প্রিয়া সাহা ইজ নট ইকুয়াল টু বাংলাদেশ

প্রকাশ | ২০ জুলাই ২০১৯, ২০:০০

মনদীপ ঘরাই

ইউটিউবে যতবার ভিডিওটা দেখছি, ততবার মনে প্রশ্ন জেগেছে, কোনো কল্পিত বাংলাদেশের গল্প শুনছি মনে হয় প্রিয়া সাহার কাছ থেকে। কারণ, আমি যে বাংলাদেশে জন্মেছি, বড় হয়েছি, পড়াশোনা করেছি, সরকারি চাকরি করছি কিংবা এখন যে বাংলাদেশে বসে লিখছি, সে বাংলাদেশ প্রিয়া সাহার বলা বাংলাদেশ নয়।

আমি সনাতন ধর্মের অনুসারী। সবাই যাকে হিন্দু ধর্ম বলেই জানে। ছোটবেলা থেকে বেড়ে ওঠার পর একটা সময় সংখ্যালঘু কথাটার সাথে পরিচিত হয়েছিলাম। তাও তো অনেক অনেক বছর আগে।

প্রথমদিকে ভাবতাম, লঘু আর গুরু তো কেবল অঙ্কে দেখেছি। জীবনে এ শব্দ এলো কেন? বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে কি আমার কোনো ঘাটতি থেকে গেল? শব্দটা কার আবিষ্কার জানি না, তবে দেশকে ভালোবাসা প্রতিটি মানুষের জন্য খুব মন খারাপের একটা শব্দ। পরে বুঝতে শিখেছি, এটা কোনো শব্দ না, একটা মানসিকতা।

যে মানসিকতা থেকে গত এক দশকে বাংলাদেশ বের হয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে সদাশয় সরকারের আন্তরিক উদ্যোগে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, বলছি কী? চিন্তা করেই বলছি। একটা দেশে ঘটনা-দুর্ঘটনা লেগে থাকবেই। বিচ্ছিন্ন অনেক কিছু মন খারাপ করেও দিতে পারে। কিন্তু, ‘পুরো দেশে সংখ্যালঘুরা ভালো নেই, নির্যাতনের শিকার’-আপনাকে কে বললো প্রিয়া সাহা?

আমার বাবা, দুই মামা, দাদু, মেশো, আপন বোন, শ্বশুর, পিশা, পিশি, ভাই সরকারি চাকরিতে আছে। আমি নিজেও আছি। প্রশ্ন করতে পারেন, গ্রামের পরিস্থিতি কী? গ্রামে থাকা কাকাদের সবাই ব্যবসায়ী। কই আমাদের তো হিন্দুধর্মের অনুসারী হওয়ার জন্য কোনো বৈষম্যের শিকার হতে হয়নি। আর আপনার নিজের পরিবারের দিকে তাকালেই তো বোঝা যায়, যার স্বামী দুদকের উপ-পরিচালক, সন্তান আমেরিকাতে পড়োশোনা করছে, নিজে এনজিও চালাচ্ছেন তিনি খারাপটা আছেন কোথায়? যে বাংলাদেশে আমরা সবাই মিলে শ্বাস নিচ্ছি, সে বাতাসটাকে অসত্য দিয়ে দূষণ করাটা দোষের।

তবে, চিন্তায় আনতে হবে একদম প্রত্যন্ত অঞ্চলের সনাতন কিংবা খ্রিস্টান, বৌদ্ধ ধর্মের মানুষেরা কেমন আছেন? একেবারে যে ছবির মতো সবকিছু গোছানো, সে দাবি পৃথিবীর কোনো দেশই করতে পারে না। ওই যে বললাম, সেটা মানসিকতার প্রশ্ন। মন্দিরের প্রতিমা ভাঙচুর, রাতের আঁধারে আক্রমণ, বিষোদাগারমূলক বাক্যবাণ এগুলো পুরোপুরি নির্মূল অনেকটা কাল্পনিক।

তবে, বর্তমান বাংলাদেশের যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি আছে, তা থেকে পুরো বিশ্ব শিক্ষা নিতে পারে; অন্তত আমেরিকা তো পারেই! কথাটা আমার না। বাংলাদেশে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত নিজেই বলেছেন, তারা বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি দেখে শিখতে পারেন। এই আলোচনার মাঝে কিছু অপ্রিয় সত্য টেনে আনি। যেকোনো ঘটনার সাথে ‘সংখ্যালঘু’ শব্দটার মিশ্রণ মাঝে মাঝে উদ্দেশ্যমূলকও হয়ে যায়।

পারিবারিক কোন্দল, জমিজমার সমস্যা, স্বার্থের দ্বন্দ¦ থেকে দুপক্ষের রেষারেষি হলো। এর মধ্যে এক পক্ষ সংখ্যালঘু হলেই যেন আমরা বলে না বসি, ‘সংখ্যালঘু নির্যাতন’ হয়েছে। ‘সংখ্যালঘু নির্যাতন’ বিষয়টা ব্যাপক অর্থের। শুধু এবং শুধুমাত্র ধর্মবিশ্বাসের কারণে কোনো নির্যাতনের শিকার হলে সে ক্ষেত্রেই ব্যবহার করাটা সমীচীন। কোনো ব্যক্তিগত ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রভাবিত করতে যেয়ে যেন এই শব্দটি যেন মুখে না আসে।

সম্প্রীতির বাংলাদেশকে ব্যক্তিগত কারণে কলুষিত করবেন না। একজন হিন্দু হয়েই বলছি। পূজা-পার্বন যে উৎসবমুখরভাবে পালন হয়, তা অনেক দেশের জন্য ঈর্ষার। চাকরিতে সুযোগ, সমাজে অবস্থান, সাফল্য এ ব্যাপারগুলো ব্যক্তিগত প্রচেষ্টার ওপর নির্ভর করে। যেকোনো ব্যর্থতাকেই বৈষম্য বলে চালিয়ে দেয়াটা উচিত না। তবুও জীবনে চড়াই-উতরাই, ঘাত-প্রতিঘাত থাকবেই। এর মাঝেই বলতে চাই আমি সুখি একজন বাংলাদেশি। সংখ্যালঘু বা সংখ্যাগুরু নই। প্রিয়া সাহার বক্তব্য ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করছি। আমাদের বাংলাদেশ। আমরা বাংলাদেশের। আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।

লেখক: সিনিয়র সহকারী সচিব (গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার)