হজ নিয়ে বাণিজ্য বেসাতি

মাসুদ কামাল
 | প্রকাশিত : ২২ জুলাই ২০১৯, ২২:০০

এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক যে, প্রতিবারই হজ নিয়ে আমাদের দেশে নানা অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। হজের সময়ে যারা বিমানবন্দর কিংবা তার বিপরীতে অবস্থিত হাজিক্যাম্পে এক-আধবারের জন্য ঢু মারেন, তারা এই অভিযোগগুলো শুনতে পান। হজযাত্রী যারা, তারা সাধারণত কোনো অভিযোগ করতে চান না। শত প্রতিকূল পরিস্থিতিকেও তারা মেনে নেন। কিন্তু অভিযোগ উচ্চারিত হয় তাদের আত্মীয়স্বজনের মুখে। এসব অভিযোগের বেশির ভাগই থাকে এজেন্সিগুলোর বিরুদ্ধে। কারা ভিসা নিয়ে ঘাপলা করছে, কাদের কারণে ফ্লাইট পাওয়া যাচ্ছে না, ইত্যাদি। সরকার অবশ্য প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নেন বলে শোনা যায়। প্রতিবারই কিছু এজেন্সির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়, কিছু এজেন্সিকে কালোতালিকাভুক্ত পর্যন্ত করা হয়। কিন্তু বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, এই যে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা, এর কোনোই ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না পরের বছরের হজ ব্যবস্থাপনায়। দুর্ভোগের এই ধারা চলে আসছে বছরের পর বছর ধরে। লম্বা সময় ধরে চলে আসছে বলেই হয়তো এই অনিয়মই এখন নিয়মে পরিণত হয়েছে।

এসব দুর্ভোগ আর অনিয়ম নিয়ে হইচই যে একেবারে হয় না, তা নয়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, মানুষ তো আর প্রতিবছর হজে যান না। ফলে যারা দুর্ভোগের শিকার হন, তারা হজ করে ফেরার পর এ নিয়ে আর অভিযোগ করেন না। ফলে দুষ্ট লোকগুলো পার পেয়ে যায় প্রতিবারই।

একই অবস্থা কিন্তু সরকারি পর্যায়েও। কয়েক বছর ধরেই একটা অভিযোগ শুনছিÑ হজ ফ্লাইটে ভাড়া এত বেশি হবে কেন? অন্য সময় ৪৫ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকার মধ্যে সৌদি আরবের রিটার্ন টিকিট পাওয়া যায়। কিন্তু হজ করতে গেলেই ভাড়া বেড়ে লাখ ছাড়িয়ে যায়। এবার হয়েছে এক লাখ ২৮ হাজার টাকা। গেল বার এটা ছিল এক লাখ ৩৮ হাজার। বাংলাদেশ বিমান অবশ্য হজের জন্য স্পেশাল ফ্লাইটের ব্যবস্থা করে, কিন্তু সাউদিয়ার ক্ষেত্রে এমনও দেখা গেছেÑ একই এয়ারক্রাফটে পাশাপাশি দু’জন যাচ্ছে এরকম আকাশ-পাতাল পার্থক্যের ভাড়ায়। বলা হয়ে থাকে, সেই ভাড়াটাও নাকি আমাদের সরকারের কারণেই হয়েছে। কিন্তু হজ তো কোনো বিনোদন কর্ম নয়। ধর্মীয় বিষয়ে মানুষকে উৎসাহিত করতে বরং হজের বিমানভাড়া কম হতে পারতো। নাকি এ সময়ে যে বিপুল অপচয় হয় সেটা পুষিয়ে নিতেই সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষের কাছ থেকে এভাবে বাড়তি অর্থ আদায়?

অপচয়ের প্রসঙ্গটি এলো কেন? এটি এলো সরকারি খরচে বিপুলসংখ্যক মানুষকে হজে পাঠানোর যে হুজুগ দেখা যায়, তার কারণে। এত লোককে জনগণের টাকায় হজে পাঠাতে হবে কেন? কত লোক যাচ্ছে এবার ধারণা করতে পারেন? সংখ্যাটা একেবারে কম নয়, পুরো সাড়ে আটশ’! বিপুল এই সংখ্যার ব্রেকআপের দিকে তাকালে বিস্ময়টা কমবে না, বরং কিছুটা বাড়বেই।

এরা যাচ্ছে বেশ কয়েকটি ক্যাটাগরিতে। এদের মধ্যে হজ প্রশাসনিক দলে রয়েছেন ৫৭ জন, হজ কারিগরি দলে রয়েছেন ১৭ জন, হজ চিকিৎসক দলে রয়েছেন ২০৭ জন। এই ২০৭ জনের চিকিৎসক দলের মধ্যে ৯০ জন ডাক্তার, ৭৫ জন নার্স বা ব্রাদার্স, ৩৪ জন ফার্মাসিস্ট ও ৮ জন ওটি অ্যাসিস্ট্যান্ট বা ল্যাবরেটরি টেকনিশিয়ান। চিকিৎসক দলকে সহায়তা দিতে রয়েছে একটি সহায়ক দল। এই সহায়ক দলের সদস্য হচ্ছে ১১৮ জন। সহায়ক দল নিয়ে এরই মধ্যে অনেক কথা হয়েছে। বলা হয়েছে এই দলে বেশ কয়েকজন গাড়ি চালক, কয়েকজন প্রতিমন্ত্রী বা এমপির গানম্যান, কয়েকজন মালি ও ক্লিনার, কয়েকজন অফিস সহায়কসহ বিচিত্র ধরনের কাজের লোকজন। এরা চিকিৎসা সংক্রান্ত টিমকে কি সহায়তা দিতে পারবেÑ সে এক বিষম রহস্য!

কিন্তু কেবল চিকিৎসা সহায়তা দিলেই চলবে? হজের করণীয় ও দিক-নির্দেশনা কে দেবে? এজন্যও রয়েছে একটি ওলামা মাশায়েখ টিম। এই টিমের সদস্য সংখ্যা ৫৭ জন। এদেরকে কিভাবে নির্বাচন করা হয়েছে? এ প্রশ্নের উত্তর নিয়ে এরই মধ্যে বিস্তর আলোচনা হয়ে গেছে। বলা হচ্ছেÑ একটি বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত ব্যক্তিরাই কেবল এই টিমে ঢোকার সুযোগ পেয়েছে।

তারপরও একটি কথা কিন্তু বলাই যায় যে, উপরে যে টিমগুলোর কথা বলা হয়েছে, তারা সৌদি আরবে যাচ্ছে হাজিদেরকে নানা ধরনের সহায়তা দেয়ার নাম করে। শেষ পর্যন্ত তাদের কার কাছ থেকে কতটুকু সাহায্য-সহযোগিতা বাংলাদেশি হাজিরা পাবেন, তা নিয়ে হয়তো বিস্তর বিতর্কের অবকাশ থাকবে। কিন্তু তারপরও হাজিদের উপকার করার একটা সুযোগ তো তাদের নিশ্চয়ই থাকবে। কিন্তু এদের বাইরেও যারা যাচ্ছেন সরকারি খরচে তাদের গমনকে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?

প্রথমেই আসা যাক ‘ধর্মপ্রাণ মুসলমান’ হিসাবে যারা যাচ্ছেন তাদের প্রসঙ্গে। এই শিরোনামে সুযোগ দেয়া হজযাত্রীর সংখ্যা ৩০৯ জন! এদের মধ্যে রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী, সরকারি বিভিন্ন অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারী, সাংবাদিকসহ অনেকেই রয়েছে। একক অফিসের কথা বিবেচনা করলে সবচেয়ে বেশি রয়েছে বঙ্গভবন ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী, গাড়িচালক, মেসওয়েটার, ক্লিনার, স্টোর কিপার, ইত্যাদি মিলে ৪৪ জনের ওপরে। শিল্পী, কবিদের মধ্যে আছেন ফকির আলমগীর, আসলাম সানী প্রমুখ। আছেন পরিচিত বেশ কয়েকজন সাংবাদিকও। সাংবাদিকদের প্রধানত নির্বাচন করা হয়েছে সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতা হিসাবে। সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতা হলে যে ‘ধর্মপ্রাণ মুসলমান’ হিসাবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাওয়া যায়, সেটা এই তালিকা না দেখলে টের পাওয়া হয়তো কঠিন হতো।

এত কিছুর বাইরে যে তালিকাটি নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয়েছে, সেটা হচ্ছে দশজন বিশিষ্ট ব্যক্তির তালিকা। এই তালিকার শীর্ষস্থানে রয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা, ধর্মপ্রতিমন্ত্রীসহ তিনজন প্রতিমন্ত্রী, তিনজন এমপি, স্বাস্থ্য ও ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একজন মহাপরিচালক। এই দশজনের কাজ হবে সার্বিক তত্ত্বাবধান ও দিক-নির্দেশনা। যেখানে তত্ত্বাবধানের জন্য প্রশাসনিক দল রয়েছে, দিক-নির্দেশনার জন্য ওলামা মাশায়েখ দল রয়েছে, সেখানে এরা বাড়তি কি কাজ করবেন বলা মুশকিল। এদের জন্য আবার একটা বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে, এরা প্রত্যেকেই তাদের স্ত্রী সন্তানদের মধ্যে থেকে তিনজনকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে পারবেন।

সবশেষ আরও একটি খবর পাওয়া গেছে। সেটি হচ্ছেÑ ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত যে সংসদীয় স্থায়ী কমিটি রয়েছে তার প্রত্যেক সদস্যও নাকি ৫ জন করে লোককে সরকারি খরচে হজের জন্য মনোনীত করতে পারবেন। সেরকম হলে মূল তালিকার সঙ্গে হয়তো আরও ৪৫ জনের নাম যুক্ত হবে।

যে প্রশ্নগুলো বেশ জোরালোভাবে আলোচিত হচ্ছে তা হলো সরকারি তথা জনগণের অর্থে এত বিপুলসংখ্যক ব্যক্তিকে হজ কাফেলায় পাঠানোর আদৌ কোনো প্রয়োজনীয়তা আছে কি না। প্রয়োজনীয়তা না থাকলে বলতে হবে, এটা আসলে এক ধরনের অপচয়। নাকি বিশেষ বিশেষ মানুষ বা শ্রেণিকে দেয়া উৎকোচ? জনগণের অর্থ সরকারের কাছে থাকে আমানত হিসাবে। এই আমানতের প্রত্যেকটি পয়সার হিসাব দেয়া সরকারের নৈতিক দায়িত্ব। সরকার কি এত লোককে হজে পাঠানোর সময় তার সেই দায়িত্বটির কথা মনে রেখেছে?

আবার এত বিপুলসংখ্যক মানুষকে নির্বাচনের পদ্ধতি নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে। এটা একটা ধর্মীয় কাজ, সে কাজে যদি পক্ষপাতিত্ব বা অনিয়ম হয়ে থাকে, তার দায় থেকে মুক্তি পাওয়া কিন্তু সহজ হবে না। এসব বিষয় কি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ একবারও চিন্তা করেছেন? নাকি তারা এমন দায় বা দায়মুক্তির বিষয়কে পাত্তাই দেন না?

পাশাপাশি আরও যে প্রশ্নটি উচ্চারিত হচ্ছে সেটা একেবারেই ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে। বলা হয়েছেÑ সামর্থ্যবান প্রতিটি মুসলমানের উপরই হজ ফরজ। অর্থাৎ যাদের অর্থনৈতিক সামার্থ্য রয়েছে, তারা নিজ অর্থব্যয়ে জীবনে একবারের জন্য হলেও হজ পালন করবেন। যাদের সামর্থ্য নেই, তাদেরকে যদি সরকার হজ পালন করতে পাঠান তাহলে হয়তো তেমন আপত্তির কিছু থাকতো না। কিন্তু এই লম্বা তালিকায় যাদের যাদের নাম দেখা যাচ্ছেÑতাদের মধ্যে হজ পালনে অসামর্থ্যবান কয়জন আছেন? ওনারা কি খুবই গরিব? নাকি তারা মানসিকভাবে গরিব? না হলে বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হওয়া সত্ত্বেও সরকারি টাকায় হজে যেতে এত আগ্রহ অনুভব করছেন কেন? এভাবে যেতে পেরে তাদের নৈতিকতাবোধ কি তাদের বিবেককে পীড়িত করছে না? ধরে নিলাম, ভুলটা সরকারই করেছে, কিন্তু তারা নিজেরাও তো বলতে পারতেনÑএভাবে তারা হজে যেতে চান না।

তবে এ বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী বেশ একটা যুক্তি দিয়েছেন। তিনি বলেছেনÑএই ধারা অনেক বছর ধরে চলে আসছে, এটা নতুন কিছু নয়। তাছাড়া এ নিয়ে কেউ আপত্তি তো তুলছে না। তাহলে অসুবিধা কোথায়?

মাননীয় প্রতিমন্ত্রীর এমন কথায় মানুষের মনে বিভ্রান্তি তৈরি হতে পারে। একটা অনিয়ম অনেক দিন ধরে চলতে থাকলে সেটি নিয়ে কেউ আপত্তি না তুললেই সেটি বৈধ নিয়মে পরিণত হবে? তাহলে নীতি আর নৈতিকতা বলে কি কিছু থাকতে নেই? ওনার নিজের বিবেক কি বলে? আর আপত্তির কথা যদি বলতে হয়, তাহলে বলবোÑ প্রতিবছর এনিয়ে অনেক আপত্তি ওঠে, প্রশ্ন ওঠে। কিন্তু ওনারা পাত্তা দেন না। যেমন এই লেখাটিকেও ওনারা পাত্তা দেবেন না।

হজ প্রতিটি সামর্থ্যবান মুসলমানের জন্য ফরজ। কিন্তু এভাবে জনগণের অর্থে, জনগণের অনুমতি না নিয়ে হজে গেলে, সে হজ কবুল হবে তো?

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :