রেনুর সন্তানদের নিয়ে অমানবিকতা

প্রকাশ | ২৮ জুলাই ২০১৯, ১২:২৯ | আপডেট: ২৮ জুলাই ২০১৯, ১২:৩২

তানিয়া আক্তার, ঢাকাটাইমস
রেনুর দুই সন্তান মাহিন ও তুবা (ফাইল ছবি)

রাজধানীর বাড্ডায় গণপিটুনিতে নিহত তাসলিমা বেগম রেনুর দুই শিশু সন্তানের প্রতি সহানুভূতি দেখাতে গিয়ে তাদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলছেন স্বজন আর কিছু গণমাধ্যম। সাংবাদিকতার নীতিমালা অগ্রাহ্য করে শিশু দুটির বেদনা খুঁচিয়ে বের করার চেষ্টা যেমন চলছে, তেমনি স্বজনরা এমন সব কাজ করছেন, তা তাদের শিশু মনে ব্যাপক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে।

শিশু মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আর গণযোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মা-হারা ছেলে মেয়ে দুটিকে সামলে উঠতে আপাতত তাদের সময় দেওয়া উচিত। তাদের আদর দেওয়া যেতে পারে, কিন্তু বীভৎস সেই স্মৃতি সামনে চলে আসে, এমন কিছু করা উচিত নয়। এতে করে তাদের ভবিষ্যৎ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

গত ২০ জুলাই বাড্ডার একটি স্কুলে পিটিয়ে হত্যা করা হয় রেনুকে। চার বছরের মেয়ে শিশু তুবাকে ভর্তির জন্য খোঁজ নিতে ওই স্কুলে গিয়েছিলেন এই মা। কিন্তু পদ্মা সেতু নিয়ে চলা উদ্ভট গুজবে বিশ্বাস করে ‘ছেলেধরা’ সন্দেহে তাকে বেদম পিটুনি দেয় উত্তেজিত জনতা।

মৃত্যুর পর রেনুর জীবনের কাহিনি সামনে আসে। জানা যায়, স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটা এই নারীর ১১ বছরের ছেলে তাসিন আল মাহিন ছাড়াও আছে চার বছরের তুবা।

পরদিন একাধিক গণমাধ্যম রেনুর মহাখালীর বাড়িতে গিয়ে তুবার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছে। তার তার মুখ ‘আমার মা নাই’ বক্তব্য ছুঁয়ে যায় মানুষকে। এরপর প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো গণমাধ্যম তুবাকে নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করেছে। মেয়েটির বাসায় গিয়ে তার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছে।

স্বজনরাও পিছিয়ে নেই। প্রধান আসামি হৃদয়ের রিমান্ড শুনানিতে ১১ বছরের শিশু মাহিনকে নিয়ে গেছেন তারা। সেখানে মাকে পিটিয়ে হত্যার বর্ণনা শুনেছে মাহিনের ছোট্ট মন। আর ডুকরে কেঁদেছে সে।

শুক্রবার আরেক কাজ করেছেন স্বজনরা। তুবাকে সঙ্গে নিয়ে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বিচার চেয়ে মানববন্ধন করেন তারা। সেখানেও মায়ের কথা ওঠার পর শিশুটি কান্নায় ভেঙে পড়ে।

ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতার শিক্ষক অধ্যাপক মফিজুর রহমান ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘তুবাকে নিয়ে যেসব প্রতিবেদন তৈরি হয়েছে, সেগুলোর কোনো মানে হয় না। শিশুটির মুখে মায়ের কথা শুনতে চাওয়াটা মর্মান্তিক। শিশুদের ক্ষেত্রে বিষয়গুলো আরও খারাপ প্রভাব ফেলতে পারে। এটা সাংবাদিকতার নীতি নৈতিকতার বিরুদ্ধে। সাংবাদিকতায় এ ধরনের বাজারমুখী প্রচারণা বন্ধ করতে হবে। যারা জ্যেষ্ঠ, তাদের উচিত যথাযথ দিক-নির্দেশনা দিয়ে কর্মীদের পাঠানো।’

‘একইভাবে শিশুদের যারা আদালত বা প্রেসক্লাবে নিয়ে যাচ্ছে তাদের উদ্দেশ্য হয়তো সৎ থাকতে পারে, কিন্তু তারা জানে না ছোটবেলার গভীর ক্ষত তাদের মনোজগতে ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারে।’

ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কামাল উদ্দিন ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘যখন শিশুদের মাকে মেরে ফেলা হয়েছে সেটাতো তারা প্রত্যক্ষদর্শী না। এই শিশুকে কোর্ট কাচারি দেখানোটা অবান্তর। শুধুমাত্র সহানূভূতি পাওয়ার উদ্দেশ্যে শিশুদের এভাবে প্রচারণা করলে তার মনস্তাত্ত্বিক কাঠামোই পাল্টে যেতে পারে। মানসিক বিকাশেও বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।’

ছোটবেলার বীভৎস ঘটনা বা গভীর আঘাত বারবার মনে করিয়ে দিলে শিশুর মানসিক জগতে ব্যাপক পরিবর্তন আসতে পারে বলে জানান মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ তাজুল ইসলাম। তিনি ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘শিশুদের সামনে মায়ের মৃত্যুর খবর বারবার মনে করিয়ে দেওয়া মানে বারবার তার মাকে মেরে ফেলা হচ্ছে।’

‘কারণ, আমাদের প্রিয়জনকে হারালে তাদের স্মৃতিটুকু মনে করে বেঁচে থাকি। সেই স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় যদি ব্যাঘাত ঘটিয়ে প্রতিদিনই নতুনভাবে মনে করিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে সেই শিশু ‘ট্রমাটাইস চাইল্ডহুডের’ মধ্যে বেড়ে ওঠে। ফলে বড় হয়ে সে অধিক রূঢ় হয়ে অত্যাচারী মনোভাবের হয়ে উঠতে পারে বা একেবারে অসহায় হয়ে চরম হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়তে পারে।’

‘সব জায়গায় শিশু বা নারীদের পণ্য হিসেবে উপস্থাপিত করার মানসিকতা অনেক পুরনো। এখানেও বিচারের দায়ে শিশুকে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে ঘটনার ভয়াবহতা মনে করিয়ে মানসিক আঘাত দিয়ে সামাজিকভাবে সহানুভূতি আদায়ের চেষ্টা চলছে।’

‘এগুলো শিশুটির আত্মমর্যাদা বিকাশে প্রভাব ফেলবে। ফলে পরবর্তী জীবনে শিশুটিকে সমাজবিরোধী কাজ করতেও প্ররোচিত করতে পারে। তাই উপকার করার উদ্দেশ্যে হলেও যারা তাদের অনুভূতি নিয়ে এমন হেলাফেলা করছে তাদের সতর্ক হওয়া উচিত এখনই।’

শিশুদের নিয়ে কতটা সতর্কতার সঙ্গে সংবাদ উপস্থাপন করতে হয়, সেটির উদাহরণ গত বছর দেখিয়েছে থাইল্যান্ড। ওই বছরের জুলাইয়ে একটি গুহায় ১৭ দিন আটকে থাকা কিশোরদের গণমাধ্যমের সামনে আনার সময় ঘটেছিল অভিনব ঘটনা। আট দিন পর তাদের গণমাধ্যমের সামনে আনা হয়। কিন্তু কোনো সংবাদিককে তার ইচ্ছামতো প্রশ্ন করতে দেওয়া হয়নি। তারা আগে চিকিৎসকদের কাছে প্রশ্ন জমা দিয়েছেন। চিকিৎসকরা বাছাই করেছেন, কোন প্রশ্ন কিশোরদের মনে প্রভাব ফেলবে না। এরপর তারা সেই প্রশ্ন করেছেন কিশোরদের।

(ঢাকাটাইমস/২৮জুলাই/ডব্লিউবি/জেবি)