গণপিটুনি, অভিজ্ঞতা ও আমার বোন রেনু!

প্রকাশ | ২৩ জুলাই ২০১৯, ২০:৫০ | আপডেট: ২৪ জুলাই ২০১৯, ১৪:৩১

তানবীর সিদ্দিকী

গণপিটুনি দেখলে এগিয়ে যান, চিৎকার দিন, মানুষকে সরিয়ে দিয়ে নিজে কন্ট্রোল নিন। প্রয়োজনে পুলিশে খবর দিন। ছয় বা সাত বছর আগের কথা। শান্তিনগর এলাকায় থাকি। দুপুরের পর বাসা থেকে বের হয়ে মূল রাস্তায় আসতেই ইস্টার্ন প্লাস মার্কেটের উল্টোপাশের রাস্তায় সালাম ডেয়ারির সামনে থেকে কানে আসে চিৎকার- বাবাগো, মাগো, আর মাইরেন না, ও বাবাগো।কিছু লোকের জটলা। বুঝতে বাকি রইলো না গণপিটুনি চলছে। ভিড়ের মধ্যে মানুষের পায়ের ফাঁক দিয়ে দেখলাম একজন লুঙ্গিপরা মানুষকে ফ্রি স্টাইল পেটাচ্ছে একদল মানুষ।

কিল, ঘুষি, লাথি তো আছেই সাথে কাঠের লাঠির বাড়ি। কে কার আগে মারবে এমন প্রতিযোগিতা চলছে। শরীরের বিভিন্ন জায়গা থেকে রক্ত বেরুচ্ছে, ঘুষিতে মুখের কয়েক জায়গায় ফুলে গেছে। ভয় পেলাম কোনো লাথি যদি বুকের স্পর্শকাতর জায়গায় লেগে দম বন্ধ হয়ে মরে যায়! ততক্ষণে সে প্রায় আধামরা। বয়স্ক মানুষও আছেন কয়জন।

এ অবস্থায় ঠেকাতে গেলে আমারও মার খাওয়ার সম্ভাবনা আছে। এলাকায় দীর্ঘদিন থেকে থাকি, আশপাশের দোকানের সবাই চেনে। দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলাম। ভিড় ঠেলে ভেতরে ঢুকে মাটিতে পড়ে থাকা আহত লোকটার বুকের দুইপাশে দুই পা দিয়ে আগলে রেখে এক চিৎকার দিলাম, কেউ ওকে আর মারলে খুন করে ফেলবো সবাইকে। আমার চিৎকারে কাজ হলো।

কয়েক সেকেন্ডের জন্য মার থামলো, ধমক শুনে লোকজন ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। নিজের পরিচয় দিলাম। জানতে চাইলাম মারার কারণ। একজন বললো রিকশা চুরি করে পালাচ্ছিল। কিন্তু ধাওয়া করে রিকশাসহ তাকে আটক করেছে। বুঝে গেলাম হাতেনাতে ধরা পড়েছে। তাকে মারা হচ্ছে শিক্ষা দেয়ার জন্য। তখনো আমি তাকে আগলে রেখেছি। ওকে মারতে হলে আগে আমাকে মারতে হবে। জানতে চাইলাম ওকে শিক্ষা দেয়া হয়েছে না কি এখনো বাকি আছে। আর কে কে মারতে চান এক এক করে আসেন। একজন একজন করে মারেন। কিছুটা কঠোর হওয়ার অভিনয় করলাম। দেখলাম লোকজনের মারার উৎসাহ কমে গেছে। লোকটার কাছে কী আছে জানতে চাইলে একটা ফোল্ডার বের করে দিলো।ভেতরে কিছু টাকা আর কয়েকটা ভিজিটিং কার্ড। টাকাগুলো ফেরত দিয়ে কার্ডগুলো রেখে দিলাম।

সবাইকে বললাম আমি দেখছি ব্যাপারটা, আপনারা যান। আমার উদ্দেশ্য ছিল একবার মারা বন্ধ করতে পারলে আবার শুরু করা সহজ হবে না। মনে হলো ছেলেটা নতুন জীবন পেল! জিজ্ঞাসা করলাম সে যেতে পারবে না কি সাহায্য লাগবে। ও তখন এলাকা ছাড়তে পারলে বাঁচে। খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলে গেল আমার সামনে থেকে। রেখে গেল কিছু দুঃসহ স্মৃতি। মনে মনে ভাবছিলাম সামান্য রিকশা চুরির শাস্তি যদি এই হয় তাহলে যারা হাজার হাজার কোটি টাকা মেরে দেয় তাদের কী করা উচিত!

রেনু, বোন আমার। আমি থাকলে তোমাকে আমি মারতে, মরতে দিতাম না। জীবন দিয়ে হলেও রক্ষা করতাম। কেন স্রষ্টা আমাকে সেসময় ওখানে পাঠাননি।

লেখক: মানবাধিকার কর্মী এবং প্রধান নির্বাহী, মানবাধিকার ও নাগরিক শিক্ষা বিষয়ক সংগঠন চেঞ্জ মেকারস্।