দায় আছে ঐক্য পরিষদের: সঠিক সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রীর

প্রকাশ | ২২ জুলাই ২০১৯, ১২:৪০ | আপডেট: ২২ জুলাই ২০১৯, ১২:৪৫

আলম রায়হান

কুলাঙ্গার প্রিয়া সাহার ন্যাক্কারজনক ভূমিকায় অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন মহলে। বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক প্রিয়া সাহা মার্কিন প্রেসিডেন্টের কাছে অভিযোগ করেছেন, ‘বাংলাদেশে ৩ কোটি ৭০ লাখ হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান নিখোঁজ রয়েছেন।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘দয়া করে আমাদের লোকজনকে সহায়তা করুন’।

গত ১৭ জুলাই হোয়াইট হাউজে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার বিশ্বের ১৯টি দেশের ২৭ জনের সঙ্গে কথা বলেন ট্রাম্প। এই ২৭ জনের মধ্যে ছিলেন বাংলাদেশি প্রিয়া সাহা ও কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে যাওয়া এক রোহিঙ্গা নাগরিক। এই কথোপকথনের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। সেখানে প্রিয়া সাহাকে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের অবস্থা সম্পর্কে ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে অভিযোগ করতে দেখা গেছে।

এ ঘটনা বিশ্বব্যাপী প্রচারিত হয়েছে। চরম ক্ষোভ তৈরি হয়েছে বাংলাদেশে। অনেকেই আবেগী প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন। কেউ দিয়েছেন সতর্ক প্রতিক্রিয়া। কেউ দেখছেন এর পেছনে গভীর ষড়যন্ত্র থাকার আশঙ্কা। এ ঘটনায় বিভিন্ন মহল থেকে প্রতিক্রিয়া এসেছে। যারা প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন তারা সকলেই কোনো না কোনো মাত্রায় প্রিয়া সাহার বক্তব্যেও নিন্দা জানিয়েছেন। কিন্তু একমাত্র ব্যতিক্রম হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত। তিনি বিষয়টি ইনিয়ে বিনিয়ে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করছেন লাগাতারভাবে। এমনকি পাকিস্তান আমল প্রসঙ্গ টেনে প্রিয়া সাহার বক্তব্য প্রকারন্তরে সমর্থন করেছেন বলে ধারণা কারও কারও। এবং সকলেই নিশ্চিত, রানা দাশগুপ্ত সতর্কভাবে প্রিয়া সাহা প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করেছেন। যদিও তিনি এবং তার সংগঠন হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ দায় এড়াতে পারে না। এনমটাই অভিমত পর্যবেক্ষক মহলের।

বাংলাদেশ সম্পর্কে প্রিয়া সাহার ভয়ঙ্কর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সর্বমহলে যখন চাপা ক্ষেভের সৃষ্টি হয়েছে তখন হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত বলেছেন, “প্রিয়া সাহা হোয়াইট হাউজে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে বাংলাদেশে ‘সংখ্যালঘু নিপীড়নের’ যে অভিযোগ করেছেন তা একান্তই তার নিজস্ব বক্তব্য।” কেবল প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাওয়া নয়, প্রিয়া সাহার বক্তব্যের কোনোরকম নিন্দাও করেননি রানা দাশগুপ্ত। অথচ সম্প্রীতি বাংলাদেশের আহ্বায়ক পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পক্ষ থেকে পাঠানো গণমাধ্যমে এক বিবৃতিতে বলা হয়, “আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে বাংলাদেশের প্রিয়া সাহা যেসব কথা বলেছেন, তা বাংলাদেশের হাজার বছরের চেতনা বিরোধী এবং মুক্তিযুদ্ধের দর্শনকে অস্বীকার ও অবজ্ঞা করার সামিল।”

প্রশ্ন হচ্ছে, সম্প্রীতি বাংলাদেশের আহ্বায়ক পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় যা পারেন তা কেন পারেন না বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত? তা হলে তিনি বা তার সংগঠন কি অন্য কোথাও দায়বদ্ধ!

হোয়াইট হাউজে প্রিয়া সাহার দেয়া বক্তব্যে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। তবে এ ধরনের বক্তব্য এই প্রথম- এটি মনে করার কোনো কারণ নেই। বরং দেশে-বিদেশে এর চেয়েও আপত্তিকর অসত্য বক্তব্য দেবার অনেক উদাহরণ আছে। এমনকি পিলে চমকানো ভয়াবহ বক্তব্য দেওয়ার উদাহরণও আছে।

২০০২ সালের জুলাই মাসে নিউইয়র্কে দেয়া হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের নেতা শ্রীকান্ত মুখার্জী ভয়ানক বক্তব্য রেখেছেন। নিকোলাস শিকদারের সভাপতিত্বে কথিত প্রমাণ্যাচিত্র সম্বলিত একটি পুস্তিকার প্রকাশনা উৎসবে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের নেতা শ্রীকান্ত মুখার্জী যে বক্তব্য দিয়েছেন তা ২৪ জুলাই দৈনিক ইত্তেফাকে ছাপা হয়েছে। সেই বক্তব্য এতোই ভয়ানক ও অসত্য যা উদ্ধৃত করা সমীচীন নয় বলে মনে করি।

কেবল উল্লেখিত ঘটনা নয়, দেশে-বিদেশে অসত্য এবং উস্কানিমূলক বক্তব্য দেয়া এবং লেখালেখির অনেক উদাহরণ আছে। এ ক্ষেত্রে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের মতো একাধিক সংগঠন যেমন আছে, তেমনই আছেন অধ্যাপক আবুল বারাকাতের মতো রহস্যজনক লোকেরাও। একটু খেয়াল করলেই বোঝা যাবে, বিভিন্ন মহল থেকে বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জোর অপচেষ্টা চলছে বহু বছর ধরে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শিতার কারণে এই অপপ্রচার হালে পানি পাচ্ছে না বলে মনে করেন পর্যবেক্ষক মহল। এ মহলটির মতে এবার প্রিয়া সাহার বেলায়ও যথাযথ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ২১ জুলাই দুপুরে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে মেট্রোরেল সংক্রান্ত এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের বলেছেন, প্রিয়া সাহার বিরুদ্ধে এখনই রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করা হবে না। তিনি জানান, সবার আগে প্রিয়া সাহার বক্তব্য শুনবে সরকার। এরপর তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রধানমন্ত্রীর বরাত দিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কাদের বলেন, প্রিয়াকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হবে। তার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাতে কথা বলার বিষয়টি এবং এর পেছনে কোনো ষড়যন্ত্র আছে কি না সেসব বিষয় এখনো পরিষ্কার নয়।

পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন, প্রিয়া সাহার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন তার ফলে একটি বড় ধরনের অপপ্রচারের কবল থেকে রেহাই পেলো বাংলাদেশ। কুলাঙ্গার প্রিয়া সাহার বহুল নিন্দিত বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে এখনই রাষ্ট্র বা সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হলে সেটাকে বড় রকমের একটি ইস্যু করার আশঙ্কা ছিল। এমনটি হলে প্রিয়া সাহার অলীক অভিযোগ এক ধরনের ভিত্তি পেয়ে যাবার আশঙ্কা তৈরি হতে পারত। কিন্তু এ ধরনের কোনো সুযোগ তৈরি হতে দেননি বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা।

এদিকে প্রিয়া সাহার কারণে জনমনে যাতে কোনো তুষের আগুনের সূচনা না হয় সে বিষয়েও সরকার সতর্ক রয়েছে বলেও অবস্থাদৃষ্টে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা। এ ব্যাপারে ২১ জুলাই তথ্যমন্ত্রী ড. হাসান মাহমুদের বক্তব্য গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। তথ্যমন্ত্রী সচিবালয়ে সমসাময়িক বিষয় নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন,  প্রিয়া সাহার বক্তব্য দেশদ্রোহী। অবশ্যই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেন, প্রিয়া সাহার বক্তব্যটি দেশের বিরুদ্ধাচরণ ছাড়া আর কিছু না। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে কিভাবে গেলেন, কেনো এই ধরনের বক্তব্যে দিলেন, তার সুষ্ঠু তদন্তের প্রয়োজন রয়েছে বলে মন্তব্য করেন তথ্যমন্ত্রী। তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ আরও বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশে শান্তি বিরাজ করছে। এটা বিশ্বস্বীকৃত সত্য। নরেন্দ্র মোদিও আমাদের দেশের প্রশংসা করেছেন। প্রিয়া সাহার বক্তব্য দেশদ্রোহিতা, অবশ্যই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। একইসাথে কারা তাকে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে সেখানে পাঠিয়েছেন, সে বিষয়টিও খতিয়ে দেখা হবে। তাছাড়া প্রিয়া সাহার স্বামী বিদেশে চাকরি করছেন, এ বিষয়ে তার স্বামীর কোনো সম্পৃক্ততা আছে কি না- সেটাও খতিয়ে দেখা উচিত।

প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় বলেছেন, ‘বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিরোধী যে বক্তব্য প্রিয়া সাহা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সামনে রেখেছেন তার পেছনে ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের দূরভিসন্ধি রয়েছে। তারাই প্রিয়া সাহাকে বাছাই করেছেন, কারণ তারা জানতেন এমন জঘন্য মন্তব্য তাকে দিয়েই করানো সম্ভব।’ ২১ জুলাই বাংলাদেশ সময় দুপুর ১টায় ফেসবুকে বাংলায় দেওয়া একটি পোস্টে এ কথা বলেন সজিব ওয়াজেদ জয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে প্রিয়া সাহার ভয়ংকর ও মিথ্যা দাবি। এতো মানুষ গুম হলো সবার অজান্তে? ৩ কোটি ৭০ লক্ষ মানুষ গায়েব হলো কোনো তথ্য প্রমাণ ছাড়াই?

প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা এবং তথ্যমন্ত্রীর উল্লেখিত বক্তব্য বেশ প্রশংসিত হয়েছে বিভিন্ন মহলে। এ প্রসঙ্গে একটি বিষয় গভীরভাবে বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন। তা হচ্ছে, কোন দেশের জনগোষ্ঠির হৃদয়ের গভীরে লালিত অনুভূতিতে বারবার আঘাত হানা হলে তা আখেরে মোটেই সুফল বয়ে আনতে পারে না। কাজেই সমস্যা যারা সৃষ্টি করে, যারা লালন করে তাদের ব্যাপারে রাষ্ট্র-সমাজ-সরকার, সকলেরই সতর্ক থাকা প্রয়োজন। আর এ ক্ষেত্রে আপোষ বা গোজামিল এক পর্যায়ে কার্যকারিতা হারাতে পারে। যেমন হারিয়েছে মশার বিরুদ্ধে সিটি কর্পোরেশন ছিটানো অসুধের কার্যকারিতা।

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়