যে কারণে এবার ডেঙ্গুতে মৃত্যু বেশি

আশিক আহমেদ, ঢাকাটাইমস
 | প্রকাশিত : ০১ আগস্ট ২০১৯, ০৮:২০

ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তের সংখ্যা রেকর্ড ছাড়িয়ে যাওয়ার পাশাপাশি এবার মৃতের সংখ্যা সাম্প্রতিক বছরগুলোর তুলনায় বেশি। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, যারা মারা গেছে তাদের মধ্যে বহুজন দ্বিতীয়বারের মতো আক্রান্ত হয়েছেন এই জ্বরে। আবার আক্রান্ত হওয়ার পর চিকিৎসা নিতে বিলম্ব করাও একটি কারণ।

চলতি বছর এখন পর্যন্ত ৫০ জনের বেশি রোগীর মৃত্যুর তথ্য এসেছে গণমাধ্যমে। এর চেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যুর তথ্যও আছে। ২০০০ সালে প্রথমবারের মতো ডেঙ্গুর প্রকোপের বছরে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল এর চেয়ে বেশি। ওই বছর মারা যায় ৯৩ জন। তবে এরপর প্রতি বছর মৃতের সংখ্যা ক্রমেই কমেছে। এক পর্যায়ে কয়েক বছর মৃত্যুর তথ্যও আসেনি।

তবে গত তিন বছর ধরেই মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। ২০১৬ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় ১৪ জনের। দুই বছর পর ২০১৮ সালে মৃতের সংখ্যা হয় ২৬।

চলতি বছর মৃতের সংখ্যা কেন বাড়ছে- এমন প্রশ্নের জবাবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আহমেদুল কবির ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমরা পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি গত বছর যারা ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন, এ বছর তাদের মৃত্যুই বেশি হয়েছে। ডেঙ্গুর ন্যাচারটাই এমন যারা গত বছরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন তারা হয়তো বুঝতেই পারেননি। তারা এবার আক্রান্ত হয়েছে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।’

আবার চার ধরনের ডেঙ্গুর মধ্যে এবার কোন ধরনের ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি-এই বিষয়টি নিয়েও কাজ করা হয়নি। এটাও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ার একটি কারণ বলে ধারণা করা হচ্ছে।

হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন অঙ্গ যেমন কিডনি, লিভার, ফুসফুস ও হার্ট আক্রান্ত হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা অকার্যকরও হয়ে পড়ছে। এডিস মশা শরীরে কামড় দেওয়ার পর রক্তের মনোসাইটে অনিয়ন্ত্রিতভাবে জীবাণু বংশবিস্তার করে। প্রবহমান রক্তের মাধ্যমে জীবাণু হার্ট, লাং, লিভার ও কিডনিতে প্রবেশ করে অধিক হারে বংশবিস্তার করে এসব গুরুত্বপূর্ণ কোষের কার্যকারিতা নষ্ট করে। বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কোষঝিল্লিতে আক্রমণ করে প্রদাহের সৃষ্টি করে। কিডনির মূত্র উৎপাদনের কার্যকারিতা হ্রাস পায় এবং লিভার অকার্যকর হয়।

চলতি বছর ডেঙ্গুর ধরনও ভিন্ন। চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা, ডেঙ্গু জ্বরের অন্যতম লক্ষণ ছিল শরীরে র‌্যাশ থাকা। কিন্তু চলতি বছর রোগীদের শরীরে এই র‌্যাশ দেখা যাচ্ছে না। জ্বর হওয়ার পরও চিকিৎসকরা বুঝতে পারছেন না। হেমোরেজিক ডেঙ্গু এবার বেশি হচ্ছে। রক্তের প্লাটিলেট কমে যাচ্ছে। রক্তপাতের ঝুঁকি বেশি থাকায় বেশি মৃত্যু হচ্ছে।

চিকিৎসক আহমেদুল কবির বলেন, ‘সাধারণ জ্বরে আক্রান্ত হলে আমরা তিন দিন অপক্ষো করে চিকিৎসকের পরামর্শ নেই। কিন্তু এখন জ্বরে আক্রান্ত হলে দেরি করা চলবে না। প্রথম দিনে না হলেও দ্বিতীয় দিনের জ্বরে রোগীর অবস্থা খারাপ হয়ে যেতে পারে।’

ঢাকা মেডিকেলের মেডিসিন বিভাগের আরকে সহযোগী অধ্যাপক রোবেদ আমিন বলেন, ‘যারা সিভিআর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়, তাদের শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ নষ্ট হয়ে যায়। মস্তিস্ক, হার্ট, লিভার, কিডনি ইত্যাদি অংশ কাজ করে না। ফলে তাদের মৃত্যু হয়।’

এ জ্বর অনেক ক্ষেত্রে কম হতে পারে, আবার বেশিও হতে পারে। দেখা যায়, জ্বর তিন-চার দিন পর ভালো হয়ে যায়। তবে এরপর প্লাটিলেট কম হতে থাকে। এরপর মাঝখানে একটি বিরতি দিয়ে আবার জ্বর আসে। এই জ্বরের সঙ্গে প্রচণ্ড মাথাব্যথা, শরীর ব্যথা এবং চোখের পেছনে ব্যথা হতে পারে। জ্বর সাধারণত দুই দিন থাকার পর শরীরের বিভিন্ন জায়গায় র‌্যাশ দেখা যায়। তবে বিপত্তি হচ্ছে, এবার এই লক্ষণগুলো দেখা যায়নি। আর আক্রান্তরা বুঝতে না পারায় চিকিৎসা নিতে বিলম্ব করছেন অনেকাংশে।

এই জ্বরে যেহেতু পানিশূন্যতা বেশি হয়, তাই প্রসাবের পরিমাণ কমে যেতে পারে। এতে কিডনি বিকল হওয়ার আশঙ্কা থাকে। ঘাম হতে পারে। বমি বমি ভাব হতে পারে, খাবারে অরুচি হতে পারে। অন্যান্য ভাইরাস জ্বরের যে লক্ষণ, সেগুলোও প্রায় সবই ডেঙ্গু জ্বরে থাকবে।

চিকিৎসকরা বলছেন ডেঙ্গু জ্বরের জীবাণুবাহী মশা কাউকে কামড়ালে চার থেকে ছয় দিনের মধ্যে তিনি ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হতে পারেন।

ডেঙ্গু ভাইরাস চার ধরনের হয়ে থাকে। তাই ডেঙ্গু জ্বরও চারবার হতে পারে। যারা আগেও ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে পরবর্তী সময়ে ডেঙ্গু হলে তা মারাত্মক হওয়ার ঝুঁকি থাকে। যাদের ডায়বেটিস ও হাঁপানির মতো রোগ রয়েছে তাদের জন্য ডেঙ্গু প্রাণঘাতী হতে পারে।

কখন ডাক্তার দেখাবেন

চিকিৎসকরা বলছেন, সাধারণ ভাইরাস জ্বরে তিন দিন পর পরীক্ষা করলে তা শনাক্ত করা যায়। কিন্তু এখন পরিস্থিতি জটিল পর্যায়ে গেছে। ডেঙ্গু হলে সেটা আগেই ধরা পড়ে। তাই জ্বর আসার সঙ্গে সঙ্গে সচেতন হতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী রক্ত পরীক্ষা করতে হবে। তবে জ্বর এলেই যে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে বা আতঙ্কিত হতে হবে, তা নয়।

প্রখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, ‘ডেঙ্গু হার্টের মাংসপেশীর বলয় ভেঙে সেখানে আক্রমণ করে কার্যকারিতা হ্রাস করে। সেরোটাইপ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ব্যক্তির মস্তিস্কে তীব্র প্রদাহের সৃষ্টি করে। এসব রোগী যথাসময়ে চিকিৎসা না পেলে তাদের মৃত্যু হতে পারে। তাই শরীরে কোনো ধরনের জ্বর অনুভব করলে অবহেলা না করে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ওষুধ সেবন করতে হবে।’

ডেঙ্গুর ধরন পরীক্ষার পরামর্শ চিকিৎসকদের

চার ধরনের সেরোটাইপ ডেঙ্গু রয়েছে। এগুলোকে ডিইএনভি-১, ডিইএনভি-২, ডিইএনভি-৩ এবং ডিইএনভি-৪ বলা হয়। এর মধ্যে কোনটির প্রকোপ এবার বেশি বা ঝুঁকিপূর্ণ সেটি শনাক্ত করা যায়নি এখনো। আর বিশেষজ্ঞরা এই বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলেছেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (সংক্রামক ব্যাধি) বেনজীর আহম্মেদ জানান, কোন টাইপের ডেঙ্গু সেটি নির্ধারণ অত্যন্ত জটিল এবং সব প্রতিষ্ঠানে তা করাও সম্ভব নয়। তবে ধরণ নির্ধারণ জরুরি। অন্যথায় রোগীর চিকিৎসাবঞ্চিত হওয়ার ঝুঁকি থাকবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সাবেক পরিচালক মাহমুদুর রহমান বলেন, সেরোটাইপ ডেঙ্গু এবং বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি গত বছর থেকেই লক্ষ্য করা গেছে। এবার তা ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। তবে বিষয়টি এখনো নতুন, তাই স্বচ্ছ ধারণার জন্য অধিকতর গবেষণা প্রয়োজন।

ঢাকাটাইমস/১আগস্ট/এএ/ডব্লিউবি/এমআর

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিশেষ প্রতিবেদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন এর সর্বশেষ

কথায় কথায় মানুষ পেটানো এডিসি হারুন কোথায়? থানায় ছাত্রলীগ নেতাদের মারধরের তদন্ত কোথায় আটকে গেল?

মজুত ফুরালেই বাড়তি দামে বিক্রি হবে সয়াবিন তেল

কোন দিকে মোড় নিচ্ছে ইরান-ইসরায়েল সংকট

ছাদ থেকে পড়ে ডিবি কর্মকর্তার গৃহকর্মীর মৃত্যু: প্রতিবেদনে আদালতকে যা জানাল পুলিশ

উইমেন্স ওয়ার্ল্ড: স্পর্শকাতর ভিডিও পর্নোগ্রাফিতে গেছে কি না খুঁজছে পুলিশ

জাবির হলে স্বামীকে বেঁধে স্ত্রীকে জঙ্গলে ধর্ষণ, কোথায় আটকে আছে তদন্ত?

নাথান বমের স্ত্রী কোথায়

চালের বস্তায় জাত-দাম লিখতে গড়িমসি

গুলিস্তান আন্ডারপাসে অপরিকল্পিত পাতাল মার্কেট অতি অগ্নিঝুঁকিতে 

সিদ্ধেশ্বরীতে ব্যাংক কর্মকর্তার মৃত্যু: তিন মাস পেরিয়ে গেলেও অন্ধকারে পুলিশ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :