গণপিটুনির বিচার বিরল

বোরহান উদ্দিন ও সিরাজুম সালেকীন
| আপডেট : ২২ জুলাই ২০১৯, ০৮:৫৩ | প্রকাশিত : ২২ জুলাই ২০১৯, ০৮:০৬

পদ্মা সেতু নিয়ে ছড়ানো উদ্ভট তথ্যের মধ্যে একের পর এক গণপিটুনির ঘটনা ঘটছে। এর মধ্যে এমন একটি তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, যাকে এই ধরনের ঘটনার কারণ হিসেবে দেখছেন সমাজবিজ্ঞানী আর আইনজীবীরা। গণপিটুনিতে বিপুলসংখ্যক মানুষ নিহত হলেও বিচারের উদাহরণ নেই বললেই চলে। আর পুলিশ শত শত মানুষের বিরুদ্ধে মামলা করলেও অপরাধীদের শনাক্ত করতে পারে কমই।

সাভারের আমিন বাজারে শবেবরাতের রাতে ডাকাত বলে ছয় কিশোরকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা দেশজুড়ে আলোচিত হয়েছিল। ওই ঘটনায় মামলাও হয়েছে। বিচারকাজও চলছে। তবে ২০১১ সালে শুরু হওয়া মামলাটি এখনো চলছে। কবে নাগাদ নিষ্পত্তি হবে তাও বলা মুশকিল।

একই বছর ২৭ জুলাই নোয়াখালীর কোম্পানিগঞ্জে ডাকাত সন্দেহে পুলিশের গাড়ি থেকে নামিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয় শামছুদ্দিন মিলনকে। তখনো দেশে সেভাবে স্মার্টফোনের বিকাশ হয়নি। তবে এই ঘটনাটির ভিডিও সে সময় ফেসবুকে ছড়ায়। সেখানে কারা কারা পিটিয়েছে সেটা ছিল স্পষ্ট। তবু আট বছরে মামলাটি তদন্তেই আটকে আছে।

গণপিটুনিতে মৃত্যুর বিষয়টি ঘটে বছরজুড়েই। আর সারা বছরের পরিসংখ্যান রীতিমতো শিউরে ওঠার মতো। এসব ঘটনায় মামলা হয়, কিন্তু তাতে সুনির্দিষ্ট আসামি থাকে না। চারশ, পাঁচশ, ছয়শ থেকে শুরু করে এক থেকে দেড় হাজার আসামিও থাকে। আর এত আসামিকে কখনো শনাক্ত করা যায় না। তবে নানা সময় পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে, গ্রেপ্তার দেখিয়ে টাকা আদায় চেষ্টার।

আর কোনো মামলার প্রতিবেদন আদালতে গেলে সাক্ষী পাওয়া যায় না সেভাবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারাও আদালতে আসতে সেভাবে আগ্রহী হন না। আর বিচার চলতে থাকে বছরের পর বছর ধরে।

সম্প্রতি দেশজুড়ে আলোচিত ও আতঙ্কের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘ছেলেধরা’ সন্দেহে গণপিটুনি। ফেসবুক ও ইউটিউবে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, পদ্মা সেতু নির্মাণে এক লাখ মানুষের মাথা লাগবে। আর সারা দেশে ৪২টি দল কাজ করছে। তারা প্রধানত শিশুদের মাথা সংগ্রহ করবে।

সরকারের পক্ষ থেকে এই প্রচারে কান না দেয়ার অনুরোধ করা হয়েছে। পুলিশ বলছে, যারা গুজব ছড়ায়, তাদের বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। গ্রেপ্তার হয়েছে ১০ জনের বেশি। কিন্তু গুজব থামছে না। উল্টো প্রাণঘাতী হয়ে উঠছে তা।

গত দুই দিনে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে পাঁচজনতে। এর আগেও হত্যা করা হয়েছে একজনকে। প্রতিটি ঘটনায় স্থানীয়রা ভুক্তভোগীকে চিনতে পারছিল না। কোথাও কোথাও শিশুর পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন ভুক্তভোগী, কোথাও শিশুকে আদর করতে গিয়েছিলেন।

বিভিন্ন গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, গত দুই সপ্তাহে সারা দেশে ২১টি গণপিটুনির ঘটনা ঘটে। অন্তত পাঁচজনের প্রাণহানি ছাড়াও হয়েছেন ২২ জন। প্রতিদিন বাড়ছে গণপিটুনির ঘটনা। এর মধ্যে শনিবার বাড্ডায় দুই সন্তানের জননীকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ছুঁয়ে গেছে জাতিকে। দুটি সন্তান রেখে গেছেন ওই নারী। তার তিন বছরের শিশুর ‘আমার মা নেই’ বক্তব্য কাঁদিয়েছে দূরের মানুষকেও।

সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, এই ধরনের ঘটনা থেকে উত্তরণের জন্য বেশি বেশি প্রচারণা, জনমত গঠন করতে হবে। মানুষের মধ্যে নৈতিকতাবোধ জাগ্রত করতে হবে।

আইনজ্ঞরা বলছেন, অভিজ্ঞ কর্মকর্তাকে দিয়ে তদন্ত, দ্রুত বিচার এবং শাস্তি নিশ্চিত করা গেলে মানুষের মধ্যে এই বোধ জাগ্রত হবে যে, দল বেঁধে কিছু করলেও শাস্তি পেতে হবে। সেটা হয় না বললেই কেউ ভয় পায় না। আর দলবদ্ধ হয়ে পিটুনি শুরু করলে তারা নিজেদেরও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। আর এক সঙ্গে বহু মানুষ পেটালে মানুষের পক্ষে বেঁচে থাকা কঠিন।

গণপিটুনিতে বছরে কত জনকে হত্যা করা হয়, সে বিষয়ে পুলিশের কাছে পরিসংখ্যান পাওয়া কঠিন। আর মানবাধিকার সংস্থাগুলোর কাছেও তাৎক্ষণিক হালনাগাদ হিসাব পাওয়া যায় না।

তবে মানবাধিকার সংস্থা অধিকার এবং আইন ও সালিশকেন্দ্রের তথ্যে গণমাধ্যমে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে ২০০৯ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত মৃত্যুর একটি হিসাব পাওয়া যায়। এই ছয় বছরে ৮৩৫ জনের মৃত্যুর খবর এসেছে গণমাধ্যমে।

এর মধ্যে ২০০৯ সালে ১২৭, ২০১০ সালে ১৭৪, ২০১১ সালে ১৬১, ২০১২ সালে ১৩২, ২০১৩ সালে ১২৫ এবং ২০১৪ সালে ১১৬ জনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।

এসব ঘটনায় কোনো একটির মামলার রায় প্রকাশ হয়েছে, এমন উদাহরণ পাওয়া যায়নি।

২০১৩ সালের ৩১ আগস্ট নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার জাহাজমার ইউনিয়নের হিলটন বাজার এলাকায় গণপিটুনিতে পাঁচজন নিহত হয়। ২০১৬ সালের ১১ মার্চ একই উপজেলার চেয়ারম্যান ঘাট এলাকায় ডাকাত সন্দেহে চারজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।

ঘটনা দুটির অগ্রগতি নিয়ে হাতিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল খায়ের ঢাকা টাইমসকে জানান, ‘মামলার চার্জশিট হয়ে গেছে। এখন সেটা আদালতে বিচারাধীন।’

নোয়াখালীর আলোচিত মিলন হত্যার ভিডিও প্রকাশ হলেও আট বছরেও তদন্ত শেষ হয়নি। বিচারের অপেক্ষায় দিন গুনতে গুনতে মারা গিয়েছেন কিশোরের বাবা। তদন্ত কর্মকর্তা বলছেন, ‘দ্রুতই মামলার প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে।’

কোম্পানীগঞ্জের চর কাঁকড়া ইউনিয়নের বিক্ষুদ্ধ লোকজন ২০১১ সালের ২৭ জুলাই ছয় ডাকাতকে পিটিয়ে হত্যা করে। কিশোর মিলন ওই দিন সকালে চর ফকিরা গ্রামের বাড়ি থেকে উপজেলা ফিরছিলেন। পথে চর কাঁকড়া একাডেমি উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে একদল লোক তাকে ডাকাত সন্দেহে আটক করে। তবে সে ডাকাত নয় এটা নিশ্চিত হয়ে তাকে পুলিশের গাড়িতে তুলে দেওয়া হয়।

পথে টেকের বাজারে আসলে পুলিশের উপস্থিতিতেই উত্তেজিত জনতা মিলনকে গাড়ি থেকে নামিয়ে নৃশংসভাবে পিটিয়ে হত্যা করে। এর কয়েক দিন পর মোবাইল ফোনে ধারণ করা এই ঘটনার ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে তা সাড়া ফেলে।

এই ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলার জন্য চার পুলিশ সদস্যকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করা হয়। ওই ভিডিও থেকেই গণপিটুনিতে অংশ নেওয়া ২৭ জনকে শনাক্ত করা হয়। ওই ২৭ জন ও চার পুলিশ সদস্যকে আসামি করে মামলা করা হয়। কিন্তু কারো কোনো শাস্তি হয়নি।

২০১১ সালের ৭ জুলাই শবেবরাতের রাতে আমিন বাজারের বড়দেশী গ্রামসংলগ্ন কেবলার চরে বেড়াতে যান ঢাকার সাত ছাত্র। ডাকাত বলে তাদের ছয়জনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।

ওই ঘটনার পর নিহতদের বিরুদ্ধে ডাকাতির অভিযোগে মামলা করেন স্থানীয় বালু ব্যবসায়ী আবদুল মালেক। পুলিশ বাদী হয়ে অজ্ঞাত গ্রামবাসীকে আসামি করে আরেকটি মামলা করে।

পরে বিচার বিভাগীয় তদন্তে নিহত ছাত্ররা নিরপরাধ প্রমাণ হন। আর পুলিশের করা মামলাটি তদন্ত শেষে ২০১৩ সালের ৭ জানুয়ারি র‌্যাব কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিন আহমেদ আদালতে প্রতিবেদন দেন।

২০১৩ সালের ৮ জুলাই ৬০ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু করে আদালত। হত্যা মামলার আসামিদের মধ্যে ছয়জন পলাতক, একজন কারাগারে, ৫২ জন জামিনে এবং এক আসামি মারা গেছেন। ১৪ জন ঘটনায় নিজেদের সম্পৃক্ততা স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। কিন্তু এখনো সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়নি।

২০১৫ সালের ১০ ডিসেম্বর নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলায় ডাকাত সন্দেহে আটজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এই ঘটনায় থানায় দুটি মামলা হয় অজ্ঞাত ১২০০ আসামির বিরুদ্ধে। কিন্তু মামলার অগ্রগতি জানাতে পারেনি পুলিশ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক খায়রুল ইসলাম চৌধুরী ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘শুধু আইনকানুন দিয়েই সমাজ চলে না, সমাজের একটি মূল্যবোধ থাকে। বিচারহীনতা, নৈতিক অবক্ষয়সহ নানা কারণে সমাজে এই ধরনের সমস্যার তৈরি হচ্ছে। গণপিটুনির বিষয়টি আগেও ছিল। তবে এখন একটা গুজবকে কেন্দ্র করে এটা বেড়েছে। নামকাওয়াস্তে প্রজ্ঞাপন বা গুজবে কান না দেয়ার কথা বললে সমস্যা কমবে না। তাই জোর দিতে হবে জনমত গঠনে। বিষয়টিকে সিরিয়াসলি নিয়ে প্রচার প্রচারণা চালাতে হবে। ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমে প্রচার চালাতে হবে।’

বিচারে দীর্ঘসূত্রতা কমানোর তাগিদও দিয়েছেন এই সমাজবিজ্ঞানী। বলেন, ‘এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকানো বড় উদ্দেশ্য হতে হবে। যদি বিচার শেষ হতে দীর্ঘদিন লেগে যায় বা বিচারই না হয় তাহলে পরোক্ষভাবে হলেও যারা এই ঘটনাগুলো ঘটাচ্ছে তারা কেন উৎসাহিত হবে না?’

কেন বিচারে দীর্ঘসূত্রতা? আইনজীবী এহসানুল হক সমাজী ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘গণপিটুনির মামলা প্রমাণ করাটা কঠিন। যেহেতু ঘটনার পর অজ্ঞাত আসামি দেয়া হয় অসংখ্য মানুষকে, তারমধ্যে অনেককে ধরলেও পরে অভিযোগ প্রমাণ না হওয়ায় ছেড়ে দেওয়া হয়। তাই অভিজ্ঞ তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়াটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।’

মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলছেন, ‘কাউকে অপরাধী হিসেবে সন্দেহ হলে তাকে পুলিশে দিতে হবে। নিজের হাতে আইন তুলে নিয়ে নির্যাতন করা ঠিক না। এই সচেতনতাটা মানুষের মধ্যে জাগাতে হবে, মানুষকে বোঝাতে হবে।’

‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও সক্রিয় হতে হবে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত আছে সেটা দৃশ্যমান করতে হবে। এতে সবাই যাতে বোঝে আমার দেশে আইন আছে কেউ অপরাধ করলে পার পাওয়া যায় না। এসব ভয় থাকলে কেউ আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার সাহস দেখাবে না।’

শতশত এমনকি হাজার লোকের নামে মামলাও ঠিক নয় বলে মনে করেন মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান। বলেন, ‘এত লোককে পুলিশ ধরবে, তাদের কাছ থেকে স্টেটমেন্ট নেবে? এসব কারণে আসল অপরাধী পার পেয়ে যায়। এটার জন্য নজর রাখতে হবে।’

‘পুলিশ কত লোককে আসামি করছে আর দিন শেষে কত লোকের সাজা নিশ্চিত হচ্ছে সেটার একটা পরিসংখ্যান নিয়ে পুলিশের ঊর্ধ্বতনদের কাজ করা উচিত।’

ঢাকাটাইমস/২২জুলাই/এমআর

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিশেষ প্রতিবেদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :