সব গুজবই গুজব নয়!

প্রকাশ | ২৬ জুলাই ২০১৯, ১৩:০১

মানিক মুনতাসির

পদ্মা সেতুর জন্য মানুষের মাথা লাগবে, এটা স্রেফ একটা গুজব। এটা যারা ছড়াচ্ছেন তাদের কঠিন শাস্তি হওয়া দরকার। অন্যদিকে ছেলেধরা আতঙ্ককে পুঁজি করে যারা গুজব ছড়িয়ে মানুষকে পিটিয়ে হত্যা করছেন সেটা আরও বড় অপরাধ। এর শাস্তি হওয়া উচিত দৃষ্টান্তমূলক।

ছেলে ধরা গুজবের সঙ্গে পদ্মা সেতুতে মানুষের মাথা লাগাবে-এই ইস্যুটি সরাসরি জড়িত। অন্যদিকে টানা তিন দিন সারাদেশে বিদ্যুৎ থাকবে না সেটাও শতভাগ গুজব। আবার ডেঙ্গু রোগী বাড়ছে, ডেঙ্গুতে মুত্যু বাড়ছে, এটা কিন্তু গুজব নয়। হাসপাতালগুলোতে জায়গা নেই। সব ডেঙ্গু রোগীতে সয়লাব। ফলে বোঝায় যায় এবার ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি। এটাকে গুজব বললে বরং ডেঙ্গুকে তথা এডিস মশাকেও অবহেলা করা হবে। এর মাধ্যমে কেউ কেউ নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকার চেষ্টাও করতে পারেন। যার ফলাফল হতে পারে অত্যন্ত ভয়াবহ।

ইতিমধ্যে ৩৪ দিনের শিশু থেকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকও মারা গেছেন ডেঙ্গু জ্বরে। সেই সঙ্গে দেশের প্রায় ২০-২২টি জেলায় লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দী। সবশেষ কুড়িগ্রামকেও বন্যাকবলিত জেলা হিসেবে সরকার ঘোষণা করেছে। দুঃখের বিষয় হলো কুড়িগ্রাম জেলা বন্যা কবলিত হয়েছে আরও দুই সপ্তাহ আগে। অথচ সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর কাছে সে তথ্যও ছিল না। এজন্য বন্যা কবলিত জেলার তালিকা থেকে প্রথমে কুড়িগ্রামকে বাদ দেওয়া হয়েছিল। যদিও বিভিন্ন মহলের চাপে পরবর্তীতে তালিকাটি সংশোধন করা হয়েছে। ফলে সাবধান হওয়া দরকার। এবং সবচেয়ে বেশি সচেতনতা দরকার সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের। তাদেরকে সঠিক তথ্য থেকে কেউ বিরত রাখছে কি-না? অর্থাৎ বন্যা, ডেঙ্গু, মাথাকাটা আর ছেলেধরা ইস্যুতে তাদেরকে কেউ মিসগাইড করছে কিনা-সে বিষয়টিও ভেবে দেখার সময় এসেছে।

আর সম্প্রতি সব ইস্যুকে পাশ কাটিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় এসেছে যে ইস্যু সেটি হলো প্রিয়া সাহার নালিশ কাণ্ড। একদিকে রূপপুরের বালিশ কাণ্ড অন্যদিকে প্রিয়া সাহার নালিশ কাণ্ড। দুদক ইতিমধ্যে বলেছে রূপপুরের অনিয়মের সঙ্গে জড়িতে শাস্তি পেতে হবে। সেই সঙ্গে রাষ্ট্রের ৩৪ কোটি টাকা ফেরত আনা হবে। কিন্তু প্রিয় সাহার কি হবে? দেশের জন্য তিনি কতটা ক্ষতি করেছেন তা হয়তো এখনও অনুমেয় নয়। যদিও প্রিয়া সাহার কাছে সরকারের পক্ষ থেকে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে। অন্যদিকে প্রিয় সাহা তার বক্তব্যে অনড় থেকে এই ইস্যুতে নিজেকে প্রধানমন্ত্রীর অনুসারী দাবি করেছেন। এটা কোনো ধরনের ধৃষ্টতা কিংবা চাতুরতা কি-না তা হয়তো সরকারই বিবেচনা করবে।

সত্যজিৎ রায় নির্মিত কালজয়ী সিনেমা “হীরক রাজার দেশে” দেখেননি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া বোধ হয় দুস্কর হবে। সত্যজিৎ সেখানে দেখিয়েছেন চাটুকার মন্ত্রীরা কিভাবে রাজার গুণগান গাইতেন। অথচ রাজ্যে মানুষ না খেয়ে মারা যেত। শ্রমিক তার ন্যায্য পাওনা পেত না। ফলে রাজার তন্ত্র, মন্ত্র ঘরে জনগণের মগজ ধোলাইয়ের স্বপ্ন বুমেরাং হয়ে যায় সাহসী নায়ক, গ্রামবাসী আর স্কুলের ছোট ছোট ছেলেমেয়ের বুদ্ধিমত্তায়। সেটি হয়তো একটি কাল্পনিক গল্প থেকে সৃষ্ট। কেননা সিনেমার সঙ্গে বাস্তবতার মিল সব সময় হয় না। তবে কখনো কখনো মিলে যায়।

এখন সিনেমার কিছু গল্পকে বাস্তব বাস্তব মনে হয়। যেমন দিনেদুপুরে লোকসম্মুখে কুপিয়ে মারা হচ্ছে। শত শত মানুষ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে (কোপানোর দৃশ্য) তামাশা দেখেন। ঘটনা ঘটার পর পুলিশ আসেন। কি ঘটেছে, কারা ঘটিয়েছে, সবাই দেখলেও ভয়ে কেউ মুখ খোলেন না। আবার যিনি প্রধান সাক্ষী তিনিই হয়ে যান প্রধান সন্দেহভাজন। এটা নিশ্চই কোনো গুজব কিংবা সিনেমা নয়। পাঠক নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন আমি কোনো হত্যাকাণ্ডের কথা বলতে চাচ্ছি। তবে মিন্নি যদি অপরাধী হয়ে থাকে, শাস্তি তারও হওয়া উচিত। কিন্তু তার মুখ চেপে ধরে নয়। তাকে কথা বলতে দেওয়া উচিত। আদালতে হাজিরা দিতে এসে মিডিয়ার কাছে কিছু বলতে চাইলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকেরা তার মুখ চেপে ধরেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এটা বোধ হয় বাক স্বাধীনতার পরিপন্থী।

এবার আসুন ডেঙ্গুর কথা বলি। গত ২৪ ঘণ্টায় (২৪, ২৫ জুলাই) সাড়ে পাঁচ শরও বেশি সংখ্যাক ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। সে হিসাবে প্রতি তিন মিনিটে দেশের কোনো না কোনো হাসপতালে একজন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হচ্ছেন। এখন পর্যন্ত মারা গেছেন ৮ জন। এর মধ্যে দুইজন চিকিৎসকও মারা গেছেন ডেঙ্গু জ্বরে। এক দুর্ভাগা তো বাড়ি যাওয়ার সময় বাসে বসেই  মারা গেছেন। তিনি বাড়িতে পর্যন্ত পৌঁছতে পারেননি। মন্ত্রীপাড়া, ভদ্রপল্লী, অভদ্র পল্লী সবখানেই ডেঙ্গু আতঙ্ক।

ডেঙ্গু এখন শুধু ঢাকাতেই নয় চট্টগ্রাম থেকে সুদূর গ্রামেও ছড়িয়ে পড়ছে। অবশ্য সরকারের দায়িত্বশীল মন্ত্রী-মেয়ররা এখনো এটাকে নিয়ন্ত্রণহীন মানতে নারাজ। এডিস মশার বিস্তার ঠেকাতে বিদেশ থেকে ভদ্র মশা আমদানির কথাও শোনা যাচ্ছে। তবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখনই নিতে হবে। আর দেরি নয়। যেকোনো মূল্যে ঠেকাতে হবে ডেঙ্গুর প্রকোপ।

এদিকে খোদ অর্থমন্ত্রীও ডেঙ্গু জ্বরে ভোগার পর বিদেশ থেকে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে ফিরেছেন। তিনি এর ভয়াবহতা একাধিকবার বর্ণনাও করেছেন। ২৫ জুলাই এক অনুষ্ঠানেও তিনি বলেছেন এর যন্ত্রণা আমি বুঝি। আর কারো যেন এ জ্বর না হয়। আমি সে দোয়া করি। কিন্তু শুধু দোয়ায় তো কাজ হবে না। এর জন্য দাওয়াই প্রয়োজন। সে দাওয়াই হয়তো আনবেন ঢাকার দুই মেয়র।

ওষুধ ছিটান, ভদ্র মশা আনুন, ওয়ান স্টপ সার্ভিস চালু করুন। যাই করুন। মহামারির আগেই নিয়ন্ত্রণে আনুন। অর্থমন্ত্রী আগারগাঁওস্থ পরিকল্পনা কমিশনের নিজ কার্যালয়ে পর্যন্ত যাচ্ছেন না। বলেছেন সেখানে মশা বেশি। ফলে সচিবালয়ের কার্যালয়ে নিয়মিত বসা শুরু করেছেন। এতে অবশ্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বেশ খুশি। কারণ যানজট ঠেলে তাদেরকে আর পরিকল্পনা কমিশনে যেতে হচ্ছে না। অর্থমন্ত্রীর দপ্তর দুইটা ফলে তিনি একটায় যাচ্ছেন না। অন্যটায় বসছেন। কিন্তু আপনার দপ্তর কয়টা? আপনার তো কাজের জায়গাই বা কয়টা? ফলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণই হোক আপাতত সরকারের জন্য সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা।

সরকারি-বেসরকারি হিসাবে গত ২০১৪ থেকে ২০১৮ সালে ঢাকায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন ১৫ হাজার ১৭৪ জন। এর মধ্যে মারা যান ৩৯ জন। যারা সবাই রাজধানীর বাসিন্দা। আর এ বছর কতজন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। কিন্তু এতে কোনো সন্দেহ নাই যে গত কয়েক বছরের তুলনায় এ বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ অনেকগুণ বেশি। প্রতিদিন, প্রতি মুহুর্তেই আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। আমার এ লেখা যখন আপনি পড়ছেন তখন হয়তো আপনিও আতঙ্কগ্রস্ত। কখন, কোন পাশ থেকে এডিস মশা এসে আপনাকে কামড় দেয়। আর আপনি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন। এ আতঙ্কের বাইরে আমিও নই।

এদিকে দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা যখন কাণ্ডজ্ঞানহীন বক্তব্য দেন, তখন আসলে মন্তব্য করার মত আর কিছু বাকি থাকে না। ঢাকা দক্ষিণের মেয়র বলেছেন, ডেঙ্গু রোগীর পরিসংখ্যান নিয়ে গুজব ছড়ানো হচ্ছে। আর স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, এডিস মশার প্রজনন ক্ষমতা রোহিঙ্গাদের মত। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রতিদিন প্রায় ৬০ জন করে শিশুর জন্ম হচ্ছে। এতে গত ২০ মাসে এক লাখের বেশি নতুন শিশু জন্ম নিয়েছে। এখনো সেখানে ৫০ হাজারের মত গর্ভবতী নারী রয়েছেন। ব্যাপারটা সত্যিই আঁতকে ওঠার মত। গত দুই মাসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী এডিস মশার বিস্তারও আঁতকে ওঠার মতই। এজন্যই হয়তো মন্ত্রীমশাই এটা বলেছেন। কিন্তু কথা হলো রোহিঙ্গা শিবিরে শিশুর জন্ম আর এডিস মশার প্রজনন নিয়ন্ত্রণে থাকুক আর নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকুক, ডেঙ্গু রোগী আছে এবং বাড়ছে এটা তো স্বীকার করতেই হবে। প্রতিদিন এডিস মশা বাড়ছে আর মশার কামড়ে ডেঙ্গু রোগী বাড়ছে। সেটা তো মানবেন। ফলে কথা না বলে মশা মারুন। 

এদিকে দেশের ২০-২২টি জেলা বর্তমানে বন্যা কবলিত। লাখ লাখ মানুষ বন্যার পানিতে ঘর-বাড়ি, সহায় সম্বল হারিয়ে গায়ের জামা-কাপড়টা পর্যন্ত সঙ্গে নিতে পারছেন না। ছোট নৌকার মধ্যে সামান্য ধান, লাকড়ি রেখে বন্যার পানি বেয়ে ছুটছেন নিরাপদ আশ্রয়ে। আরেক ছবিতে দেখা গেছে গবাদি পশুকে পিঠে নিয়ে এক কিশোর হাঁটু পরিমাণ পানি ভেঙে নিজেকে ও নির্বোধ পশুকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্ট করছেন। গত কয়েকদিনের বন্যায় এখন পর্যন্ত অন্তত ৬০ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। একই সময়ে খোদ রাজধানীতে এক মাকে ছেলেধরা সন্দেহে পিঠিয়ে হত্যা করা হয়েছে। যারা পিঠিয়ে মেরেছে তারাও দেখতে ঠিক মানুষের মতই। এটাকে ভয়াবহ, বর্বর, নির্মম কিংবা বীভৎস বলা হলেও হয়তো কম বলা হবে। সারাদেশে বন্যার কবলে পড়া মানুষেরা যে দুর্দশাগ্রস্ত এটা কিন্তু গুজব নয়। ফলে আসুন বন্যার্তদের পাশে দাঁড়াই। গুজবের পাল্লায় পড়ে গণপিটুনিতে আর কোনো মৃত্যু চাই না। ডেঙ্গুতেও চাই না আর কোনো মৃত্যু। চাই না নতুন করে ডেঙ্গুর প্রকোপ।

বানের জলেও যেন কোন মানুষের মৃত্যু না ঘটে, এমন কি আর কোনো প্রাণের সংহার যেন না ঘটে। সুখী হোক জগতের সব প্রাণী। মানবিক হোক পৃথিবীর সব মানুষ।

লেখক: সাংবাদিক