মালিহাকে বলতে পারবেন ‘ভাইয়া’ মারা গেছে?

হাবিবুল্লাহ ফাহাদ
 | প্রকাশিত : ০৫ আগস্ট ২০১৯, ১৪:২৫

উন্নয়নে উন্নত বিশ্বকে আমরা দৃষ্টান্ত ধরি। কোন দেশ কী করে উন্নত হলো, এ নিয়ে আলোচনা হয়। কাদের শক্তি কোথায়, জনশক্তি কতটা দক্ষ, আয়ের প্রধান উৎস কী, নাগরিকের জীবনযাত্রা কেমন- এসব খুবই দেখা হয়।

ভালো কিছু অনুকরণ করতে তো দোষ নেই। ছাত্রজীবনে হাতের লেখা সুন্দর করতে অনুকরণটা খুবই কার্যকর ছিল। সুন্দর লেখা পেলে দেখে দেখে লিখতে দেওয়া হতো। শিশুশ্রেণিতে ইংরেজি বর্ণমালা লেখার বই ছিল। পেঁচানো বর্ণ। তার ওপর হাত ঘুরিয়ে শিশুরা লেখা শেখে। অনুকরণটা সেই গোড়া থেকেই।

দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নেও দৃষ্টান্ত উন্নত দেশ। উপসাগরের ওপর সেতু বানিয়েছে চীন। হংকং-চুহাই-ম্যাকাও সেতুটি এখন বিশে^র দীর্ঘতম সমুদ্র সেতু। তারা পারলে আমরা কেন নয়? প্রমত্তা পদ্মায় সেতু দৃশ্যমান। কারিগর ওই চৈনিকরাই।

পাতালরেল, উড়ালসেতু সবই তো উন্নত দেশের অনুকরণেই। এমন তো নয় যে, বাংলাদেশেই প্রথম হচ্ছে। আমাদের যে উদ্ভাবন ক্ষমতা নেই তা নয়। কমবেশি আছে। আমরা এর সুফলও পাচ্ছি। আলোচিত হচ্ছে।

শুরুতেই বলেছিলাম, ভালো কিছুর অনুকরণ করা যায়। খারাপটা না টানাই ভালো। ধরুন, আমেরিকাতে রবিবার দুই দফায় বন্দুকধারীরা ৩০ জনকে খুন করেছে। এখন কি আমেরিকা বলবে, কদিন আগে তো নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে বন্দুকধারীরা ৪৯ জনকে খুন করেছে। আমাদের এখানে তো মাত্র ৩০ জন। বন্দুকধারীরা তো সারাবিশে^ই মানুষ মারছে। আদৌ কি আমেরিকা এমনটা বলবে? এটি কি গ্রহণযোগ্য? কিংবা আমেরিকার বন্দুকধারীরা, আদালতে দাঁড়িয়ে নিউজিল্যান্ডের যুক্তি দিয়ে কি অপরাধ থেকে পার পাবে? নিউজিল্যান্ডে ৪৯ জন মরেছে বলে আমেরিকায় ৩০ জনের মৃত্যু সমর্থনযোগ্য?

আপনি হয়তো বলবেন, ধূর! এ হয় নাকি? হত্যা যেখানেই হোক, অন্যায়। অন্যায় যে করেছে তার সাজা হওয়া উচিত।

হ্যাঁ, এটাই স্বাভাবিক। মন্দের দৃষ্টান্ত টানা যায় না। ভালো হলে বলা যায়। অমুক দেশ অর্থনীতিতে ভালো করেছে, আমরা কেন নয়? অমুক দেশ দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে পেরেছে, আমরা কেন নয়? তাই বলে, ‘বিশে^র সবচেয়ে ধনী দেশে আমেরিকাতে ডেঙ্গু আছে, সবচেয়ে পরিষ্কার দেশ সিঙ্গাপুরে ডেঙ্গু আছে...’-এই দৃষ্টান্ত কি সমর্থনযোগ্য?

বিষয়টা কি এই যে, আমেরিকাতে মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়, সেখানে বাংলাদেশে হতেই পারে। আমেরিকাতে ডেঙ্গুতে মানুষ মারা যায়, বাংলাদেশে মারা যাবে, সমস্যা কোথায়? সিঙ্গাপুরে ডেঙ্গুতে মানুষ মারা যায়, বাংলাদেশে মরলে অবাক হওয়ার কী আছে?

হতে পারে কথাগুলো সত্যি। স্বাস্থ্যমন্ত্রী মহোদয়ের কথা ধরেই বললাম, ‘পৃথিবীর এমন কোনো দেশ নেই যেখানে ডেঙ্গু নেই’। ধরে নিলাম, স্বাস্থ্যমন্ত্রী মহোদয়ের ঘনিষ্ঠ কোনো পরিবারের সবচেয়ে ছোট শিশুটি ডেঙ্গু আক্রান্ত হলো। (যদিও এমনটি কখনোই কাম্য নয়)। শিশুটিকে বাংলাদেশের নামিদামি হাসপাতালে রেখে সর্বোচ্চ যতœ সহকারে চিকিৎসার বন্দোবস্ত করা হলো। কিন্তু শিশুটিকে বাঁচানো গেল না। ঘটনাটিকে তিনি কি স্বাভাবিকভাবে নেবেন? তিনি কি ওই পরিবারের সদস্যদের এই বলে বুঝ দেবেন যে, ‘আমেরিকাতে ডেঙ্গু আছে, সিঙ্গাপুরে ডেঙ্গু আছে, বাংলাদেশে তো নতুন নয়।’

অমানবিক দৃষ্টান্ত দিয়ে বসলাম, জানি। ক্ষমা চাচ্ছি। প্রশ্ন হচ্ছে, মন্ত্রী বাহাদুর যদি এদেশের ১৮ কোটি মানুষের মন্ত্রী হয়ে থাকেন, তাহলে এ কথা কি তার বলা সাজে? তিনি ১৮ কোটি মানুষের একটি পরিবারের স্বাস্থ্যসেবার অভিভাবক। একান্ত পরিজনকে যে কথা বলতে পারবেন না, ১৮ কোটি মানুষের জীবন নিয়ে সেই উপহাস করলেন?

রবিবার দেশের প্রতিটি অনলাইনে কমবেশি আলোচিত খবর ছিল ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে একজন অতিরিক্ত আইজিপির স্ত্রীর মৃত্যু। একদিন আগে দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি দৈনিকের অনলাইনে খবর ছিল, ‘ছেলেকে দাফন করে হাসপাতালে মেয়ের পাশে তাঁরা’। রাইয়ান ও মালিহা। দুই ভাইবোন একসঙ্গে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিল। ভাইয়ের বয়স ১১ বছর ৭ মাস। বোনের ছয় বছর। চিকিৎসকরা বলেছিলেন, রাইয়ানের অবস্থা ভালোর দিকে। ঘটলো ভিন্ন ঘটনা। ছেলেটি মারা গেল গত শুক্রবার। বোন এখনো হাসপাতালে। ছেলেকে দাফন করে বাবাকে ছুটে আসতে হয়েছে মেয়ের কাছে। মালিহা এখনো জানে না, তার ভাইয়া (রাইয়ান) বেঁচে নেই। ১১ তলায় কেবিনে ভর্তি বোন জানে ভাইয়া আছে সাত তলায়।

মাননীয় মন্ত্রী বাহাদুর, একবার কি শিশুটিকে গিয়ে জানাতে পারবেন তোমার ভাইয়া মারা গেছে? রূপকথার গল্পের মতো বলতে পারবেন, শোনো আমেরিকাতে, সিঙ্গাপুরে মানুষের ডেঙ্গু হয়। তারা মারা যায়। আমরা তো বাংলাদেশে থাকি। আমাদের ডেঙ্গু তো হতেই পারে। আমরা তো মরতেই...।’ পারবেন না। সৃষ্টিকর্তা এই ক্ষমতা মানুষকে দেননি।

এসব কথা থাক। অভিযোগ তুলে রাখলাম। এখন অভিযোগের সময় নয়। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সবাই কাজ করছে। সরকারি-বেসরকারি সবাই। ছুটি বাতিল হয়েছে সংশ্লিষ্টদের। হাসপাতালে-হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা। নগর কর্তৃপক্ষ মশানিধনে সচেষ্ট। দেশের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দূর দেশ বসেও প্রতিনিয়ত খোঁজ রাখছেন। নির্দেশনা দিয়েছেন, দিচ্ছেন। তবু যেন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে এডিস। এটি কেন হলো কারণ খোঁজার সময় আছে। কারণ খুঁজতেও হবে। কাদের গাফলতির কারণে অকার্যকর ওষুধ কেনা হলো? কেন এডিসের বংশ ছড়িয়ে গেল সর্বত্র? এ দায় কেউ এড়াতে পারে না।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলছেন, ‘দেশে সবকিছুতেই ষড়যন্ত্র হয়। ডেঙ্গু নিয়েও ষড়যন্ত্র হচ্ছে।...বিএনপি নেতারা নানা রকম অভিযোগ তুলছেন। কিন্তু তারা ভুলে গেছে ক্ষমতায় থাকতে দেশকে পাঁচবার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন করেছিলেন। দেশকে বোমাবাজি আর সন্ত্রাসের কারখানা বানিয়েছিলেন। বিদ্যুতের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করেছিলেন। আজ তারা বড় বড় কথা বলেন।’ ষড়যন্ত্র হলে খুঁজে বের করুন, কারা ষড়যন্ত্র করছে। তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা হোক। আর যদি এটি কেবল রাজনৈতিক বক্তব্য হয়, তাহলে দয়া করে এসব বন্ধ করুন।

দেশ পরিচালনার দায়িত্ব মন্ত্রী মহোদয়দের। তাঁরা আমাদের অভিভাবক। ১৮ কোটি মানুষের অভিভাবক। ১৮ কোটি মানুষের নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব তারা নিয়েছেন। দেশকে নিরাপদ ও বাসযোগ্য করার দায়িত্বও তাদের। তাদের অতিকথন যেন কারো মনে কষ্ট না দেয়, বিদ্বেষের জন্ম না দেয়, সেদিকে খেয়াল রাখা জরুরি। কথা দিয়ে তো কিছু হবে না। কাজ করলে মানুষ তা এমনিই দেখতে পাবে। সুফল মিলবে। আমরা এডিস মশার ভয়াবহতা থেকে বাঁচতে চাই। ডেঙ্গু থেকে পরিত্রাণ চাই। সুস্থ, সুন্দরভাবে বাঁচতে নিরাপদ পরিবেশ চাই। বিশে^ আর কোথায় কোথায় ডেঙ্গু আছে, ডেঙ্গুতে কোথায় মানুষ মারা যায়, কোথায় যায় না, এসব জ্ঞান বিতরণ আপাতত বন্ধ রাখুন। এসব জানতে মন্ত্রী হওয়ার প্রয়োজন নেই। গুগলই যথেষ্ট।

লেখক: গল্পকার ও সাংবাদিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :