গুজব, হুজুগ আর গণপিটুনি

মাসুদ কামাল
 | প্রকাশিত : ২৯ জুলাই ২০১৯, ১৮:৩৩

আজব এক গুজবের হুজুগে পড়েছি আমরা। দেশজুড়ে চলছে ছেলেধরা গুজবে গণপিটুনির প্রকোপ। সত্য-মিথ্যা বিচার না করে, কেবল সন্দেহের ওপর ভিত্তি করেই মানুষ পিটাচ্ছে মানুষকে। পিটিয়ে অনেক ক্ষেত্রে মেরে ফেলছে। পরে দেখা যাচ্ছে যাকে পিটানো হয়েছে, কিংবা পিটিয়ে যাকে একেবারে মেরেই ফেলা হয়েছে, সে আসলেই খুবই নিরীহ একজন, মোটেই ছেলেধরা নয়।

এই হুজুগটা শুরু হলো কিভাবে? গুজবটার জন্ম কিন্তু আর একটা গুজব থেকে। শুরুর গুজবটা ছিল ‘পদ্মা সেতু আর কাটা মাথা’ বিষয়ক। সপ্তাহ দুয়েক আগের কথা, হঠাৎ করেই গুজব ছড়ালো নির্মীয়মাণ পদ্মা সেতু নির্মাণে ঝামেলা হচ্ছে, তাই কিছু মানুষের মাথা লাগবে! গুজব সব সময়ই দ্রুত ছড়ায়, এটিও তাই ছড়ালো। এত দ্রুত যে, মানুষের মধ্যে এ নিয়ে আতঙ্ক তৈরি হলো। অগত্যা সরকারের সেতু কর্তৃপক্ষকে রীতিমতো বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বলতে হলো, বিষয়টি নিছকই গুজব। সেখানে তারা পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজের অগ্রগতি সম্পর্কেও জনগণকে ধারণা দিলো। স্পষ্ট করেই জানালো- মাথা লাগার বিষয়টি গুজব ছাড়া আর কিছুই নয়। পুলিশ বললো, পদ্মা সেতুর আশপাশের এলাকায় গত কয়েক মাসে কোনো অপহরণ বা মানুষ হারিয়ে যাওয়ার কোনো রিপোর্ট তারা পায়নি। কিন্তু এসবই সংবাদ। সংবাদ তো গুজবের মতো দ্রুত ছড়াতে পারে না। আর এ সংবাদটি এমন জোরেশোরে প্রচারের ব্যবস্থাও হয়নি, যাতে কি না সেটা গুজবকে থামিয়ে দিতে পারে। ফলে যা হওয়ার তাই হলো, কাটা মু-ুর গুজব ছড়াতে লাগলো। অনেকে এমন গুজব ছড়ানোর ক্ষেত্রে ফেসবুকের নেতিবাচক ভূমিকার কথা বলে থাকেন। কিন্তু সেটা বোধকরি অতটা সত্য নয়। কারণ, একেবারে গ্রামাঞ্চলে, যারা এখনো তেমন একটা ফেসবুকে অভ্যস্ত নয়, তারাও এখন এই গুজবটি শুনেছেন। তারা তাদের সন্তানদের নিয়ে উদ্বিগ্ন, অনেকে সন্তানদেরকে স্কুলে পাঠানোও বন্ধ করে দিয়েছেন।

প্রশ্ন হচ্ছে, এই কাটা মাথার গুজবটাই বা শুরু হলো কিভাবে, কোথা থেকে? আমার এক সহকর্মী সেদিন এক গল্প বললেন। বিষয়টির উৎপত্তি নাকি পদ্মা সেতু নির্মাণ ক্ষেত্র থেকেই। সেতু নির্মাণে দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো এক চায়নিজ প্রকৌশলী নাকি সেতুর কাজ দ্রুত শেষ করতে একবার বলেছিলেন, ‘উই নিড মোর হেডস।’ চায়নিজদের ইংরেজি এমনিতেই জোড়াতালি মার্কা। আরও লোকবল বলতে সে ‘মোর হেডস’ উচ্চারণ করেছে। আর এই কথাটিই সেখানে কর্মরত অর্ধশিক্ষিত এক বাঙালি শ্রমিকের কানে গেছে, সে তার নিজস্ব কুসংস্কারের সঙ্গে মিলিয়ে ‘হেড’ এর আভিধানিক অর্থ করে ‘মাথা’ই বুঝেছে। এটিও নিছক একটি গল্প হতে পারে, আবার সত্যও হতে পারে। আমি ঠিক জানি না। তবে ‘আরও মাথা লাগবে’ শীর্ষক গুজবটি থেমে থাকেনি। এই গুজবকে দ্রুতবেগে ডালপালা মেলতে সাহায্য করেছে নেত্রকোনার একটি ঘটনা।

নেত্রকোনায় ওই ঘটনাটি ঘটে গত ১৮ জুলাই। সেদিন সজীব মিয়া নামের সাত বছরের এক শিশুর কাটা মাথা ব্যাগে ভরে নিয়ে যাচ্ছিল রবিন নামের এক যুবক। কেন ২৫ বছর বয়সী রবিন এটা করছিল, তা এখনো জানা যায়নি। কারণ বিষয়টি ধরা পড়ার পর গণপিটুনিতে রবিনের মৃত্যু হয়। পরে দেখা যায়, নিহত শিশুটি রবিনের প্রতিবেশী রইস উদ্দিনের সন্তান। রহস্য উদঘাটন না হওয়ায় উল্টো আগের গুজবে হাওয়া লাগে। অনেকেই ভাবতে থাকে, এই শিশুর কাটা মাথা বুঝি নেয়া হবে ওই পদ্মা সেতুতেই!

মানুষের মধ্যে এই আতঙ্ক এতটাই তীব্রভাবে ছড়িয়েছে যে, আজকাল কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কিংবা তার আশপাশে কোনো অপরিচিত লোককে দেখা মাত্র সবাই সন্দেহপ্রবণ হয়ে উঠছেন। অনেকে আবার ক্ষিপ্ত হয়ে উঠছেন। লোকজনের মধ্যে হাঁটছেন, কেউ একজন ‘ছেলেধরা’ বলে রব তুললেই হলো, শুরু হয়ে যাবে পিটুনি। সত্যাসত্য যাচাইয়েরও যেন সময় নেই। দিন কয়েক আগে গাজীপুরে রাস্তায় কলহরত স্বামী-স্ত্রী চিৎকার করে পরস্পরকে ছেলেধরা বললো। যারা স্ত্রীর কথায় বিশ্বাস করল তারা পিটালো স্বামীকে, আর যারা স্বামীর কথা শুনলো তারা মারলো স্ত্রীকে! আবার এক স্কুল পরিদর্শক গিয়েছিলেন সরকারি কাজে গিয়েছিলেন স্কুল পরিদর্শনে। ‘ছেলেধরা’ বিবেচনায় তিনিও খেলেন গণপিটুনি! এমনই চলছে আজকাল। কি বিস্ময়কর জটিলতা, অদ্ভুত অবিশ্বাস।

সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয়েছে বাড্ডার ঘটনাটি নিয়ে। নিজের চার বছরের মেয়ের ভর্তি বিষয়ে খোঁজখবর নিতে এক ভদ্রমহিলা গিয়েছিলেন স্কুলে। কেউ একজন হয়তো চ্যালেঞ্জ করলো, এ ধরনের প্রশ্নের মুখে হয়তো জীবনে কখনো পড়েননি তিনি। পড়তে যে হবে সেটা হয়তো ভাবেনওনি। ফলে কিছুটা থতমত ভাব তার মধ্যে দেখা যেতেই পারে। আর তা থেকেই কেউ একজন হয়তো ‘ছেলেধরা’ শব্দটি উচ্চারণ করে থাকবেন। শুরু হলো গণপিটুনি। সে পিটুনি এতটাই নির্মম যে, শেষ পর্যন্ত তসলিমা বেগম রেনু (৪২) নামের সেই মহিলার জীবনই চলে গেল। এই মারের দৃশ্যটি কেউ কেউ ভিডিও করেছেন। সেটা সামাজিক মাধ্যমে চলে আসায় শুরু হয় বিপুল হইচই। ভিডিওটি দু-তিন বার আমি দেখার চেষ্টা করেছি, কোনোবারই শেষ করতে পারিনি। কি ভয়ংকর! কি নির্মমভাবে পিটাচ্ছে নিরীহ মহিলাটিকে! দেখা যায় না। রড হাতে যে ছেলেটি সবচেয়ে নিষ্ঠুরতার সঙ্গে পিটিয়েছে, সেই হৃদয়কে দু’দিনের মাথায় ধরেছে পুলিশ। ছেলেটির বয়স কিন্তু বেশি নয়, মাত্র ১৯ বছর। এর আবার বাবা-মা নেই, দরিদ্র, ভ্রাম্যমাণ সবজি বিক্রেতা। ওই স্কুলের আশপাশেই ব্যবসা করতো সে। পুলিশের হাতে ধরা পড়ার পর সদ্য কৈশোর পেরুনো ছেলেটি বলেছে- কোনো এক মহিলা নাকি প্রথমে তসলিমাকে ‘মাথা কাটা’ হিসাবে দেখিয়ে দিয়েছে। তারপরই আরও অনেকের সঙ্গে সে মারতে শুরু করেছে।

কি অদ্ভুত সব ঘটনা, আজব সব যুক্তি! কেউ একজন দেখিয়ে দিলেই হলো? অমনি তাকে ছেলেধরা হিসাবে ধরে নিতে হবে? নিয়ে পিটাতে হবে? আচ্ছা ধরা যাক, জানা গেল যে কেউ একজন আসলেই ‘ছেলেধরা’, তাহলেই কি তাকে এভাবে পিটিয়ে মেরে ফেলতে হবে? সেই অধিকার কি রাষ্ট্র সাধারণ মানুষকে দিয়েছে? তাহলে আর থানা পুলিশ রয়েছে কেন? পুলিশের কাছে তুলে না দিয়ে নিজেই রায় দিয়ে নিজেই সে রায়ের বাস্তবায়ন করতে গেলে সেটা হত্যার মতো মারাত্মক অপরাধ হবে না? এই যে হৃদয় (এমন হৃদয়হীনের নাম হৃদয় হয় কি করে জানি না), তার এখন কি হবে? ধরে নিচ্ছি কেউ একজন নারী তাকে প্ররোচিত করেছে, কিন্তু রড হাতে পিটিয়েছে তো সে নিজেই। এখন হত্যার অপরাধেই বিচার হবে তার। কতই আর বয়স তার, জীবন এখনো শুরুই হয়নি, একটা হুজুগে গা ভাসিয়ে এখন মৃত্যু পথযাত্রী। তার প্রতি কারও বিন্দুমাত্র সহানুভূতিও রয়েছে বলে তো মনে হয় না।

এখানে আরও একটা বিষয় চিন্তায় আসে। যত গুজবই হোক, তারপরও এমন নির্মম আচরণ মানুষ করে কি করে? রড দিয়ে, লাঠি দিয়ে একজন নিরীহ নারীকে মারা যায় কিভাবে? হৃদয়ের কাছে তো তসলিমা বেগম অনেকটা তার মায়েরই বয়সী। ভিডিওটি যারা দেখেছেন, দেখবেন- যারা মেরেছেন তাদের বেশির ভাগ ওই হৃদয়েরই বয়সী। এই বয়সের ছেলেমেয়েদের মন থেকে কি মায়া-দয়া উঠে গেল! কেন এমন হচ্ছে?

অনেকে বলে থাকেন, এসবই নাকি চলমান প্রযুক্তির নেতিবাচক দিক। কথাটি কি একেবারে উড়িয়ে দেয়ার মতো? বাচ্চারা যে ভিডিও গেমস খেলে, খেয়াল করলে দেখবেন, সেখানে প্রচুর মারামারি থাকে। যেগুলোতে মারামারি বেশি সেগুলোই বেশি জনপ্রিয়। এসব গেমসে মারামারির ঘটনাগুলো এমনভাবে ঘটানো হয় যে, শিশু-কিশোররা যখন এগুলো খেলে, তারা মনে করে মারামারি বুঝি খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। কাউকে হত্যা করাও খুব স্বাভাবিক কোনো ঘটনা। একটি হত্যা যে নিহত ব্যক্তির পুরো পরিবারকে ছারখার করে দিতে পারে, এই উপলব্ধিটিই কখনো হয় না তার। ফলে কৈশোর বা যৌবনে যখন তারা গণপিটুনিতে মত্ত হয়, তখন তার মধ্যে ন্যূনতম মানবিকতাও কাজ করে না।

বুঝলাম, এটা তরুণ বয়সের সমস্যা। তাহলে বয়স্করা কেন থামায় না। কেন তারা বলে নাÑ আইন নিজের হাতে তুলে নেয়া যাবে না? বলে না সম্ভবত এ কারণে যে, তাদের আসলে আইন আর এর প্রয়োগের ওপর কোনো আস্থাই নেই। এই আস্থাহীনতা কিন্তু ভয়ংকর। আমি নিজেও এমন দেখেছি- কোনো ছিনতাইকারী বা পকেটমার ধরা পড়লো, কেউই তাকে পুলিশের কাছে দিতে চায় না। বলে- দু’চার ঘা সঙ্গে সঙ্গে দিয়ে দিতে। তাদের ধারণা- পুলিশের কাছে দিলে ওর কোন সাজা হবে না, বরং কিছু টাকা দিয়ে তারা ঠিকই বের হয়ে আসবে। ছেলেধরা নিয়েও হয়তো তাদের মধ্যে এমনই অনিশ্চয়তা কাজ করে। সরকার কিংবা কর্তাব্যক্তিরা যা কিছুই বলুন না কেন, পুলিশকে মানুষ কিন্তু বিপদ থেকে উদ্ধারকর্তা মনে করে না, বরং খোদ পুলিশকেই মূর্তিমান বিপদ হিসাবে বিবেচনা করে।

তাহলে এই গুজবের দাপট থেকে বাঁচার উপায় কি? পুলিশ বা সরকারের যে সকল ধমক-ধামক দেখছি, তাতে কাজ হবে বলে মনে হয় না। বরং হিতে বিপরীত হতে পারে। দরকার এখন দক্ষ এবং কার্যকর প্রচারণা। সত্যি ঘটনাটিকে বিশ্বাসযোগ্যভাবে মানুষের সামনে তুলে আনা। তারপর সেটাকে বারবার, বিভিন্ন মিডিয়াতে প্রচার করতে থাকা। সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের লোকজনও এ বিষয়ে তথ্যভিত্তিক বক্তব্য দিতে পারেন, মানুষের মনে নিশ্চয়তা ও নিরাপত্তা দিতে পারেন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছেÑ সরকারের কর্তাব্যক্তিদের ওপর মানুষের সেই আস্থা কি আর ততটা আছে? যদি খোদ কোনো মন্ত্রী বলতে থাকেনÑ এই গুজব আর গণপিটুনির পিছনে বিএনপি-জামায়াতের হাত রয়েছে, তাহলে সেই আস্থাটা কি আর অবশিষ্ট থাকে?

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :