ডাক্তার-সাংবাদিক: দা-কুমড়ো

প্রকাশ | ০৩ আগস্ট ২০১৯, ২৩:২২

মাজহার মিলন

সরকার স্বীকার করুক আর না করুক, দেশে মহামারী হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে ডেঙ্গু। প্রতিদিনই কেউ না কেউ স্বজন হারাচ্ছেন, হাজার হাজার নতুন রোগী সংক্রমিত হবার খবর মিলছে ঘণ্টায় ঘণ্টায়। দেশের বিপদের এই মুহূর্তে সবচেয়ে দায়িত্বশীল মানুষেরা হচ্ছেন ডাক্তাররা। তারা না থাকলে পরস্থিতি কোন দিকে গড়াত তা ভাবতে পারছি না। নিজের স্বাস্থ্য, পরিবার ভুলে তারা সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে দিনরাত এক করে কাজে করে যাচ্ছেন।

তাই পুরো দেশ মিলে ডাক্তারদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানো কিংবা তাদের বন্দনা করলেও এই ঋণ শেষ হবে না। এই অবস্থা শুধু এখন না, ছয় মৌসুমের দেশে মৌসুমী রোগের যেমন অভাব নেই, তেমন ডাক্তারদেরও হাঁফ ছেড়ে বসার ফুসরত মেলে বলে আমার মনে হয় না। অবশ্য আম-পাবলিক একটু সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরে ডাক্তারের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধারে তৎপর হন, নিয়ম করে। এটি বাস্তবতা। তা নিয়ে ডাক্তাররা মুখ ভারী করে বসে থাকলে চিকিৎসা ব্যবস্থা ভেঙে পড়ত প্রতিদিন, অষ্টপ্রহর। কিন্তু যেহেতু মানুষের জীবন-মরণের মাঝখানে ডাক্তারদের অবস্থান, তারা নিয়ম করে রোগী দেখে যান, মনে যত কষ্টই থাকুক।

অন্যদিকে পেশা হিসেবে সাংবাদিকতা বোধ হয় এই সময়ের সবচেয়ে ঘৃণ্য হিসেবে বিবেচিত। নিশ্চয়ই যৌক্তিক কারণ আছে। কোন কোন সাংবাদিক জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যে সাধারণ মানুষের জন্য, তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য দিনরাত দৌড়ায়, যাদের কারণে প্রভাবশালী দুর্নীতিবাজ, মন্ত্রী-এমপি, পুলিশ-গুণ্ডা সবার সাথে শত্রুতা করে, তারাই দিন শেষে গালি দেয়। অফিসে গালি খায়, বাসায় গালি খায়, রাস্তায় গালি খায়, আড্ডায় গালি খায়, যুত মতো পড়লে একদিন হয়ত কোন ডোবায় লাশও ভাসবে। এর পেছনে কিছু সাংবাদিক কিংবা সহকর্মীদের দায় রয়েছে। কিন্তু এই দেশের মানুষের কথা শুনলে মনে হয়, সাংবাদিকরা কখনও ইতিবাচক কিছু করেনি, তারা সমাজের শত্রু।

ডাক্তাররাও সেভাবেই দেখবেন, সেখানে বিস্ময়ের কিছু নেই। কারণ এই দেশে হলুদ সাংবাদিকের সংখ্যা খুব কম নয়, সম্ভবত অর্ধেকই এই রংয়ের।

আমি প্রতিবাদ করি না। কারণ এই দেশে সবচেয়ে মহান পেশার ডাক্তারদেরও মানুষ কসাই বলে। অথচ ৮০-৯০ শতাংশ ডাক্তার মানুষের সেবাকেই একমাত্র ব্রত হিসেবে নিয়েছেন। বাকিরা অঢেল টাকা কামিয়ে ভাল থাকার জন্য ডাক্তার হয়েছেন, সেভাবেই ডাক্তারি করে যাচ্ছেন। এই দেশে রোগীর ট্যাক থেকে পয়সা খসাতে অকারণ হাজার রকম টেস্ট দেয়া ডাক্তারের অভাব নেই, হাসপাতালের নিয়ম মেনে মৃত রোগীকে দিনের পর দিন আইসিইউতে রাখার ঘটনাও বিরল নয়। আবার রোগীর সামর্থ অনুযায়ী ফি নেয়ার মত ডাক্তারও আমি কম দেখিনি, বিনা পয়সায় রোগী দেখা ডাক্তারও আছেন। কিন্তু পারসেপশান হল, ডাক্তার মানে কসাই।

এটা ভাবার কারণ নাই যে, সাংবাদিকরা এই পারসেপশান তৈরি করেছে। বরং এটা সাধারণ মানুষের নিত্যদিনের অভিযোগ। এই দেশের স্বাস্থ্যব্যস্থার নানা অসংগতি-দুর্বলতা-অনিয়মের দায়টা সোজা ডাক্তারদের ঘাড়ে গিয়ে পড়ে। তারা ব্যথিত হন, আমার মতো যারা ভাল এবং ভালোমানুষ ডাক্তার দেখে দেখে অভ্যস্ত তারাও কষ্ট পান। তারা অভিযোগ করেন, ভাঙচুর করেন, সাংবাদিকরা সেটা প্রচারও করেন। কিন্তু ডাক্তাররা কেন যেন সাংবাদিকদেরই দায়ী করেন বসেন। ভালো-মন্দ নাই, সাংবাদিক মানেই ডাক্তারদের বদনাম করতে এসেছে, এই ধারণা কিংবা ভয় তারা অভিযোগে রূপ দেন। অদ্ভুত এক ডিলেমা।

আমি নিশ্চিত, ডাক্তাররা ভুল বোঝেন। ভুল চিকিৎসায় রোগী মারা গেছেন, এটা কোন টিভি/পত্রিকার জন্য খুব আকর্ষণীয় কোন খবর নয়। সাংবাদিক এমন কোন সংবাদ নিয়ে এলে খুব আগ্রহ নিয়ে তা প্রকাশিত হয় না। প্রকাশিত হয় তখন, যখন এটা নিয়ে রোগীর স্বজনেরা তুলকালাম করেন, ভাংচুর করেন, আন্দোলনে নামেন, তা ছড়িয়ে পড়ে। হাজার রকম অনিয়মে ভরা দেশে একজন ভুল চিকিৎসায় একজন রোগীকে মেরে ফেলেছে, এটা প্রচার করে একজন সাংবাদিক কি লাভ করবেন, এটা ভাবার অনুরোধ করছি ডাক্তার ভাই-বোনদের।

সাংবাদিকদের দায় অন্য জায়গায়। তারা এ সংক্রান্ত কোন নিউজ করার আগে অবশ্যই সবটুকু জেনে নিউজ করবেন। ডাক্তার-হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অবস্থান/ব্যাখ্যা, অন্য বিশেষজ্ঞরা এ নিয়ে কি ভাবছেন তা বুঝে তারপর নিউজ করা উচিত। একজন ডাক্তার ইচ্ছে করে রোগী মেরে ফেলবেন না, এই কমনসেন্স নিয়ে নিউজ সংগ্রহ শুরু করা দরকার। ক্রিটিক্যাল মুহুর্তে থাকা একজন রোগীর হাজার রকম কমপ্লিকেশন থাকতে পারে। একদিক বাগে আনতে আরেকদিকে বিগড়ায়, যে কোন সময় যে কোন কিছু হতে পারে, একজন সাংবাদিক হিসেবে এই বিষয়গুলো মাথায় রাখলে নিউজ করা সহজ হয়, সেটি সব পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়। হাসপাতাল কিংবা ডাক্তারের অবহেলায় রোগী মারা যেতে পারে, কংক্রিট তথ্যপ্রমাণ হাতে না নিয়ে তা প্রকাশ করার সুযোগ নাই। অভিযোগ আসলেই তা প্রকাশ করা সংবাদিকতা নয়, এই সাধারণ জ্ঞানটুকু না থাকলে তার জন্য সাংবাদিকতা না। ব্যঙ্গের ছাতার মত গজিয়ে ওঠা মিডিয়া হাউজগুলোর ম্যানেজমেন্টেরও এই বিষয়টি দেখা দরকার।

কেন লিখছি, তার ব্যাখ্যা দিতে গেলে শেষ হবে না। বরং মূল কথায় আসা যাক। সাম্প্রতিক ডেঙ্গু পরিস্থিতিতে দেখা যাচ্ছে, আমাদের ডাক্তার ভাই-বোনেরা সংবাদকর্মীদের আচরণে যারপরনাই বিরক্ত। অবশ্যই সুনির্দিষ্ট কারণ আছে। হঠকারিতা, ফালতু প্রতিযোগিতা, অযথা দোষারোপ, পরিস্থিতি না বুঝে ডাক্তারদের কাছে অনাবশ্যক জবাবদিহি চাওয়া এর বড় কারণ বলে মনে হয়েছে আমার। এবং এটা নিয়ে ডাক্তাররা সাংবাদিকরা কত খারাপ তা ঢালাও করে বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে বলে যাচ্ছেন। এই অবস্থা সাংঘর্ষিক, অনভিপ্রেত। ঢালাও অভিযোগের বিষয়টি অনেকটা ঢালাওভাবে ডাক্তারদের কসাই বানানোর মত। এতে যে সাংবাদিকরা সহমর্মী সহযোদ্ধা হয়ে কাজ করতে চাইছেন, তারা আহত হন।

আমি এমন লেখা দেখেছি, যে ডাক্তার ভাই-বোনেরা নিশ্চিত না হয়েই সাংবাদিকদের ওপর দোষারোপ করেছেন, পরে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে তিনি আরেকজনের মুখে শুনে এই অভিযোগ করেছেন।

তারপরও সাংবাদিকদের অপেশাদারত্বের দায় মেনে নিয়ে ডাক্তার ভাইবোনদের প্রতি করণীয় নিয়ে কিছু বলতে চাই। আশা করি, আমাদের মধ্যে অহেতুক ভুল বোঝাবুঝি দূর হতে পারে এতে।

*আপনার পক্ষে সম্ভব হলে তাকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করুন। অথবা কয়েক সেকেন্ড নষ্ট করে হলেও তাকে তথ্য পাওয়ার উপায় বলে দিন। বিশ্বাস করুন, সে এই তথ্য নিয়ে বাড়িতে রান্না করে খাবে না, পরিস্থিতি সম্পর্কে মানুষকে জানাবে।

*কোন সাংবাদিক হাসপাতালের পরিবেশ/হাইজিন নষ্ট করছে দেখলে তাকে সরে যেতে বলুন। না মানলে পরিচয় জেনে তার অফিসে ফোন করুন। অনলাইনে প্রায় প্রত্যেক টিভি-পত্রিকার ঠিকানা/ফোন নম্বর পাওয়া যায়। দরকার হলে আশপাশে থাকা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী অথবা সিকিউরিটির সাহায্য নিন।

*সাংবাদিক পরিচয়ে অন্যায্য দাবি করলে তাকে চ্যালেঞ্জ করুন, তার পরিচয় জেনে বসের সাথে কথা বলুন। সম্ভব হলে তার ছবি তুলে রাখুন, কি অন্যায্য দাবি তুলছে তার প্রমাণ রাখুন সম্ভব হলে।

*কোথায় কোন সাংবাদিক অন্যায্য, হঠকারি আচরণ করছেন, তা আপনার কর্তৃপক্ষকে জানান। দরকার হলে অফিসিয়ালি অভিযোগ করুন। সাংবাদিকরা জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে নন।

*কোথাও কোন সাংবাদিক অযথা বিশৃঙ্খলা তৈরি করলে আমাকে জানান। আমি তার এবং তার কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলার চেষ্টা করব। ইনবক্স করতে পারেন অথবা [email protected] -এ আমাকে পাওয়া যাবে।

আমার সহকর্মী সাংবাদিক বন্ধুদের জন্য নিচের ছবিটি। নিজের মূল্যায়ন নিজেই করুন। (২০১৭ সালের ছবি হলেও নতুন করে সামনে আসা ছবি এটি)।

সাংবাদিক বন্ধুদের এক কথায় বলতে চাই, আপনি ডাক্তার কিংবা রোগীর ঘাড়ে চেপে বসেও একটা এডিস মশার কেশ উৎপাটন করতে পারবেন না। এতদিনেও পারেন নাই। সবচেয়ে ভাল ছবিটা আপনার দরকার হতে পারে কিন্তু আপনি যেভাবে তা পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন তা একজন রোগীকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে পারে। ডাক্তাররা তাদের কাজ করছেন, তাদেরকে সহযোগিতা করুন, তাদের প্রতি সহমর্মী হোন। সংবাদ জরুরি হলেও মানুষের জীবনের চেয়ে নয়। আর ডাক্তাররা মানুষের জীবন নিয়ে ডিল করেন।

ডাক্তার ভাইবোনরা একটু মনে রাখুন, অনেকেই অনেক ছাড় দিয়ে সাংবাদিকতা করেন। মানুষের বৃহত্তর কল্যাণের আশায়। গায়ের রং কিংবা পোশাক যেমনই হোক, সবার মনের রং হলুদ নয়।

লেখক: সাংবাদিক, মাছরাঙ্গা টেলিভিশন