জীবন বাঁচাতে চিকিৎসকদের বিরামহীন চেষ্টা

সৈয়দ ঋয়াদ, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ০৪ আগস্ট ২০১৯, ১৪:৪৮ | প্রকাশিত : ০৪ আগস্ট ২০১৯, ১১:০৪
ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা (ফাইল ছবি)

হঠাৎ জ্বর। গায়ে প্রচণ্ড ব্যথা। ঢাকার মুগদা হাসপাতালে ভর্তি আল মামুন সরকার। তিন দিন পর কিছুটা সুস্থ হলে বাসায় ফেরেন। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসায় অবহেলার নানা খবর শুনে সেখানে চিকিৎসা নিয়ে তার মনে কিছুটা সংশয় ছিল। অর্থকরির টানাটানির কারণে বেসরকারি হাসপাতালে যাননি। কিন্তু এই তিন দিনে সরকারি হাসপাতালের প্রতি তার আস্থা ফিরেছে অনেকটাই।

মামুনের মতো আরও ৯০০ ডেঙ্গু রোগী এই হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে। সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরেছে ৬০০ জন। এখনো ভর্তি ৩০০। আর তাদের সামলাতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে চিকিৎসকদের। এ অবস্থায় চিকিৎসকসহ সবার ছুটি বাতিল করেছে কর্তৃপক্ষ।

হাসপাতালের উপপরিচালক খাইরুল আলম ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘ডেঙ্গু বেড়ে গেছে। এটা নিয়ন্ত্রণ রাখা আমাদের কাজ। আমরা সেটার চেষ্টা করে যাচ্ছি। নিজেদের বিশ্রামের কথা ভাবার সময় নেই এখন। একজন রোগীর জীবন বাঁচানো মানে চিকিৎসক হিসেবে জীবনের সফলতা।’

তবে এত চেষ্টার মধ্যেও চিকিৎসকরা সবাইকে সুস্থ করতে পেরেছেন এমন নয়। এই হাসপাতালে আসার পথে বা হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর মোট পাঁচজন রোগীর মৃত্যু হয়েছে।

২০০০ সালে বাংলাদেশে মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দিয়েছিল প্রথমবারের মতো। তবে চলতি বছর আক্রান্ত হয়েছে সবচেয়ে বেশি। এরই মধ্যে আক্রান্তের সংখ্যা ২১ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। গত কয়েক দিন ধরে প্রতিদিন আক্রান্ত হচ্ছে এক হাজার ৬০০ জনের বেশি।

আর এবার ডেঙ্গুর ধরন এমন যে, চিকিৎসায় দেরি করলে বিপদ হতে পারে জীবনের। ফলে জ্বর হলেই মানুষ ছুটছে হাসপাতালে হাসপাতালে। শয্যা পাওয়াই কঠিন হয়ে যাচ্ছে। বেসরকারি হাসপাতলে শয্যা ফাঁকা না থাকলে রোগীকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু সরকারি হাসপাতালে সে রীতি নেই। ফলে রোগীর চাপ বেশির পাশাপাশি চিকিৎসকদের দায়িত্বও বেশি সেখানে।

আর রোগীর শারীরিক অবস্থা অফিস সময় মেনে চলে না। খারাপ হতে পারে যেকোনো সময়। তাই তার দিকে নজরও রাখতে হয় সার্বক্ষণিক।

দেশে ডেঙ্গু আক্রান্তদের মধ্যে অন্তত ১৫ শতাংশের চিকিৎসা হয়েছে কেবল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। আক্রান্ত ২১ হাজারের মধ্যে প্রায় তিন হাজার ভর্তি হয়েছে কেবল দেশের সবচেয়ে বড় এই চিকিৎসালয়েত। সেখানে নতুন রোগীর পক্ষে শয্যা পাওয়া এখন কঠিন। কারণ, পুরোনো রোগী থাকছে মেঝেতেও। এখনো সেখানে ভর্তি ৮০০-এর মতো রোগী।

ডেঙ্গু রোগীর চাপ সামলাতে আরও নতুন শয্যার ব্যবস্থা করতে হচ্ছে ঢাকা মেডিকেলে। শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটকেও প্রস্তুত করা হচ্ছে ডেঙ্গু রোগী বাঁচাতে।

এই হাসপাতালে ডেঙ্গুর চিকিৎসায় চালু হয়েছে ওয়ানস্টপ সার্ভিস। চিকিৎসা নিয়ে তেমন কোনো অভিযোগ নেই রোগী ও তাদের স্বজনদের।

রোগীর এই বাড়তি চাপে ক্লান্তি না ভেবে বাড়তি দায়িত্ব এবং জীবন বাঁচানোর চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক ফরহাদ হোসেন মো. শাহেদ। ঢাকা টাইমসকে তিনি বলেন, ‘সচরাচর এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হয় না। রোগীর চাপ কখনো কখনো বাড়ে। এমনটা মেডিকেলে হতেই পারে। তবে ডেঙ্গু এই মুহূর্তে জাতীয় দুর্যোগ হয়ে দেখা দিচ্ছে। আমরা কাজ করছি মানুষকে সহযোগিতা করতে।’

রোগীর চাপ বেশি থাকায় সমস্যা হচ্ছে কি না জানতে চাইলে এই চিকিৎসক বলেন, ‘চিকিৎসকরা সেবা দেবেন, এমন মনোভাব নিয়ে তাদের তৈরি করা হয়। বছরের সব সময় হয়তো স্বাভাবিক রোগীর চাপ থাকে, এখনকার মতো চাপ থাকে না। যখন চাপ থাকে তখন চিকিৎসকরা বেশি সময় কাজ করেন। এটা আমাদের পেশায় স্বাভাবিক ঘটনা। আমরা সেভাবেই দেখি।’

রোগীর চাপে সবচেয়ে বেশি খাটতে হয় শিক্ষানবিশ চিকিৎসকদের। আর পড়াশোনা শেষ করে কর্মজীবনে ঢুকতে গেলে শুরুতেই এই চাপটা এক ধরনের শিক্ষা বলে মনে করেন মেডিসিন বিভাগে কাজ করা ইন্টার্ন (শিক্ষানবিশ) চিকিৎসক আরমান হোসেন। ঢাকা টাইমসকে তিনি বলেন, ‘সারা দেশ থেকে রোগী আসছে। অনেক অসহায় মানুষ। তাদের জীবন বাঁচানোর চেষ্টা ছাড়া এই মুহূর্তে আর কিছু ভাবার সময় নেই। চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা সুস্থ হলে শরীরে ক্লান্তি থাকে না। আমি না আমার প্রত্যেক সহকর্মীই চেষ্টা করছে এই দুর্যোগ যেন কাটিয়ে ওঠা যায়। সবার সহযোগিতায় খুব শিগগির আমরা এই বিপদ কাটিয়ে উঠব।’

‘আমরা কেবল তাদের চিকিৎসাই দিচ্ছি না। জানতে পারছি, তাদের অনেকেই ডেঙ্গু সম্পর্কে জানে না। আমার চিকিৎসার পাশাপাশি তাদের কাউন্সেলিং করছি, যেন বাসাবাড়ির আশপাশ পরিষ্কার রাখে।’

সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা হয়েছে যে হাসপাতালে, সেখানে মৃত্যুও হয়েছে সবচেয়ে বেশি। গতকাল পর্যন্ত ১২ জন প্রাণ হারিয়েছে ঢাকা মেডিকেলে। তবে একটিবারের জন্যও স্বজনদের পক্ষ থেকে অবহেলার অভিযোগ ওঠেনি, যে ধরনের অভিযোগ সারা বছরই নানা সরকারি হাসপাতালের বিরুদ্ধে ওঠে।

সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের জরুরি বিভাগে কেবল ডেঙ্গু রোগীর জন্য খোলা হয়েছে দুটি বুথ। চারজন করে আটজন চিকিৎসক কাজ করছেন বিরামহীন। তাদের কারও সাপ্তাহিক ছুটি নেই এই সময়ে। ব্যক্তিগত কাজ বা পারিবারিক দায়িত্ব পালন ভুলে গেছেন আপাতত।

ওয়ার্ডগুলোতে একই শয্যায় একাধিক রোগী, মেঝে, বারান্দা, সিঁড়িঘরে ডেঙ্গু রোগীর অবস্থান। ৮০০ শয্যার হাসপাতালে এমনিতেই রোগী থাকে এক হাজারের বেশি। ডেঙ্গুর কারণে এখন এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে এক হাজার ছয়শ। এদের মধ্যে ডেঙ্গু আক্রান্ত ৩৬৫ জন।

এই হাসপাতালে শিক্ষানবিসসহ মোট চিকিৎসক সাড়ে ৩০০ জন। নার্স ৩০০। সকালের ভর্তি রোগীর জন্য প্রতি শিফটে ১০০ জন। তার মানে একজন চিকিৎসককে গড়ে প্রায় ১৬ জন রোগীকে সেবা দিতে হচ্ছে।

একজন ওয়ার্ডকর্মী বলেন, রোগীর চাপে আর সেবায় খাওয়া-দাওয়ার সময়ও ঠিক থাকছে না। হাসপাতালের পরিচালক উত্তম কুমার বড়ুয়া বলেন, ‘এডিস মশাতো আর জানে না ঈদের ছুটি আছে কি নেই। তাই আমরা সেই অনুযায়ী প্রস্তুতি নিচ্ছি এবং চিকিৎসকদের একটি বিশেষ রোস্টার করার চেষ্টা করছি।’

(ঢাকাটাইমস/০৪আগস্ট/ডব্লিউবি/জেবি)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিশেষ প্রতিবেদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :