তুবার রাত কখনোই ফুরাবে না

জেবিন ইসলাম
 | প্রকাশিত : ২৩ জুলাই ২০১৯, ২২:১৯

আমরা মনে হয় পৃথিবীর সবচেয়ে নির্মম, বর্বর স্বার্থপর, ব্যর্থ, বেকুব ও সহনশীল জাতির মধ্যে একটি। গন্ডারের থেকেও বেশি ধৈর্য আমাদের। অথচ মনে করি আমরাই সবচেয়ে মায়া মমতায় ভরা বুদ্ধিমান সেনসিটিভ সহানুভূতিশীল মানুষ।

অন্যান্য দেশের মানুষ নিজের দেশ ও মানুষের স্বার্থে অন্য দেশের সাথে যুদ্ধ করে। অন্যদের থেকে নিজেদের কিভাবে উপকার হবে সেই চুক্তি করে। আর আমরা কেউ আমাদের থেকে উপরে চলে যায় কিনা, নিজেরাই নিজেদের মানুষের পা টেনে ধরি। নিজেদেরই সরল বিশ্বাসের উপর ছুঁড়ি চালাই। নিজেরাই নিজেদের সম্মানহানি করি। দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করি, সবচেয়ে বেশি নিজেরাই নিজেদের ক্ষতি করি!

কোন বন্যা, দুর্ভোগ, ডেঙ্গু, রোগশোক, অপমৃত্যু, ধর্ষণ, সড়ক দুর্ঘটনা, খুন, খাদ্যে ভেজাল মহামারী হয়ে আমাদের কাবু করতে পারে না। আমাদের বিবেককে জাগাতে পারে না। অন্যের দুঃখ কষ্টে বিপদে আপদে আমাদের পিঠ দেয়ালে আর ঠেকে যায় না। কারো যত বড় ক্ষতিই হোক আমাদের আত্মা নাড়া দেয় না। যতক্ষণ না এমন খারাপ কোনোকিছু আমাদের নিজেদের বা পরিবারের আপনজনদের সাথে ঘটছে। এসবে আমাদের বুক কাঁপে না কারো দুর্দিনে কিছুই যায় আসে না।

চোখের সামনে একটা অপরাধ দেখে প্রতিবাদ করার কেউ থাকুক না থাকুক, কোন দুষ্কৃতিকারীকে প্রতিহত করতে কেউ এগিয়ে আসুক না আসুক, ঘটনার কারণ জানতে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গোয়েন্দা হয়ে যাই সবাই। একদল থাকি ভিকটিমের পক্ষে, একদল ভিকটিমেরই বিপক্ষে। এতোটাই জাজমেন্টাল হয়ে যাই, ‘সবাই যখন বিচারক’ নামে মুভিও বানানো যাবে চাইলে।

মাথায় যতগুলো চুল, তার থেকে বেশি ইস্যু হয় আমাদের। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাতের মতো ইস্যুর ক্ষুধা থাকে।একটা পেলে অন্যটা ভুলে যাই। নিউজফিড স্ক্রল করে কনফিউজড হতে হয়। কোনটা থেকে কোনটা সিরিয়াস। কোনটা বেশি বড় দুর্ঘটনা। কোনটার ক্যাপশন বেশি টাচি।

আমাদের মধ্যে লেইম ভিত্তিহীন বিষয়ে কম্পিটিশন হয়। হিংসা হয় কোনটা মজা করে ভাইরাল করতে হবে। কোথায় নিজের স্বার্থ হাসিল করা যায়। কোথায় সিম্প্যাথি দেখালে পাবলিকের বাহবা পাওয়া যায়। সোশ্যাল মিডিয়ায় কি বললে একটু ফ্যান ফলোয়ার পাওয়া যায়।কার থেকে কে ভাল প্রতিবাদী ভাষায় লিখলে লাইক কমেন্ট শেয়ার বাড়বে। আসল ঘটনার চেয়ে সেগুলোই তখন মূল ইস্যু হয়ে দাঁড়ায়।

একজনের নৈতিক দায়িত্ব থেকে ফাঁসি চাই, শাস্তি চাই, মানববন্ধন, ভার্চুয়াল মুভমেন্ট, অপরাধীর বিচার করা/চাওয়াকে আমরা আইনের উপর দোষ চাপিয়ে লিখতে লিখতে ঘটনা অন্যদিকে মোড় নেয়।

ক্লাইমেক্স টুইস্ট থ্রিল সব থাকবে, যা বলিউড হলিউড তামিল মুভিও হার মানাবে। তখন দোষীর শাস্তি দেওয়া থেকে তার অপরাধ করার পেছনের কারণ জানা/বের করা জরুরি হয়ে যায়।

এর মধ্যে আরো নতুন নতুন অনেক রোমাঞ্চকর ইস্যু আসতে থাকবে। যার নীচে সেগুলো ধামাচাপা পড়ে কবর হয়ে পঁচে গলে মাটির সাথে মিশে যাবে। না হয় ধুলার সাথে বাষ্প হয়ে আকাশে উড়ে যাবে।

এর থেকে যদি কালাচোরা একটা গুজব ছড়ায় দেয়-কারো কান কেটে নিয়ে যাচ্ছে চিলে, হুজুগের চোটে এই দেশে কোন চিল তো দূরে, কাঁকপক্ষিও সন্দেহ করে মেরে ফেলবো সবাই।

কল্লা কেটে পদ্মাসেতু নির্মাণ হবে এমন বিশ্বাস মনে পোষণ করার মতো নির্বোধ জাতি হয়ে কাউকে মেরে ফেলতেও এক চুল ভাবতে হয় না আমাদের। অথচ কত নির্দ্বিধায় বিদ্বেষ ছড়িয়ে বসে তামাশা দেখে তারা।

আর এদিকে বিনোদন প্রিয় অস্থির আমরা সবসময়ের মতো এখনো রিফাতকে ভুলে, দেশের দুর্নাম না ঘুচিয়ে মিন্নির লিংক খোঁজা থেকে প্রিয়া সাহার ভিডিও ভাইরাল করছি। গালি দেওয়া এসব গসিপে ব্যস্ত।

অন্যদিকে রেনু কিংবা তুবার নিরাপরাধ মায়েরা গণধোলাইয়ের শিকার হয়ে পথঘাটে মরে পরে থাকে। যদিও খারাপের চেয়ে ভালো মানুষের সংখ্যা এই দেশে কয়েকশ গুণ বেশি। কিন্তু কেন জানি সেই ভালো মানুষগুলো ঐক্যবদ্ধ হতে পারে না। সবার মধ্যেই কেমন হামসে বড়া কৌন হ্যায় টাইপ মনোভাব।

সব ভালো মানুষ যদি এক হওয়া যেত তাহলে হয়ত আর কোন অন্যায়ের পুনরাবৃত্তি দেখতে হত না। এভাবেই আবার যখন কিছু ঘটবে, আরো ঘটতেই থাকবে। অন্য কোন ইস্যুতে রেনুর নাম ভুলে অন্য কারো জন্য এভাবেই নির্লজ্জের মতো লজ্জিত একটা স্ট্যাটাস লিখবো।

রেনুকে মনে রাখবো, কারণ তাসলিমা আমার বোনের নাম (ওই যে নিজের রক্তের সাথে মিলে যাওয়া নাম তো)। এর চেয়ে বেশি কিছু করার ক্ষমতা আমার নাই।

সবার সুখে হাসবো আমি কাঁদবো সবার দুঃখে, সকলের তরে সকলে আমরা, দশের লাঠি একের বোঝা-এসব প্রবাদ, বিদ্রোহী কবিতা, জ্বালাময়ী ভাষণ সব আমাদের মেরুদন্ডের কাছে মিথ্যা প্রমাণিত হচ্ছে।

তারপরও আশা করবো পৃথিবী যেহেতু এক্ষুনি ধ্বংস হচ্ছে না, একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। আইনের ওপর আস্থা রাখা ছাড়া উপায় নেই, সামাজিক নিয়মের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই।

একদিন শুধু সত্য আর সঠিক সংবাদই প্রচার হবে, কোন গুজব রটবে না। একদিন অন্যায়কে প্রতিহত করে সুষ্ঠু বিচার আসবে, অনিয়ম দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বললে, আওয়াজ তুলে সোচ্চার হলে কেউ বদলি হবে না। আর কেউ ষড়যন্ত্রের বলি হয়ে চাকরিচ্যুত হবে না।

কার্মা বলে একটা জিনিস আছে সেই বিশ্বাস রেখে সবাই ধর্মীয় অনুশাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হব। এসব স্বপ্ন দেখে একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস বুকে চেপে বলবো ব্যাপার নাহ, ডেইলি সোপের মতো সকালেই হয়তো অন্য কোন ইস্যু আসবে।

‘যার চলে যায় সেই বোঝে যে হায়, বিচ্ছেদে কি যন্ত্রণা। অবুঝ শিশুর অবুঝ প্রশ্ন, কি দিয়ে দেব সান্ত্বনা’। গানের উত্তর না পেয়ে, স্টার জলসা, জি বাংলার ‘তোমায় ছাড়া ঘুম আসে না মা’ পর্বে কি দেখাবে এই অপেক্ষায় নতুন সূর্য ওঠার প্রত্যাশা নিয়ে ঘুমিয়ে যাব। আমাদের সবারই রোজ ভোর হবে। কিন্তু এই তুবার রাত আর কখনোই ফুরাবে না।

লেখকঃ এডমিন, ডু সামথিং এক্সেপশনাল (ডিএসই)

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফেসবুক কর্নার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :