সমানে ছড়াচ্ছে ডেঙ্গু ও আতঙ্ক

দিদার মালেকী
 | প্রকাশিত : ৩১ জুলাই ২০১৯, ০৮:০১

রাজধানী ঢাকার পরে দেশের আরও ৬০ জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে ডেঙ্গুর প্রকোপ। সারাদেশে প্রতিদিনই পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ডেঙ্গু রোগী। আর এ রোগে ভুক্তভোগীর সঙ্গে বিস্তার বেড়েছে আতঙ্কেরও। আক্রান্তদের পাশাপাশি সাধারণ জ¦র নিয়েও হাসপাতালে ছুটছেন আতঙ্কিতরা। এ অবস্থায় স্বাস্থ্য বিভাগের সবারই ছুটি বাতিল করা হয়েছে। ডেঙ্গু ও মশা ঠেকাতে জনসাধারণের প্রতি আহ্বান এসেছে প্রধানমন্ত্রীর তরফে। ডেঙ্গু আক্রান্তদের সিংহভাগই তরুণ বয়সী বলে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয়ের এক গবেষণায় বলা হয়েছে।

নতুনদের নিয়ে এবছর ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার ৩৬৯ জন। আর এখন পর্যন্ত আক্রান্তদের মধ্যে বেসরকারি হিসেবে অন্তত ৪০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে মঙ্গলবার ঢাকায় ২ জন, বরিশালে ২ জন ও গাজীপুরে একজনের মৃত্যু হয়েছে। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের প্রতিবেদনে ডেঙ্গু আক্রান্তদের মধ্যে এখন পর্যন্ত আটজনের মৃত্যু হয়েছে বলে বলা হয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেয়া তথ্য মতে, চারটি জেলা বাদে দেশের প্রায় সব হাসপাতালেই ডেঙ্গু আক্রান্তরা রোগীরা চিকিৎসা নিচ্ছেন। মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ১ হাজার ৩৩৫ জন। আক্রান্তরা দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে ভর্তি হয়েছেন ৯৭৪ জন।

এবার বর্ষার শুরুতেই ঢাকায় মশাবাহিত ডেঙ্গু জ্বরের প্রাদুর্ভাব ঘটে। শুরুতে রাজধানীর দুই সিটিতে ধরা পড়লেও এখন বিভিন্ন জেলা থেকে আক্রান্তের খবর আসছে। মঙ্গলবার দেশের ৬০টি জেলায় ডেঙ্গুরোগী শনাক্ত হওয়ার কথা জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। আগের দিন সোমবার ৫০ জেলায় ডেঙ্গু রোগীর তথ্য পাওয়ার কথা জানিয়েছিল তারা।

ঢাকার বাইরে চিকিৎসকরা বলছেন, বিভিন্ন জেলায় আক্রান্তদের অনেকে ঢাকা থেকে ডেঙ্গু নিয়ে নিয়ে গেছেন। যদিও ঢাকার বাইরেও এডিস মশার বিচরণ রয়েছে বলে স্থানীয় পর্যায়ে আক্রান্তের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না বিশেষজ্ঞরা। ঢাকা থেকে এই রোগ নিয়ে যাওয়ায় সারাদেশেই তা ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে আগেই আশঙ্কা করছিলেন তারা।

মঙ্গলবার সারাদেশে ডেঙ্গু নিয়ে নতুন করে যারা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ২২১ জন ভর্তি হন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত ঢামেকে ৬৭৯ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন ছিলেন।

এ ছাড়া রাজধানীর মিটফোর্ড হাসপাতালে গতকাল নতুন ভর্তি হন ১০৫ এবং মোট চিকিৎসাধীন ২৯৯ জন, ঢাকা শিশু হাসপাতালে নতুন ভর্তি ৪৮ এবং চিকিৎসাধীন ১২১ জন, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নতুন ভর্তি ৬১ এবং চিকিৎসাধীন ২৬৬ জন, হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালে নতুন ভর্তি ৪২ এবং চিকিৎসাধীন ২১৬ জন, বারডেম হাসপাতালে নতুন ভর্তি ১৭ এবং চিকিৎসাধীন ৫২ জন।

আর বিএসএমএমইউতে নতুন ভর্তি ২৬ এবং চিকিৎসাধীন ৯৬ জন, পুলিশ হাসপাতালে নতুন ভর্তি ৩৩ এবং চিকিৎসাধীন ১৩২ জন, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নতুন ভর্তি ৬৩ এবং চিকিৎসাধীন ২৫৩ জন, বিজিবি হাসপাতালে নতুন ভর্তি দুই জন এবং চিকিৎসাধীন ৩০ জন, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে নতুন ভর্তি ৯০ এবং মোট চিকিৎসাধীন আছেন ২৪৭ জন।

ঢাকা শহরের বাইরে ঢাকা বিভাগের জেলাগুলোতেই সবচেয়ে বেশিসংখ্যক ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। ঢাকা বিভাগের বিভিন্ন জেলার হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু নিয়ে ভর্তি হয়েছেন ১০৪ জন। আর তাদের নিয়ে মোট চিকিৎসাধীন আছেন ১৯১ জন। অর্থাৎ এই বিভাগের জেলাগুলোতে গতকাল সর্বাধিক ডেঙ্গু আক্রান্ত হাসপাতালে গেছেন।

ঢাকা বিভাগের পর খুলনা বিভাগের বিভিন্ন জেলায় নতুন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন ৫৬ এবং মোট চিকিৎসাধীন ১৫১ জন। রাজশাহী বিভাগে নতুন ৫৬ জন নিয়ে মোট চিকিৎসাধীন ১৯৮ জন। চট্টগ্রাম বিভাগে নতুন ৫৫ জন গতকাল ভর্তি হয়েছেন হাসপাতালে। এই বিভাগে মোট চিকিৎসাধীন ১০৪ জন।

সিলেট বিভাগে নতুন ৫৫ এবং মোট চিকিৎসাধীন ৭০ জন। রংপুর বিভাগে নতুন রোগী ২০ এবং মোট চিকিৎসাধীন ৮৩ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে নতুন রোগী নয়জন এবং মোট চিকিৎসাধীন ২৫ জন, বরিশাল বিভাগে নতুন শনাক্ত ছয়জন এবং মোট হাসপাতালে ভর্তি ২৫ জন।

মন্ত্রীর দপ্তরে সেল গঠন

ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসা কার্যক্রম তদারকিতে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক তার নিজের দপ্তরে ‘মিনিস্টার মনিটরিং সেল’ গঠন করেছেন। সেল থেকে ডেঙ্গু সংক্রান্ত জনভোগান্তি নিরসনে এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের চলমান কর্মকা- তদারকি করা হবে।

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, ডেঙ্গু রোগ পরীক্ষার ফি সংক্রান্ত সরকারি নির্দেশনার লংঘন হলে তার অভিযোগ গ্রহণ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে ‘মিনিস্টার মনিটরিং সেল’।

এই সেলের আওতায় ডেঙ্গু নিয়ে যে কোনো অনিয়ম সম্পর্কে অভিযোগ জানাতে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। এজন্য হটলাইন নম্বরগুলো হল: ০১৩১৪-৭৬৬০৬৯/ ০১৩১৪-৭৬৬০৭০, ০২-৪৭১২০৫৫৬/০২-৪৭১২০৫৫৭।

এদিকে গত সোমবারের এক সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ডেঙ্গু ও বন্যাজনিত কারণে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর ছুটি বাতিল করা হয়েছে।

এবছর ডেঙ্গু আক্রান্তের লক্ষণ ও উপসর্গ পাল্টে মারাত্মক হয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। কারও জ্বর হলে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যাওয়া, ডেঙ্গু ধরা পড়লে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া এবং এমনকি রোগ সারার পরেও সজাগ থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন তারা।

মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু বাংলাদেশে প্রথম দেখা দেয় ২০০০ সালে। ওই বছর এই রোগে মৃত্যু হয় ৯৩ জনের। তার তিন বছর পর ডেঙ্গুতে মৃত্যুর হার ক্রমাগত কমে কয়েক বছর এতে মৃত্যু শূন্যের কোটায় নেমে আসে। তবে গত বছর আবার ব্যাপকভাবে দেখা দেয় ডেঙ্গুর প্রকোপ। গেল বছর ১০ হাজার মানুষ আক্রান্ত হওয়ার পাশাপাশি ২৬ জনের মৃত্যু হয় বলে সরকারি হিসাবে উঠে আসে।

এদিকে জীবাণুবাহী এডিস ইজিপ্টি মশা নিধনে ঢাকার দুই সিটি মেয়রকে নিয়ে সমালোচনা তীব্র হয়েছে। তবে এডিস মশা সাধারণত বাসাবাড়িতে পরিষ্কার পানিতে জন্মায়। বাড়ির ভেতরে বিভিন্ন উৎসে জন্মানো এডিস মশা পরে বাড়ির লোকজনের ওপর আক্রমন করে। এ ছাড়া বিভিন্ন নির্মাণাধীন ভবনের জলাধার, লিফটের নিচে জমে থাকা পানি, ফুলের টব, টায়ার-টিউবসহ যেসব জায়গায় পানি জমে, সেগুলোই এডিস মশার বংশ বিস্তারের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে। ফলে এডিস মশা ও ডেঙ্গু ঠেকাতে জনসচেতনার বিকল্প নেই বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। আর তেমন তাগিদই গতকাল দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

ডেঙ্গুতে আক্রান্তদের বেশির ভাগই তরুণ-তরুণী

এবছর ডেঙ্গুতে আক্রান্তদের মধ্যে তরুণ-তরুণীরাই বেশি। ১৬ থেকে ৩০ এর মধ্যে তরুণরাই আক্রান্ত হচ্ছেন। আর নারীদের তুলনায় পুরুষের আক্রান্তের হারও এবছর বেশি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সাইফ উল্লাহ মুন্সী গবেষনা প্রতিবেদনের বরাতে এমন তথ্যই দিয়েছেন।

গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু মেডিকেলের ডেঙ্গু সেলের কার্যক্রম ও চলমান ডেঙ্গু প্রাদুর্ভাব ও সাম্প্রতিক গবেষণার ফলাফলসহ বিস্তারিত বক্তব্য তুলে ধরেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়–য়া।

এরপর সাইফ উল্লাহ মুন্সী জানান, তাদের হিসাব অনুযায়ী ১ জানুয়ারি থেকে ২৫ জুলাই পর্যন্ত ছয় হাজার ১২৯ জনের মধ্যে ১২৭৮ জনের অর্থাৎ ২১ শতাংশ ডেঙ্গু ধরা পড়েছে। আক্রান্তদের মধ্যে নারী ও পুরুষ অনুপাত হলো ১:২.৭।

তিনি বলেন, ‘বর্তমানে চার ধরনের বা সেরোটাইপের ডেঙ্গু ধরা পড়ছে। আক্রান্তদের মধ্যে বেশির ভাগই পুরুষ। ১৬-৩০ বছরে মানুষ বেশি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে। আক্রান্তদের মধ্যে ২৬ শতাংশ এনএস১ পজেটিভি, ৬ শতাংশ আইজিএম পজেটিভ, ৫ শতাংশ আইজিএম ও আইজিজি পজেটিভ।’

২০০০ সালের ডেঙ্গু প্রাদুর্ভাবের সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগে প্রথম ডেঙ্গু সেরাটাইপ নির্ণয় করা হয়। পরবর্তীকালে ২০১৩ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত এ-সংক্রান্ত গবেষণা পরিচালিত হয়। দুই বছর বিরতির পর চলতি বছর আবার গবেষণা ফলাফল প্রকাশ করা হচ্ছে।

ঢাকাটাইমস/৩০জুলাই/ডিএম

সংবাদটি শেয়ার করুন

জাতীয় বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :