আজন্ম প্রতিবাদী বঙ্গবন্ধু

আরিফুর রহমান দোলন
| আপডেট : ০৪ আগস্ট ২০১৯, ০৯:৩৮ | প্রকাশিত : ০৪ আগস্ট ২০১৯, ০৯:৩৫

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ন্যায়ের পক্ষে প্রতিবাদী এক নাম। শৈশব থেকেই যার মেধা-মননে জায়গা করে নিয়েছে প্রতিবাদের ভাষা। যেখানে অন্যায় দেখেছেন সেখানেই কণ্ঠ ছেড়েছেন ন্যায়ের পক্ষে। নিজের জীবনের তোয়াক্কা না করে নিপীড়িত, নিষ্পেষিত মানুষের অধিকার আদায়ে লড়েছেন আমৃত্যু।

নির্যাতন এসেছে। অত্যাচারের খড়্গ নেমেছে। বার বার তাঁকে যেতে হয়েছে কারাগারে। পরিবার-পরিজন ছেড়ে দিনের পর দিন একা কাটিয়েছেন কারাকক্ষে। তবু ন্যায়ের পথ থেকে পিছু হটেননি। এ গুণটি তাঁর কিশোর জীবনেই ফুটে উঠেছে। বাবা বাসায় খবরের কাগজ আনতেন। তখনকার সময়ে আনন্দবাজার, বসুমতী, আজাদ, মাসিক মোহাম্মদী ও সওগাত ছিল আলোচিত পত্রিকা। ছোটবেলা থেকে পত্রপত্রিকা পড়ে দেশ-বিদেশের নানা বিষয়ে খবর তিনি জানার চেষ্টা করতেন। বুঝতে শেখার পর থেকেই রাজনীতির খবরাখবর রাখতেন। সাধারণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশা তাঁর হৃদয়ের গভীরে স্পর্শ করত। তিনি অসহায় মানুষের কথা ভাবতেন। কী করে তারা ভালো থাকতে পারে, মুক্তি পেতে পারে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য থেকে- সেই পথ খুঁজতেন। এমন অনেক ঘটনার কথা আমরা জানতে পারি তাঁর জীবনভিত্তিক রচনা থেকে।

১৯৪০ সাল। শেখ মুজিব তখন স্কুলে পড়েন। সরকারি নিষেধ অমান্য করে স্কুল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদ সভা করার দুঃসাহসের কারণে তাকে গ্রেফতার করা হয়। পরে ছাত্রদের তোপের মুখে ছেড়েও দেওয়া হয় তাঁকে। স্কুল পরিচালনা কমিটির কার্যকলাপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জন্য ডাকা সভার উদ্যোক্তা ও নেতা ছিলেন মুজিব। সভাটি যেন না হয় এজন্য জোর চক্রান্ত হয়েছিল। এলাকার উদীয়মান রাজনৈতিক নেতা ওয়াহিদুজ্জামান অনেক কূটকৌশল করেছিলেন। তিনি শেখ পরিবারের ছেলে মুজিবকে ভালো চোখে দেখতেন না। প্রশাসক কাজী গোলাম আহাদ ছিলেন তাঁর আত্মীয়। তিনি কাজী আহাদকে বলে সভা এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করান। বুদ্ধিমান শেখ মুজিবুর রহমানও বেশ কৌশলে সভার স্থান পরিবর্তন করে স্থানীয় মসজিদের সামনে সভা শুরু করেন। তিনি কিছু বলা শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। মুজিবকে ‘সেকেন্ড কোর্টে’ হাজির করা হলে তাঁর পেছনে পেছনে একদল ছাত্র আদালত এলাকায় গিয়ে স্লোগান দেয়- হয় আমাদের মুজিব ভাইকে ছেড়ে দাও, নইলে আমাদের সবাইকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠাও। অবস্থা সুবিধার না দেখে ঘণ্টা দুই পরে আদালত থেকেই শেখ মুজিবকে ছেড়ে দেওয়া হয়। ছেলেরা তাদের প্রিয় মুজিব ভাইকে কাঁধে তুলে বিজয় মিছিল করে ফিরে আসে। প্রতিবাদী বঙ্গবন্ধুর জীবনে এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে। যেখানে তাঁর প্রতিবাদের কাছে হেরে গেছে শাসকগোষ্ঠী। জয় হয়েছে ন্যায়ের।

একবার এ কে ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর গোপালগঞ্জ আগমন উপলক্ষে কৃষক-প্রজা পার্টি ও মুসলিম লীগ সংবর্ধনার আয়োজন করল। শেখ মুজিব বয়সে একটু বড় ছিলেন। সভার জন্য স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী করার দায়িত্ব পড়ল তাঁর ঘাড়ে। তিনি ছাত্রদের নিয়ে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী করলেন। একসময় দেখলেন হিন্দু ছাত্ররা সব স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী ছেড়ে সরে পড়ছে। তিনি ব্যাপারটি বুঝতে পারলেন না। ঘনিষ্ঠ এক হিন্দু বন্ধুর কাছে কারণ জানতে চাইলেন। ওই বন্ধু জানালেন কংগ্রেস থেকে তাদের সভায় যোগ দিতে নিষেধ করা হয়েছে। মূলত ফজলুল হক সাহেব মুসলিম লীগের সঙ্গে মিলে মন্ত্রিসভা করায় হিন্দুরা খেপে গিয়েছিল। কংগ্রেস চেয়েছিল কোনোভাবেই যেন গোপালগঞ্জে সভাটা না হয়। হক সাহেব ও সোহরাওয়ার্দী সাহেব যেন না আসতে পারেন। তবে শেখ মুজিব দায়িত্ব নিয়ে তখন সভা বাস্তবায়নে বড় ভূমিকা রাখেন। অতিথিরা গোপালগঞ্জে আসেন। শান্তিপূর্ণভাবে সভাও অনুষ্ঠিত হয়। সভা শেষে তাঁরা ভালোভাবেই ফিরে যান। এর পরের ঘটনা বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পড়লে জানা যায়।

ওই সময় একটা ঘটনা ঘটে। হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে রেষারেষি চলছিল। গোপালগঞ্জ শহরের আশপাশেও হিন্দু গ্রাম ছিল। দু-একজন মুসলমানের ওপর অত্যাচারও হলো। আবদুল মালেক নামে বঙ্গবন্ধুর এক সহপাঠী ছিলেন। তিনি খন্দকার শামসুদ্দীন সাহেবের আত্মীয় হতেন। একদিন সন্ধ্যায়, সম্ভবত তখন মার্চ বা এপ্রিল মাস হবে। বঙ্গবন্ধু ফুটবল মাঠ থেকে খেলে বাড়ি এসেছেন। তখন খন্দকার শামসুল হক, ডাকনাম বাসু মিয়া মোক্তার সাহেব তাঁকে ডেকে বললেন, মালেককে হিন্দু মহাসভা সভাপতি সুরেন ব্যানার্জির বাড়িতে ধরে নিয়ে মারধর করছে। বঙ্গবন্ধুকে তিনি সেখানে গিয়ে মালেককে নিয়ে আসার জন্য বললেন। বন্ধুর কথা শুনে শেখ মুজিব দেরি করলেন না। তিনি কয়েকজন ছাত্রকে সঙ্গে নিয়ে ওই বাড়িতে যান এবং তাঁর বন্ধুকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। রমাপদ দত্ত নামে এক লোক তাঁকে দেখেই গালাগাল করতে লাগল। মুজিব তার প্রতিবাদ করলেন। পাশাপাশি তাঁর ঘনিষ্ঠদের খবর দিতে বললেন। এর মধ্যে রমাপদরা থানায় খবর দিয়েছে। তিনজন পুলিশ এসেছে। শেখ মুজিব বললেন, তাঁর বন্ধুকে ছেড়ে দিতে হবে। তা না হলে তিনি কেড়ে নেবেন।

বঙ্গবন্ধুর মামা শেখ সিরাজুল হক তখন হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করতেন। তিনি ভাগনের খবর শুনে লোকজন নিয়ে ছুটে আসেন। এর মধ্যে মারপিট শুরু হয়েছে। দুই পক্ষে বেশ মারপিট হলো। একপর্যায়ে দরজা ভেঙে বন্ধু মালেককে সঙ্গে নিয়ে মুজিব চলে আসেন। এ ঘটনায় পুরো গোপালগঞ্জ শহরে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ল। হিন্দু নেতারা রাতে বসে হিন্দু অফিসারের সঙ্গে পরামর্শ করে একটা মামলা করলেন। মামলায় খন্দকার শামসুল হক মোক্তার সাহেবকে হুকুমের আসামি করা হলো। বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে খুন করার চেষ্টা, লুটপাট, দাঙ্গা-হাঙ্গামার অভিযোগ আনা হলো। ওই মামলায় বঙ্গবন্ধুর মামা খন্দকার শামসুদ্দীন আহমদ এমএলএ সাহেবের মুহুরি জহুর শেখ, বন্ধু শেখ নুরুল হক ওরফে মানিক মিয়া, সৈয়দ আলী খন্দকার, আবদুল মালেকসহ অনেক ছাত্রকে আসামি করা হলো। পরদিন সকাল ৯টার দিকে শেখ মুজিবের মামাসহ বেশ কয়েকজন আসামিকে গ্রেফতার করা হলো। থানার দারোগা মুজিবদের বাড়িতে আসতে লজ্জা পাচ্ছিলেন! পুলিশ সুযোগ দিচ্ছিল যেন তিনি পালিয়ে যান। বঙ্গবন্ধুর ফুফাতো ভাই তখন বলেছিলেন, মিয়া ভাই, পাশের বাসায় একটু সরে যাও না। শুনে মুজিব বললেন, যাব না। আমি পালাব না। লোকে বলবে আমি ভয় পেয়েছি। পরে বঙ্গবন্ধুর বাবা বাড়িতে ফেরার সময় দারোগা সাহেবও তাঁর পিছু পিছু ঢুকলেন। গ্রেফতারি পরোয়ানা দেখালেন। বঙ্গবন্ধুর বাবা বললেন, নিয়ে যান। দারোগা বললেন, ও খেয়ে-দেয়ে আসুক, আমি একজন সিপাহি রেখে যাচ্ছি। ১১টার মধ্যে যেন থানায় পৌঁছে যায়। কারণ দেরি হলে জামিন পেতে অসুবিধা হবে। শেখ মুজিবের বাবা ছেলের কাছে জানতে চাইলেন, মারামারি করেছ? মুজিব চুপ থাকলেন। কিন্তু বললেন না। চুপ থেকে বিষয়টি স্বীকার করে নিলেন।

মুজিব থানায় যাওয়ার পরপরই তাকে আদালতে পাঠানো হয়। হাতকড়া পরানো হয়নি। তবে সামনে-পেছনে পুলিশ ছিল। আদালতের দারোগা হিন্দু ছিলেন। মুজিবকে আদালতের ছোট কামরায় রাখা হলো। আদালতের দারোগা দেখে বললেন, মুজিবুর খুব ভয়ানক ছেলে। ছোরা মেরেছিল রমাপদকে। কিছুতেই জামিন দেওয়া যাবে না। এসব শুনে মুজিব বললেন, বাজে কথা বলবেন না, ভালো হবে না। দারোগার সামনে বসা লোকগুলো শুনে বলল, দেখ ছেলের সাহস! পরে শোনা গেল, মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে মুজিবুর রহমান রমাপদকে হত্যার জন্য ছোরা দিয়ে আঘাত করেছিলেন। তার অবস্থা ভয়ানক খারাপ। হাসপাতালে ভর্তি আছে। আসলে এর পুরোটাই ছিল বানানো। উকিল আদালতে জামিন আবেদন করলেন। এসডিও হিন্দু ছিলেন। একমাত্র মোক্তার সাহেব টাউন জামিন পেলেন। বাকিদের পাঠানো হলো জেলহাজতে। সাবজেলে তখন একটা মাত্র ঘর। একপাশে মেয়েদের থাকার জায়গা। কোনো মেয়ে আসামি না থাকায় বঙ্গবন্ধুকে মেয়েদের ওয়ার্ডে রাখল। বাড়ি থেকে বিছানা, কাপড় এবং খাবার দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হলো। শেষ পর্যন্ত সাত দিন হাজতবাসের পর বঙ্গবন্ধু জামিন পেলেন। দশ দিনের মধ্যে বাকিরাও জামিন পেলেন। পরে দুই পক্ষ আলোচনা করে পনেরো শ টাকা ক্ষতিপূরণের বিনিময়ে মামলা মীমাংসা হয়েছিল। ১৮ বছর বয়সে বন্দীজীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি বলেছেন, ‘আমার যেদিন প্রথম জেল হয়, সেদিন থেকেই আমার নাবালকত্ব ঘুচেছে বোধহয়।’

ভারত ভাগের আগে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দমনেও অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। হিন্দু-মুসলমানের সম্প্রীতি ধরে রাখতে কাজ করে গেছেন। দাঙ্গায় যখন ব্যাপক মানুষের প্রাণহানি ঘটছিল তখন তিনি শান্তির বার্তা নিয়ে ছুটে গেছেন দুয়ারে দুয়ারে। তার অনেক কথাই তিনি লিখেছেন ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে। ১৯৪৬ সালে শাসনতন্ত্র-প্রণয়ন পরিষদ নির্বাচন হলো। দেখা গেল, ওই পরিষদের ২১০টি অমুসলমান আসনের মধ্যে কংগ্রেস পেল ১৯৯টি, ৭৮টি মুসলিম আসনের ৭৩টি গেল মুসলিম লীগের হাতে। সর্বমোট ২৯৬ জনের পরিষদে কংগ্রেস তার মিত্রসহ মোট ২২০ জনের সমর্থন পেল। এরপর আবার দেখা দিল মতবিরোধ। নির্বাচনের পর মুসলিম লীগ দাবি করে যে, কংগ্রেস ভাইসরয়ের কার্যনির্বাহী পরিষদে যোগ না দিলে শুধু মুসলিম লীগের প্রতিনিধি নিয়েই পরিষদ গঠিত হোক। তা ছাড়া মিশন প্রস্তাবের কোনো কোনো অংশের প্রকৃত ব্যাখ্যা নিয়েও কংগ্রেস ও লীগের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিল। কিছুদিন ধরে এমন বাগ্বিতন্ডা চলার পর মুসলিম লীগ ক্যাবিনেট মিশন ঘোষণার প্রতি স্বীকৃতি প্রত্যাহার করে নিল। ওই পরিস্থিতিতে ভাইসরয় তাঁর ঘোষণা অনুযায়ী শুধু কংগ্রেস প্রতিনিধি নিয়েই তার কার্যনির্বাহী পরিষদ গঠন করে।

এ পরিস্থিতিতে জিন্নাহর নেতৃত্বে মুসলিম লীগ পাকিস্তান দাবি মেনে নেওয়ার জন্য ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন’ বা প্রত্যক্ষ সংগ্রাম কর্মসূচি ঘোষণা করে। কংগ্রেস যেমন ১৯৪২ সালে ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলন করছিল, তেমনি এখন মুসলিম লীগেরও দাবি হলো, ‘দেশ ভাগ করে দিয়ে ভারত ছাড়’। ১৯৪৬ সালের ২৯ জুলাই মুম্বাই শহরে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের কাউন্সিল সভা হয়। নেতারা শেখ মুজিবুর রহমানকে ওই সভায় যোগ দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। কিন্তু অর্থের অভাবে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ওই সভায় যেতে পারেননি। ওই সভা থেকেই জিন্নাহ ১৬ আগস্ট দিনটিকে ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন’ বা ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম’ দিবস পালনের আহ্বান জানান। অবশ্যই সেই কর্মসূচি উদ্যাপন করতে হবে শান্তিপূর্ণভাবে। যদিও কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভার নেতারা এটাকে ভালোভাবে নিতে পারেননি। জিন্নাহ ব্রিটিশ সরকার ও ক্যাবিনেট মিশনকে এটা দেখাতে চেয়েছিলেন, ভারতবর্ষের ১০ কোটি মুসলমান পাকিস্তান দাবি আদায়ে বদ্ধপরিকর।

প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস পালনের জন্য সারা ভারতে মুসলমানরা প্রস্তুতি নেয়। প্রধানমন্ত্রী শহীদ সোহরাওয়ার্দী ১৬ আগস্ট ছুটির দিন ঘোষণা করেন। যথারীতি এ দিনটি উদ্যাপনের জন্য ডাক পড়ল শেখ মুজিবের। হাশিম সাহেব শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার সাথীদের বুঝিয়ে দিলেন যে, ‘তোমাদের মহল্লায় মহল্লায় যেতে হবে, হিন্দু মহল্লায়ও তোমরা যাবে। তোমরা বলবে, আমাদের এই সংগ্রাম হিন্দুদের বিরুদ্ধে নয়, ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে। আসুন আমরা জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে এই দিনটা পালন করি।’

১৬ আগস্ট কলকাতায় অকটারলনি মনুমেন্টের পাশে মুসলিম লীগের জনসভা হয়। সোহরাওয়ার্দী ছিলেন সভাপতি। প্রত্যক্ষ দিবস পালনে ও জনসভা আয়োজনে শেখ মুজিবুর রহমান মুখ্য ভূমিকা রাখেন। সভা চলাকালে কলকাতা শহরে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে দাঙ্গা শুরু হয়। দাঙ্গা চলে ১৬ থেকে ২০ আগস্ট পর্যন্ত। চার হাজার লোক মারা যায়। ইতিহাসে এ ঘটনাকে বলা হয়, ‘দ্য গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং।’ সোহরাওয়ার্দী দাঙ্গা দমনে সাহসী ভূমিকা রাখেন। ইংরেজ সেনাবাহিনী যদি এগিয়ে আসত তাহলে দাঙ্গায় এত লোক মারা যেত না। জীবনের ঝুঁকি সত্ত্বেও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দমনে শেখ মুজিব তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন। কলকাতার বাইরেও বিভিন্ন জায়গায় দাঙ্গা দমনে কাজ করেছেন তিনি।

বঙ্গবন্ধুর ছয় ভাই-বোনের মধ্যে পাঁচ ভাই তখন কলকাতায়। তিনি এদের জন্যও চিন্তিত হয়ে পড়লেন। দাঙ্গা শুরু হয়ে গেছে পুরোপুরিভাবে। হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের অসংখ্য মানুষ মারা গেল। আক্রান্ত মুসলমানরা সে সময় আশ্রয় নিয়েছিল মুসলিম লীগ অফিস, ইসলামিয়া কলেজ, কলকাতা মাদ্রাসা, বেকার হোস্টেল, ইলিয়ট হোস্টেল, টেইলর হোস্টেল ইত্যাদি জায়গায়। শুধু আশ্রয়েই শেষ নয়। শরণার্থীদের জন্য খাবারের ব্যবস্থাও করতে হয়েছিল। শেখ মুজিব জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে দেখা করেন। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে বেশ কয়েক বস্তা চাল জোগাড় করে ঠেলাগাড়িতে করে বেকার হোস্টেলে, ইলিয়ট হোস্টেলে পৌঁছে দেন। পরে ফায়ার সার্ভিসের একটি গাড়ি দিয়ে কয়েক বস্তা চাল পৌঁছে দিয়েছিলেন কারমাইকেল হোস্টেলে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মধ্যেও যে মেলবন্ধন হয়, তার প্রমাণ পাওয়া গেছে ’৪৬ সালের ওই দাঙ্গায়। বঙ্গবন্ধু তার আত্মজীবনীতে সে কথা বলেছেন, ‘একটা কথা সত্য, অনেক হিন্দু মুসলমানদের রক্ষা করতে গিয়ে বিপদে পড়েছে। জীবনও হারিয়েছে। আবার অনেক মুসলমান হিন্দু পাড়া-পড়শীকে রক্ষা করতে গিয়ে জীবন দিয়েছে। আমি নিজেই এর প্রমাণ পেয়েছি। মুসলিম লীগ অফিসে যেসব টেলিফোন আসত তার মধ্যে বহু টেলিফোন হিন্দুরাই করেছে। তাদের বাড়িতে মুসলমানদের আশ্রয় দিয়েছে। শিগগিরই এদের নিয়ে যেতে বলেছে, নতুবা এরাও মরবে, আশ্রিত মুসলমানরাও মরবে।’

ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মীদের দাবি আদায়ের আন্দোলনে একাত্ম হওয়ায় ছাত্রত্ব হারিয়েছিলেন তিনি। সুযোগ এসেছিল ভুল স্বীকার করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেরার। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তা করেননি। তাঁর এক কথা, ন্যায্য দাবি আদায়ের আন্দোলনে শামিল হয়ে তিনি ভুল করেননি। ভুল স্বীকারের প্রশ্নই আসে না। মূলত দেশভাগের পর থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মীদের মধ্যে নানা অসন্তোষ দেখা দেয়। তাঁরা দাবি-দাওয়া আদায়ে ধর্মঘটের ডাক দেন। ১৯৪৯ সালের গোড়ার দিকে শেখ মুজিব কারাগার থেকে বের হয়ে এসে আন্দোলনকারীদের পাশে দাঁড়ান। বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত কর্মীদের সঙ্গে ছাত্ররা এক হয়ে ধর্মঘট জোরদার করে। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ে অচলাবস্থা দেখা দেয়। কর্তৃপক্ষ ধর্মঘট ভাঙার জন্য কী করা যায়, সে পরিকল্পনা কষতে থাকে। একপর্যায়ে আন্দোলনরত পনেরো জন ছাত্রকে বহিষ্কারসহ অন্যান্য শাস্তি দেওয়া হয়। তাঁদের মধ্যে শেখ মুজিবও ছিলেন। ধর্মঘট থামলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বহিষ্কার করা ছাত্রদের প্রতি নমনীয়তা দেখায়। বলা হয়, ছাত্ররা ভুল স্বীকার করে দুঃখ প্রকাশ করলে নামমাত্র শাস্তি দিয়ে তাদের আবারও পড়াশোনার সুযোগ দেওয়া হবে। পনেরো জনের মধ্য ১৪ জনই এই সুযোগ নিল। তারা ভুল স্বীকার করে মুচলেকা দিয়ে এবং ১০ থেকে ১৫ টাকা জরিমানা দিয়ে আবারও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পায়। বাদ সাধলেন শুধু শেখ মুজিব। তিনি ভুল স্বীকার করে মুচলেকা দিতে রাজি হননি। তাঁর এক কথা, সত্যের জন্য তিনি মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে রাজি আছেন। অন্যায়ের সঙ্গে আপস করে কিছু করবেন না। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মীদের আন্দোলনে সক্রিয় সমর্থন দিয়ে অপরাধ করেননি। নিজের নীতিতে অটল থাকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেল ছাত্রনেতা শেখ মুজিবের।

দিনটি ছিল ১৯৪৯ সালের ৩১ মার্চ। গোপালগঞ্জে তাঁকে গ্রেফতার করা হলো। শেষ হলো একাডেমিক পড়াশোনা। তবে সেদিন তিনি বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিব আবার এই বিশ্ববিদ্যালয়েই আসবে তবে ছাত্র হিসাবে নয়, একজন দেশকর্মী হিসেবে।’ তিনি ওয়াদা রেখেছিলেন। ২৩ বছর পর ১৯৭২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং ডাকসু একসঙ্গে এক বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। সেখানে বঙ্গবন্ধুকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। তাঁর উপস্থিতিতে সেদিন ১৯৪৯ সালের বহিষ্কার আদেশের মূল কপি ছিঁড়ে ফেলা হয়। তাঁকে বিরল সম্মানের অধিকারী হিসেবে দেওয়া হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আজীবন সদস্যপদ। বঙ্গবন্ধু তখন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।

বঙ্গবন্ধুর মতো প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর ছিল বলেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। স্বাধীন দেশে আমরা মুক্তবিহঙ্গের মতো উড়ে বেড়াতে পারছি। পরিচয় দিতে পারছি নিজস্ব জাতিসত্তার। কিন্তু এই মানুষটিকে আমরা হারিয়েছি কিছু অকৃতজ্ঞ, স্বার্থপর, বর্বরের কারণে। প্রতি বছর ১৫ আগস্ট আমাদের মনে করিয়ে দেয় একজন অভিভাবক হারানোর বেদনা। ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের ঠিকানার দিকে তাকালে ভিতরটা হাহাকার করে ওঠে। অব্যক্ত সেই বেদনা প্রকাশের কোনো ভাষা নেই।

লেখক : সম্পাদক, ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকম, দৈনিক ঢাকা টাইমস সাপ্তাহিক এই সময়

সংবাদটি শেয়ার করুন

রাজপাট বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা