মানবসম্পদ: দক্ষতা নাকি মনোবৃত্তির পরিবর্তনে?

প্রকাশ | ১৯ জুলাই ২০১৯, ০৯:৩৯

মাহবুবুর রহমান ভূঁইয়া

হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে ‘৮৫ শতাংশ চাকরি প্রার্থী চাকরি পায় তাদের মনোভাব বা দৃষ্টিভঙ্গির জন্য, আর ১৫ শতাংশ পায় সংশিষ্ট বিষয়ে সঠিক তত্ত্ব, উপাত্ত কিংবা অন্যান্য কারণে। সমীক্ষা এটাই প্রমাণ করে আপনি যে প্রতিষ্ঠানের কর্মী হোন না কেন, আপনার সাফল্যের ভিত্তি হচ্ছে আপনার  মনোভাব বা দৃষ্টিভঙ্গি। যেটা আপনার সাথে আপনার প্রতিষ্ঠানকেও অগ্রগামী করে। তাইতো বলা হয় ‘রংয়ের জন্য বেলুন আকাশে ওড়ে না, ভেতরের গ্যাস বেলুনকে আকাশে ওড়ায়’। বাহ্যিক রূপ নয়, ভেতরের রূপই প্রধান; যা মানুষকে কর্মপরিসরে উপরে উঠতে সাহায্য করে। এই রূপটির নাম হলো আমাদের ভেতরকার ‘মনোবৃত্তি’। এই মনোবৃত্তীয় সম্পদ কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান কিংবা কোনো দেশকে সফলতার দিকে ধাবিত করতে পরোক্ষ ভূমিকা পালন করে।

‘আমাদের প্রজন্মের সর্বশ্রেষ্ঠ আবিষ্কার হলো, মানুষ মনোভাবের পরিবর্তন ঘটিয়ে তার জীবনযাত্রার পরিবর্তন ঘটাতে পারে’ উইলিয়াম জেমস এর উক্তিটি আজও সত্য বটে। ইতিবাচক ‘মনোবৃত্তি’ যেমন কোনো কর্মীর মেধা ও প্রজ্ঞাকে বিকশিত করে; সাথে আলোকিত করে প্রতিষ্ঠানকেও। প্রতিষ্ঠান নিজের গুণে নয় কর্মীর গুণে হয় অলোকিত; যেমন করে আলোকিত হয় চাঁদ অপরের আলোয়।

কোনো প্রতিষ্ঠান কিংবা দেশের টেকসই উন্নয়নে, মনোবৃত্তীয় সম্পদ গাণিতিক হারে নয়, বাড়াতে হবে জ্যামিতিক হারে। ‘যদি আপনাকে একটি জাদুদ- দেওয়া হয় এবং বলা হয় যে, ব্যবসায়ে উৎপাদনশীলতা ও লাভ বাড়াবার জন্য আপনি যে জিনিসটির পরিবর্তন চান, সেই জিনিসটি কী? প্রতি উত্তরে প্রতিষ্ঠান প্রধানরা বলেন, কর্মরত ব্যক্তির মনোবৃত্তি। কর্মরত ব্যক্তির মনোভাব যদি উন্নতর হয়, তবেই প্রতিষ্ঠানের অপচয় বন্ধ হবে বা কোনো অংশে হ্রাস পাবে, প্রতিষ্ঠানের প্রতি কর্মীর আনুগত্য বাড়বে এবং ওই প্রতিষ্ঠানের কর্মতৎপরতা বেড়ে প্রতিষ্ঠান ধীরে ধীরে সফলতার পথে অগ্রগামী করবে।’ প-িত শিব খেরার এই অভিজ্ঞতাটা আজ আমরা অস্বীকার করি কীভাবে?  তাই কর্মীর ‘ইতিবাচক মনোভাবকে’ প্রতিষ্ঠানের ‘মনোবৃত্তীয় সম্পদ’ বলে আখ্যায়িত করেন। স্থায়ী সম্পদ হিসাবে ভূমি যেমন প্রতিষ্ঠানের কর্মীর মনোবৃত্তীয় সম্পদ তেমন; উভয়ের কোনো অপচয় নেই। মনোবৃত্তীয় সম্পদ ব্যবহারে বাড়ে বৈ কমে না। তবে মনে রাখতে হবে কর্মীর ‘ইতিবাচক মনোবৃত্তি’ যেমন প্রতিষ্ঠানের সম্পদ, ঠিক তেমনি ‘নেতিবাচক মনোবৃত্তি’ প্রতিষ্ঠানের জন্য দায় স্বরূপ। সত্যিই এ এক মস্ত বড় আবিষ্কার!

ডায়াগনোসিস কেন করা হয়? এই প্রশ্নটা আজ নতুন করে বোঝানোর কোনো জো নেই। মানুষ মাত্রই জানে সঠিক রোগ নির্ণয়ের জন্য কিংবা রোগের মাত্রা ও গতিবিধি পরিমাপকের জন্যই মূলত প্রয়োজন পড়ে মানব শরীরে এই  ডায়াগনোসিস। ডায়াগনোসিস রিপোর্টই প্রমাণ করে এই মানব শরীরে কোনো রোগ আছে কি না বা থাকলে কোন ধরনের। ডাক্তার রিপোর্ট ও তার অভিজ্ঞতার আলোকে রোগীর আরোগ্য লাভে চিকিৎসাপত্র দিয়ে থাকেন। কিন্তু মানুষের ‘মনোবৃত্তি’ নির্ণয়ের কোনো ডায়াগনোসিস হয় কি না বা থাকলে তার প্রায়োগিক রূপ কী তা আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে। যদিও এই বিষয়ে মনোবিজ্ঞানীরাই ভালো জানার কথা; তবুও কৌতূহলী মন গৃহত্যাগী সন্ন্যাসীর মতো কেবলই অনুসন্ধানে পথ চলে।

প্রতিষ্ঠানে এই মনোবৃত্তীয় সম্পদের অবস্থা ও অবস্থান পরিমাপকের জন্য মাঝে মাঝে কর্মরত কর্মীর ডায়াগনোসিস করাতে হয়; করাতে হয় কর্মীর মনোবৃত্তীয় সম্পদ বাড়ছে বা কমছে কিংবা কোনো রোগে আক্রান্ত কি না। কারণ মনোবৃত্তীয় সম্পদের মাত্রার ওপরই অনেকাংশে প্রতিষ্ঠানের সফলতার মাত্রা নির্ভর করে। আমরা জানি, ভেতরকার মানসিকতাই কর্মীর কর্ম স্পিহা নির্ণায়ক; যা অনেকাংশে কর্মীর আচরণে প্রকাশ পায়। আমরা তাও জানি শত প্রেষণা প্রদান করা সত্ত্বেও কর্মীর মনোবৃত্তির পরিবর্তন না হলে তা প্রতিষ্ঠানের টেকসই উন্নয়নে তেমন কোনো কাজে আসে না। তাই প্রয়োজন মনোবৃত্তির ধরণ নির্ণয় এবং তার যথাযথ চিকিৎসা পদ্ধতি জানা।

মনোবৃত্তির ভিত্তিতে কর্মী হয় চার প্রকার। যথা এক. এই শ্রেণির কর্মী নিজে কোনো কারণে প্রতিষ্ঠানের প্রতি অসন্তুষ্ট হলে অপরকেও বিবিধভাবে অন্তুষ্ট হতে উৎসাহিত করে। সব কর্মীর মধ্যে এক ধরনের গুজব ছড়িয়ে দেয়। প্রতিষ্ঠানের কিছু ভুলত্রুটি নিজের স্বার্থ হাসিলে ব্যবহার করে সহকর্মীকেও প্রতিষ্ঠানের প্রতি ক্ষেপিয়ে তুলতে ইন্ধন যোগায়। তারা শুধু প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য অর্জন বাধাগ্রস্ত করে না; বাধাগ্রস্ত করে প্রত্যেহ কাজকর্মেও। তবে তারা সবকিছু করে অতি গোপনে। তারা হলো হুইপোকা সদৃশ কর্মী। হুইপোকা যেমন কাঠ জাতীয় জিনিসের স্থায়িত্বশীলতা অতি গোপনে বিনষ্ট করে তেমনি তারাও করে প্রতিষ্ঠানের স্থায়িত্বশীলতা। এই জাতীয় কর্মীকে ডায়াগনোসিস করে বের না করার ব্যর্থতা প্রতিষ্ঠানকে অনেকাংশে পিছিয়ে দেয়। দুই. ওরা (কর্মী) অন্য সহকর্মীর সফলতায় ঈর্ষান্বিত হয়। শুধু ঈর্র্ষান্বিত হয়েই ক্ষান্ত থাকে না তার ক্ষতি করারও পরিকল্পনা করে। অযথা কর্তৃপক্ষকে তার বিরুদ্ধে বিষিয়ে তোলে। এই রোগে আক্রান্ত কর্মীর কর্মস্পৃহা এবং সৃজনশীলতা যেমন ধীরে ধীরে হ্রাস পায় তৎরূপ সহকর্মীরও  হ্রাস করতে পরোক্ষ ভূমিকা পালন করে। তারা সহকর্মীর পেশাগত উন্নতি কখনও সহজভাবে মেনে নিতে পারে না। তারা এই হীন কর্ম প্রকাশ্যে কিংবা অপ্রকাশ্যে উভয়ভাবেই করে থাকে। প-িতরা তাকে বলে কাঁকড়ার মতো মন মানসিকতার কর্মী (স্টাফ অব ক্রেব মেন্টালিটি)। খলইয়ের (স্থান বিশেষে ডুলা বা মাছ রাখার পাত্র বিশেষ, যার মুখ খোলা থাকে) ভেতর রক্ষিত কোনো কাঁকড়া যদি বেরুতে চায়, তাহলে অপর কাঁকড়া তার পা দিয়ে আটকে ধরে; যাতে এই কাঁকড়া খলই ছেড়ে বের হতে না পারে। প্রতিষ্ঠানেও এমন কিছু কর্মী থাকে যারা কাঁকড়ার মতো; সহকর্মীকে সব সময় পেছনে (খলইয়ের ভেতর) রাখতে চায়, এগোতে দেয় না। এ জাতীয় কর্মী কাঁকড়ার মনোবৃত্তি রোগে রোগাক্রান্ত।

তিন. রবার্ট ফুলটন (জড়নবৎঃ ঋঁষঃড়হ) বাষ্পীয় পোত আবিষ্কার করেছিলেন। হার্ডসন নদীতে যখন তিনি তার নতুন আবিষ্কার প্রদর্শনের আয়োজন করছিলেন তখন কিছু নিরাশবাদী ও সংশয়ী ব্যক্তি জড়ো হয়ে বলাবলি করছিল যে জাহাজ কখনও চলবে না। দেখা গেল জাহাজ চলছে এবং সেটি নদী দিয়ে এগিয়ে গেল। তখন যারা জাহাজ চলবে না বলে মন্তব্য করেছিল তারা চিৎকার করে বলতে লাগল, জাহাজ কখনও থামবে না। সবকিছুর নেতিবাচক দিক দেখার কী আশ্চর্য মানসিকতা! ঠিক তৎরূপ আমাদের কোনো সংস্থায়ও কিছু কর্মী থাকে যারা সংস্থার নতুন যেকোনো সিদ্ধান্ত, ধারণা, নিয়মনীতি কিংবা কৌশল প্রয়োগ করতে কর্তৃপক্ষ সচেষ্ট হয় তখনই সমালোচনা শুরু করে দেয়। সবকিছুর মাঝে তারা এক ধরনের নেতিবাচকতার গন্ধ পায়। তাদের এই রোগ ক্যানসার সদৃশ। কর্মী নিজেও বুঝে না সেটা তার এবং প্রতিষ্ঠানের জন্য কতটুকু ক্ষতিকর। ক্যানসার সদৃশ এই নেতিবাচক মনোবৃত্তি যখন কর্মীর সমস্ত চিন্তা চেতনায় ছড়িয়ে পড়ে তখন আর করার কিছুই থাকে না। পরবর্তীতে উপলব্ধির মাত্রা বাড়লে পরিত্রাণের মাত্রা বাড়ে না। এই ধরনের কর্মী প্রতিষ্ঠানের অগ্রগতি প্রচ- রকমভাবে  বাধাগ্রস্ত করে। কর্তৃপক্ষ যত দ্রুত তাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে; ততই প্রতিষ্ঠানের মঙ্গল।

চার. তারা সবকিছুর মাঝেই ইতিবাচক দিকটা খুঁজতে চেষ্টা করে। তাদের ভেতর ও বাহির উভয়ই সমান। সত্যকে সত্য ও মিথ্যেকে মিথ্যে বলে। ভালো কাজে উৎসাহ প্রদান, মন্দ কাজে নিরুৎসাহিত করে। এরা প্রতিষ্ঠানের প্রদীপসদৃশ। প্রদীপ যেমন নিজেকে নিঃস্ব করে অপরকে আলোকিত করে তেমনি তারাও। তাদের টেস্ট রিপোর্টে কোনো ধরনের রোগের লক্ষণ নেই। এই শ্রেণির লোকেরই প্রতিষ্ঠানে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। এই জাতীয় কর্মী প্রতিষ্ঠানের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারা যেমন ত্বরান্নিত করে, সাথে পরোক্ষভাবে ত্বরান্নিত করে আমাদের জাতীয় অর্থনীতির ধারাও। এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে একজন মানুষ হিসেবে আমার বস্তুগত সম্পত্তি যতটুকু বৃদ্ধি পেয়েছে;  একজন কর্মী হিসেবে প্রতিষ্ঠানের কাছে আমার মনোবৃত্তীয় সম্পদ কি ততটুকু বৃদ্ধি পেয়েছে? 

পুনশ্চ: প্রতিষ্ঠানের জনবলকে মানবসম্পদে রূপান্তরে শুধু দক্ষতার দিকটি নয় মনোবৃত্তিগত দিকটিও সমানভাবে বিবেচনায় প্রণীধানযোগ্য। 

লেখক: প্রশিক্ষক ও সমাজকর্মী