আমরা মশারা মোটেও অত খাই খাই করি না। আমরা লোভাতুর নই। তবে কেসটা কি জানেন তো, লোভী মানুষের রক্ত দেখলে আর মাথা ঠিক রাখতে পারি না। কুট্টুস করে তার শরীরে অমনি হুল ফুটিয়ে দিই।

মশাদের বৈঠকে বসে একটা পুঁচকে মশা আবার ফিকফিক করে হাসছে। ‘কি রে, তুই অমন  ভোঁদড়ের মতোন হাসোছ ক্যাঁ! তোর তলপেটে কেউ সুড়সুড়ি দিছে নাকি!’

সে হাসতেই থাকে। শেষে হাসির দমক থামলে বারদুই কেশে বলল, ‘শোনেন তবে, এক মন্ত্রী নাকি কইছে চলতি মাসের ২৫ থেকে ৩১ তারিখ পর্যন্ত মশা নিধনের স্পেশাল অভিযান চালু হবে। হা হা হা! হেঁ হেঁ হেঁ!’ হাসতে হাসতে কেশে ফেলে আরো দুই অপেক্ষাকৃত তরুণ মশা। সকলে এদের ‘রসিক মশা’ বলেই জানে। এদের কারণে চাইলেও কোনো করলাখোর মশা মুখ গোমড়া করে রাখতে পারে না। 

মশাদের হাসির কারণ খুব স্পষ্ট। ২৫ থেকে ৩১ তারিখে স্পেশাল অভিযান হবে। আজ মাত্র ১৭ জুলাই। আরো আট দিন বাকি। এর মধ্যেই আমরা কম্মো কাবার করে ছাড়ব। শহরে যত লোভী ও তেলবাজ মানুষ আছে, সব কটারে হুলিয়ে কাম তামাম করে দেব। মন্ত্রীমশাই কী ভাবছেন! কারো শরীরে হুল ফোটাতে বুঝি আমাদের কোনো পারমিশান লাগে! এখানে মানুষের মতোন কোনো রেড টেপিজম বা লালফিতার কাহিনি নেই। ধরব আর হুলাব। কী বুঝলা!

মন্ত্রীর কথা শুনে মশারা খুশিতে সমানে বগল বাজায়। ওদিকে মেয়র তো ঘোষণা দিয়েই খালাস। তারা নাকি সমানে কাজ করে যাচ্ছে। এক দিনের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পোলাপান পাঠিয়ে ডেঙ্গুর সেবা প্রদান করছেন। ফোন করলেই ওষুধ। অথচ সেই ফোন ধরবার মতোন কেউ নেই।

সে যাক গে। রম্য দিয়ে শুরু করলেও শেষটা কিন্তু বড়ই মর্মন্তুদ। ছোট্ট একটি মেয়ে, বয়স খুব জোর বারো কি তেরো। হঠাৎই তার শরীর কাঁপিয়ে জ¦র এলো। তিন দিনেও উন্নতি না দেখে তাকে হাসপাতালে নিলেন তার বাবা। টেস্টে ধরা পড়ল মেয়েটির ডেঙ্গুজ¦র হয়েছে। এবার উপায়! খুব দ্রুত তার প্লাটিলেট কাউন্ট কমে যাচ্ছে। অবশ হচ্ছে শরীর। রক্তবমি হচ্ছে তার। অবস্থা দেখে ঘাবড়ে যায় বাবা। হাজার হোক, বাবা তো। ঘুষখোর বা দুনম্বরি কারবারি বলে কি তার বাপ হতে নেই! 

ডাক্তাররা সব রকম চেষ্টা করলেন। ব্যাগের পর ব্যাগ রক্ত দেয়া হয়, কিন্তু তাতেও অবস্থার কোনো উন্নতি নেই। ক্রমশ নেতিয়ে পড়ে ফুলের মতোন নিটোল নিষ্পাপ মেয়েটি। তিনি মেয়রের কাছে ছোটেন। মশার ওষুধ। মশার ওষুধ চাই স্যার। একটু ভালো ওষুধ দিন, যাতে মশারা মরবে।

এই খবর শুনে হা হা হো হো করে হাসে এডিসরা। হাসতে হাসতে বলতে গেলে একেবারে গড়িয়ে যায়। এত হাসির কারণ কী শুনি! কারণ আছে বৈ কি! জনৈক মশা বলল, মশার ওষুধেই তো ভেজাল। পানি মেশানো ওষুধ খেয়ে আমরা মরব! আর মশা মারবার এই ভেজাল ওষুধ সাপ্লাই দিয়েছে  তো ওই লোকটি, যার মেয়ে কিনা আজ ডেঙ্গুজ¦রে মরতে বসেছে।

মেয়েটি অবশেষে ডেঙ্গুজ¦রে মারা গেল। বাপ তার কেঁদেও কূল পেল না। মেয়ের মা স্বামীকে দুষছেন, তোমার কারণেই সব হয়েছে। তুমি একটা পাষ-, পাবলিকের জীবন নিয়ে খেলা করো।

তাই বলছি, মশাদের নিয়ে মোটেও মশকরা করবেন না। মহামান্য হাইকোর্টের নির্দেশে হোক বা বিবেকের তাড়নায়, সময়ে মশা মরুন। নইলে পুরো শহর মরতে বসবে।                                       

লেখক: কথাসাহিত্যিক অতিরিক্ত কমিশনার, বাংলাদেশ কাস্টমস।