সহিংসতার ‘বিষ’ ছড়াচ্ছে সামাজিক মাধ্যম?

হাবিবুল্লাহ ফাহাদ
 | প্রকাশিত : ২৩ জুলাই ২০১৯, ১৪:৫৯

সম্প্রতি বাসে সহযাত্রীর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। বয়স তার পঁয়ত্রিশের মতো হবে। মুঠোফোনে ফেসবুকে খুব মন দিয়ে কিছু একটা পড়ছিলেন। পড়া শেষে একটু উঁচুস্বরে বললেন, ‘কী সর্বনাশ!’

আমি বললাম, ‘কী হয়েছে?’

‘জানেন না? ঘটনা তো ভয়াবহ। এখন এতগুলো মানুষের জীবন যাবে!’

‘মানুষের জীবন যাবে’-কথাটা শোনার পর বিষয়টি জানার আগ্রহ বেড়ে গেল আমার। বললাম, ‘মানুষের জীবন যাবে মানে? ঘটনা কী?’

ভদ্রলোক তার মুঠোফোনটি আমার দিকে বাড়িয়ে দিলেন। বললেন, ‘পড়েন।’

আমি পড়তে লাগলাম। ‘পদ্মা সেতুতে এক লাখ মাথা লাগবে! মাথা সংগ্রহের কাজ চলছে। সবাই সাবধান।’ নিচে একটা ভিডিও লিংক শেয়ার করা। আমি ভিডিওটি ক্লিক করে দেখতে শুরু করলাম। বুঝতে পারলাম এটি নেহাত কোনো গুজব। কারণ এ ধরনের গল্প আমি নানী-দাদির মুখে শুনেছি। ওমুক ব্রিজ করতে মাথা লাগে। নদীতে জলদানব থাকে। তারা মাথা না হলে ব্রিজের খুঁটি পুঁততে দেয় না। মানুষের রক্ত লাগে। ইত্যাদি সব কল্পকাহিনি। কিন্তু সেই কল্পকাহিনি এভাবে মানুষের সামনে হঠাৎ করে বিশ^াসযোগ্য করে তোলার কারণ কী? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে আমি ওই তরুণকে বললাম, ‘আপনি বিশ্বাস করলেন বিষয়টা?’

তিনি আমার দিকে বিস্ময়ের চোখে তাকিয়ে বললেন, ‘ভিডিও দেখলেন না?’

বললাম, ‘ভিডিওতে দেখাচ্ছে যে পদ্মা সেতুতে মাথা দেওয়া হচ্ছে?’

তিনি কিছুটা থতমত খেয়ে বললেন, ‘এসব নিয়ে মানুষ মিথ্যা বলবে মনে হয়?’

আমি হেসে বললাম, ‘এত বড় একটা ঘটনা জাতীয় গণমাধ্যমগুলোতে না এসে প্রথমে ইউটিউবারের কাছে চলে গেল, এটা কি বিশ^াস করার মতো?’

ওই তরুণ এবার কিছুটা থিতু হলেন। বললেন, ‘তাও তো ঠিক।’

মুহূর্তের মধ্যে পদ্মা সেতুতে মাথা লাগার ‘গুজব’ ছড়িয়ে গেল বাতাসের মতো। কয়েকজন পরিচিতজন ফোন করে বিষয়টির সত্যতা জানতে চাইলেন। অনেকে আতঙ্কিত হয়ে পড়লেন। শঙ্কিত অভিভাবকরা। ‘মাথা সংগ্রাহক’ সন্দেহে গণপিটুনিতে মারাও হলো দুজনকে।

কীভাবে তথ্য পেলেন ইউটিউবাররা? কারণ অনুসন্ধানে জানা গেল, একজনকে দেখে আরেকজন ভিডিও বানিয়েছেন। বেশি ভিউ পাবার জন্য। কারণ ভিডিও যত ভিউ হবে, আয় বাড়বে তত বেশি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এখন অর্থ আয়ের নেশায় ঘুরে বেড়াচ্ছে একশ্রেণির তরুণ। যারা নিজের পোস্টে লাইক, কমেন্ট, শেয়ার বাড়ানোর জন্য যা-না তাই প্রচার করে বেড়াচ্ছে। এই প্রবণতা বেশি ইউটিউবারদের মধ্যে। যারা ভিডিও বানিয়ে ‘ঘরে বসে’ আয়ের পেছনে ছুটছেন। তোয়াক্কা করছেন না তথ্য-প্রযুক্তি আইনের। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিষয়েও কোনো জ্ঞান নেই এসব তরুণের।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এক ঘণ্টারও কম সময়ে অর্ধশতের বেশি ইউটিউব চ্যানেলে পদ্মা সেতুতে মাথা লাগার গুজব ছড়ানো হয়েছে। যেখানে ভিডিওর সংখ্যা কয়েকশ। যার প্রতিটি ভিডিও কমপক্ষে এক লাখ মানুষ দেখেছে। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয়েছিল যে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বাধ্য হয়েছে এ নিয়ে সতর্কবার্তা দিতে। কারা এসব অপপ্রচার করেছেন তাদের শনাক্ত করা হয়েছে। আটকও হয়েছেন কয়েকজন।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত তথ্য, ভিডিও কিংবা ছবি কোনটা সঠিক, কোনটা বানোয়াট বোঝা দায় হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে ফেসবুকে এই প্রবণতা বেশি। ফেসবুক ব্যবহারকারীদের একটি বড় অংশ সঠিক তথ্যপ্রবাহ থেকে দূরে থাকেন। তাদের কাছে ফেসবুককেই মনে হয় তথ্যের নির্ভরযোগ্য সহজ মাধ্যম।

বাসে বসে যে তরুণের সঙ্গে কথা হচ্ছিল, তার মতো এমন অনেকেই আছেন, যারা ফেসবুকে পাওয়া তথ্যকে সত্য বলে মনে করেন। এসব তথ্যে বিভ্রান্ত হন। সরকারি তথ্য বলছে, ২০০৮ সালে দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ছিল ৮ লাখ। সেই সংখ্যা এখন ৯ কোটির বেশি। দেশে এক হাজার ৬৭০টি সেবা প্রদানকারী সংস্থা থাকলেও ৮০ শতাংশ ইন্টারনেট ব্যবহার হয় মুঠোফোনে।

বিপুল সংখ্যক ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর বেশির ভাগই এ সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান রাখেন না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার সম্পর্কেও তারা জানেন না। এদের মাধ্যমেই গুজব বা বানোয়াট তথ্য ছড়িয়ে পড়ে। সমাজে বিভ্রান্তি তৈরি হয়। যারা এসব গুজব ছড়িয়ে সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করেন, তাদের লক্ষ্যও আছে এসব অসচেতন মানুষ।

রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরাও একে অন্যের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় অপপ্রচার চালান এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে ব্যবহার করে। এসব কারণে সহিংসতার ঘটনাও ঘটে। এছাড়া সাম্প্রদায়িক বিষয় নিয়েও পক্ষে-বিপক্ষে তর্ক থেকে জন্ম নেয় বিদ্বেষ। এ থেকে সৃষ্টি হয় সামাজিক সহিংসতা। তথ্য-প্রযুক্তিবিদরা বলছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারে অ্যাকাউন্ট বা আইডি করা এতটাই সহজ যে, যে কেউ এখানে যুক্ত হতে পারেন। বয়স বা তথ্যের যে অংশটি রয়েছে, তাতেও মানুষ ভুল তথ্য দিয়ে আইডি খুলতে পারে। বিশেষ করে কিশোর-কিশোরীদের একটি অংশ ফেসবুকের নেশায় আসক্ত হয়ে পড়েছে। ফেসবুক ছাড়া তারা একটি দিন চিন্তা করতে পারে না। অনেক ব্যবহারকারীর একাধিক আইডি রয়েছে। এসব কারণে জবাবদিহিতা বলতে কিছু থাকছে না। বেনামের আইডি থেকে মানুষ যা খুশি তাই প্রচার করছে। যে কারণে তাদের আইনের আওতায় আনতে শনাক্তও করা যাচ্ছে না কখনো কখনো।

অপরাধ ও সমাজ গবেষক ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নেতিবাচক প্রচার-প্রচারণা বেশি হচ্ছে। যে কারো বিরুদ্ধে প্রপাগান্ডা ছড়ানো, গুজব ছড়ানোর সহজ মাধ্যম ফেসবুক।’ তিনি বলেন, ‘ফেসবুক ব্যবহারের জন্য যদি জাতীয় পরিচয়পত্র প্রয়োজন হতো তাহলে বেনামি আইডি খোলা বন্ধ হতো। একটা জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে একটির বেশি আইডি খোলা যেতো না। তখন কারা এসব মাধ্যমে গুজব ছড়াচ্ছে বা মানুষকে বিভ্রান্ত করছে, তা শনাক্ত করা সম্ভব হতো।’ যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে নারী ও শিশুরা

ইন্টারনেটে নারী ও শিশুরাও যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। সম্প্রতি একটি মতবিনিময় সভায় বলা হয়েছে, এ বছরের প্রথম চার মাসেই ১৮ নারী ও শিশু অনলাইনে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। কিন্তু ইন্টারনেটে যৌন হয়রানি থেকে নিজেকে সুরক্ষার উপায় সম্পর্কে তারা জানে না। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক শীপা হাফিজা বলেন, ইন্টারনেট সুযোগ না দুর্যোগ হয়ে যাচ্ছে। এর আগ্রাসী থাবায় শিশু আর নারীরা হুমকির মুখে পড়ছে। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে কেউ কেউ বেছে নিচ্ছে আত্মহত্যার পথ। ইন্টারনেট ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণ ও সচেতনতা দরকার বলে মত দিয়েছেন তিনি।

আইনজ্ঞরা বলছেন, আইনে অনলাইনে যৌন হয়রানির বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞা নেই। ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষার ব্যবস্থা নেই। আবার অনেকে নির্যাতনের শিকার হয়ে প্রতিকার চান, কিন্তু মামলা করতে চান না।

গুজব রটনাকারীদের কঠোর শাস্তি দাবি

যারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করে তাদের কঠোর শাস্তির দাবি করেছেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ একবার গুজব ছড়িয়ে তারা কোনো কারণে রেহাই পেয়ে গেলে পরে আবার সেই কাজ করবেন। এখানে আর্থিক মুনাফার বিষয়টি বড় হওয়ায় একটি চক্র এ ধরনের কাজ ফেসবুকে ও ইউটিউবে হরহামেশা করছে।

স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস (সিসিএ) ফাউন্ডেশনের সভাপতি কাজী মুস্তাফিজ বলেন, ‘আমাদের অনেকেই না বুঝে অন্যের পোস্ট শেয়ার করে দিই। আমরা জানার চেষ্টা করি না যে, আসলে তথ্যটি সঠিক কি না। কোনো বিষয়ে শতভাগ নিশ্চিত না হয়ে শেয়ার, লাইক বা কমেন্ট করা উচিত নয়। এতে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।’

তিনি বলেন, ‘যারা গুজব ছড়িয়ে বা বিভ্রান্তিকর তথ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে সুবিধা নিতে চায় তাদের চিহ্নিত করে অবশ্যই কঠিন শাস্তি দিতে হবে। যেন তারা ভবিষ্যতে এ ধরনের অন্যায় করার সাহস না পায়। তাদের কী শাস্তি হলো সেটিও গণমাধ্যমে প্রচার করা জরুরি। যাতে অন্যরা এ ব্যাপারে সতর্ক হয়।’

ইন্টারনেটের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করে অপরাধ দমন করা যাবে না। তবে ইন্টারনেটের ব্যবহার যেন একটি নির্দিষ্ট নিয়মে হয়, ব্যবহারকারীদের যেন প্রয়োজনে জবাবদিহিতার আওতায় আনা যায় সেই ব্যবস্থা থাকতে হবে। এ জন্য ইন্টারনেট ব্যবহারকারী বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীদের যথাযথ তথ্য সংরক্ষণের সুব্যবস্থা থাকতে হবে। আবার এ কথাও মাথায় রাখতে হবে যে, তথ্য সংরক্ষণ বা জবাবদিহিতার আওতায় আনার নামে যেন কোনো নাগরিক হয়রানি শিকার না হন। আমাদের সকলের স্বার্থেই তথ্য-প্রযুক্তি নিরাপদ ব্যবহার নিশ্চিত করা প্রয়োজন। নাগরিকরা যেন নিজে থেকেই এতে সহযোগিতা করেন, এমন কর্মকৌশল নিতে হবে।

(ঢাকাটাইমস/২৩জুলাই/এজেড/এইচএফ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :