জীবন নিয়ে তামাশা!

প্রকাশ | ০৫ আগস্ট ২০১৯, ১৯:২২

মানিক মুনতাসির

ঘটনা-১: শনিবার রাত ১১টা। রাজধানীর শান্তিনগরের পপুলার ডায়াগস্টিক সেন্টারে ডাক্তারের অপেক্ষায় বসে আছি। হঠাৎ ১০/১২ বছরের একটা শিশু চিৎকার দিয়ে বলল, বাব বাবা মশা। তৎক্ষণাৎ বসে থাকা ১৮/২০ জনের সবাই হাত পা ছোড়াছুড়ি শুরু করলেন। একটু পর ডাক্তারের রুমে ঢুকলাম। স্কার্ফ পরা ভদ্রমহিলা। হাসি দিয়ে বললেন আসেন আসেন। আরও বললেন, ডেঙ্গু হয়নি নিশ্চয়ই। চোখ-মুখের অবস্থা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু আমার দৃষ্টি অন্যখানে। রুমের ভেতরে কয়েলের ধোঁয়ার গন্ধ। ডাক্তারের হাতে গ্লাবস। পায়েও মোজা। পেছন দিকে চল্লিশোর্ধ আরেকজন সহকারী। যাকে এর আগে সেখানে দেখিনি কোনোদিন। ওই মহিলার হাতে মশা মারার একটি ব্যাট। তিনি এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছেন যেন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত। আমি কিছু বলার আগেই ডাক্তার বললেন ভাই কী করবো বলেন, নিজের জীবনেরও তো ভয় আছে।

ঘটনা-২: ডাক্তার দেখানো শেষে উবারের গাড়ি ডেকে উঠতে গিয়েই দ্বিতীয় দফা ধাক্কা খেলাম। ভেতরে অ্যারোসলের কড়া গন্ধ। ড্রাইভার নিজেই বলল স্যার কী আর করবো। কখন যে মশা ঢুকে যায়। এজন্য অ্যারোসল দিয়ে রাখি। অবস্থা স্বাভাবিক করতে এবার ড্রাইভার এয়ারফ্রেশনার ছড়াল। যাই হোক এত আতঙ্কের মধ্যেও স্বস্তি নিয়ে বাসায় ফিরলাম। কারণ সুখবর হলো পরিবারের কারো এখনো ডেঙ্গু হয়নি।

এবার একটু পরিসংখ্যান দেখুন। ২০০৯ সালে শ্রীলংকায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিল ৩৫ হাজার ৫০০ জন। এর মধ্যে মারা গেছেন ৩৪৫ জন। আর ২০১৯ সালের প্রথম ছয় মাসে ফিলিপাইন্সে আক্রান্ত হয়েছিলেন এক লাখ। এরমধ্যে মারা গেছেন ৪৫০ জন। আর আমাদের এখানে এখন পর্যন্ত মারা গেছে অর্ধশতাধিক। আক্রান্তের সংখ্যা নিয়ে অবশ্য বিতর্ক রয়েছে। তবে ডেঙ্গু আতঙ্ক নিয়ে কোনো গুজব নেই।

বর্তমানে যেসব দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ চলছে। তারমধ্যে বাংলাদেশও একটি। এশিয়ার প্রায় অর্ধেক দেশেই এখন কমবেশি ডেঙ্গুর প্রকোপ চলছে। কিন্তু কথা হলো যেখানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সাত মাস আগেই সতর্ক করল, তখন আমরা কার্যকর কোনো ওষুধ পর্যন্ত আমদানি করলাম না। এটাকে আপনি কী বলবেন। আমি আসলে অবহেলা বলব না। এটা একটা তামাশা। কারণ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে হয়তো পাত্তাই দিইনি আমরা। কেননা এত উন্নয়নের মাঝে এডিশ মশার মতো একটা ঠুনকো বিষয় নিয়ে ভাবার সময় কোথায়?

হ্যাঁ তাই তো এত এত ফ্লাইওভার, মেট্রোরেল, পদ্মা সেতু, কর্ণফুলি টানেল, পারমানবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। আরও কত কী? এত সব উন্নয়ন কর্মকাণ্ড রেখে সামান্য মশা মারার কাজে ব্যয় করার সময় কোথায়। কথায় বলে না খামাকা ‘মশা মেরে হাত কালো করার দরকার কী’ তাই তো উল্টো মশা চাষ করেছি জেনে না জেনেই। আর মাশুল দিচ্ছি এখন কপাল চাপড়ে। অবশ্য কপাল চাপড়াচ্ছে আপনার আমার মতো আমজনতা। হয়তো সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, এমপি কিংবা মন্ত্রী, মেয়ররা কপাল চাপড়ানোর মতো কাজ করে সময় নষ্ট করেন না। করবেনও না।

এই ডেঙ্গু আর এডিস মশা নিয়ে সারাদেশের মানুষের মধ্যে আতঙ্ক। হাঁটতে, বসে থাকতে, চলতে ফিরতে সবখানে এডিস মশার আতঙ্ক। মশারির মধ্যে শুয়ে থাকলেও মনে হয় বুঝি মশা কামড়াল। সন্তানকে স্কুলে পাঠালেও স্বস্তি নেই। সেখানেও কামড়াতে পারে। এমনকি হাসপাতালের করিডোর কিংবা বিছানাতেও স্বস্তি নেই। রাজধানীসহ জেলা সদরের গ্রামাঞ্চলেও ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যাচ্ছে প্রতিদিন। সর্বশেষ গত ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্ত হয়েছেন দুই হাজারের বেশি। প্রকৃত সংখ্যা হয়তো আরও বেশি হবে। কেননা সবাই তো হাসপাতালে যেতে পারছেন না। পারলেও হয়তো ভর্তি হতে পারছেন না।

কিন্তু বিষয় সেটা নয়। বিষয় হলো-ঢাকার মেয়র ও দেশের মন্ত্রীদের মশকরা নিয়ে। একদিকে মানুষ মরছে, বিছানায় কাতরাচ্ছে। অন্যদিকে পরিচ্ছন্নতা অভিযানের নামে নায়িকাদের সাথে নিয়ে ঝকঝকে রাস্তায় ঝাঁড়ু হাতে ফটোসেশন করছেন। এটা কি কোনো স্বাভাবিক মানুষের কাজ? আরে মন্ত্রী আর মেয়র বাহাদুর এসব লোক দেখানো ভাওতাবাজি না করে মোহাম্মদপুরে গিয়ে রাইয়ান সরকারের বাবা-মাকে সান্ত্বনা  দিয়ে আসুন। প্রতিদিন আক্রান্তের সংখ্যা বাড়া সত্ত্বেও স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, ডেঙ্গু এখন নিয়ন্ত্রণে। হ্যাঁ তাই তো নিয়ন্ত্রণেই তো! সেটা আপনার আমার নয়। মশার নিয়ন্ত্রণ মশার কাছেই। অর্থাৎ এডিস মশা ভাইরাস ছড়াতে আগের মতোই নিজের নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছে।

রাইয়ানের বোন এখনো জানে না যে, তার ভাই মারা গেছে। এবং একই জ্বরে সেও আক্রান্ত। আজ রাইয়ানের বাবার জায়গায় নিজেকে ভাবুন না হে মন্ত্রী/মেয়র মহোদয়। দেখুন কোনো ফিলিংশ আসে কি না।

আমরা জাতি হিসেবে সত্যিই খুবই আজব হোক না সে ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক। ভাষার জন্য যুদ্ধ করে প্রাণ দিয়েছে। এমন নজির পৃথিবীতে খুবই কম। স্বাধীনতার কথা না হয় বাদই দিলাম। কেননা সেটা তো সব দেশই কমবেশি করেছে। আজকাল শব্দ দূষণের মাত্রা যে কোথায় গিয়েছে তা বুঝতে হলে পরবর্তী প্রজন্মের কথা ভাবতে হবে। মনে হয় যেন হর্ন দেয়াই হয়েছে শুধু বাজানোর জন্য। মোটর বাইকে, ইজি বাইকে, রিকশায়, প্রাইভেট কারে সব খানে হাইড্রোলিক হর্ন। রাস্তায় কান পাতা যায় না। তারপরও আমাদের কারো কোনো মাথাব্যথা নাই।

সারা রাজধানীজুড়ে ডেঙ্গু মশার রমরমা চাষ করিয়ে এখন ঝকঝকে রাস্তায় ঝাঁড়ু দিয়ে মশার মারার অভিনয় করি। পরিচ্ছন্নতার অভিনয় করি। হ্যাঁ সেটাই তো হওয়ার কথা-মেয়র হওয়ার পর পরিষ্কার রাস্তায় কাগজের টুকরা ফেলে নিজে পরিচ্ছন্নতা অভিযান শুরু করেন।  সেই মহান মেয়রের কাছে এর চেয়ে ভালো কিছু আশা করা বোধহয় বোকামি। আর আরেক মেয়র তো ৩৫ ডিগ্রি তাপমাত্রাতেও গায়ে ব্লেজার জড়িয়ে ফগার মেশিনের টিগার চেপে মশা মারা কর্মসূচির উদ্বোধন করেন।  আবার নিজে টি-শার্ট গায়ে দিয়ে নগরবাসীকে লম্বা জামা কাপড় পরার সবক দিচ্ছেন সাঈদ খোকন। বাহ! কী মজা। টেলিভিশন দেখলে দাঁত কেলিনে হাসা আর ইন্টারভিউ দেওয়া। আরে বেহায়া পারলে রাইয়ানদের জন্য দোয়া মাহফিল করেন। কাল কেয়ামতের মাঠে এই অবুঝ নিষ্পাপ রাইয়ানরা যেন জান্নাতের দরজা আগলে না দাঁড়ায়। সে দোয়া করুন। 

এমন মহামারিতেও এখনো কার্যকর কোনো ওষুধ তো এলোই না। বরং সব দায় জনগণের কাঁধে দিয়ে নাকে সরিষার তেল মেখে ঘুমাচ্ছেন মেয়ররা।

কারো বাড়িতে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ইতিমধ্যে একটি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানকে জরিমানাও করা হয়েছে। আচ্ছা নগর ভবনের ছাদে কিংবা সচিবালয়ের কোনো বিল্ডিংয়ে ছাদে অথবা অভ্যন্তরে যে এডিস মশা জন্মাচ্ছে না তা কি আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারি। যেহেতু পারি না তাহলে সেখান থেকে কেন শুরু হয় না। যে যে এলাকায় আক্রান্ত বেশি হচ্ছে সেসব এলাকাকে চিহ্নিত করে সেখানে গিয়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা কর্মসূচিওতো পালন করা যায়। অবশ্য জনসাধারণ তার নিজের দায় এড়াতে পারে না কিছুতেই। নিজের বাড়ি ঘর কিংবা ফ্ল্যাট, বাসার সামনে, নিজের কর্মসস্থলে এডিস মশার জন্মস্থল রয়েছে কি না-তা কি আমরা নিজেরা ঠিকমত অনুসন্ধান করছি। হয়তো অনেকেই নিজেদের ফুলের টব ইতিমধ্যে নষ্ট কলে ফেলেছি। কেউ কেউ হয়তো নিজের বাসা-বাড়িকে পরিষ্কারও করেছি। কিন্তু সেটা যথেষ্ট কিনা-তা কি কেউ তদারকি করছে।

খিলগাঁওয়ে আমার বাসার পাশে কাউন্সিলরের অফিস। সেখানে প্রতিদিন দুই-তিনবার মশার ওষুধ ছিটানো হচ্ছে। হোক না সেটা কার্যকর কিংবা অকার্যকর। কই আমার বাসায় তো সপ্তাহে একদিনও দেওয়া হচ্ছে না। আবার রাজধানীর একটি এলাকায় দেখা গেছে সিটি করপোরেশনের এক কর্মী ফাঁকা এবং পরিষ্কার রাস্তায় ফগার মেশিন চালিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে চলে যাচ্ছেন। ওই ভিডিওতে দেখা গেছে সেই কর্মী রাস্তায় চলাচলরত মানুষদের গা ঘেঁষে মেশিন চালিয়েছেন। তাহলে কী দাঁড়ালো? সব মশা কি রাস্তায়। নাকি নর্দমায়। নাকি ফুলবাগানে। মানলাম রাস্তায়ও মশা থাকতে পারে। তাই বলে এমন ফাঁকা রাস্তায় স্প্রে। হবেই তো খোদ মেয়র বাহাদুর যদি পরিষ্কার রাস্তায় পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালাতে পারেন। তাহলে মেয়রের অধীনস্থ ওই কর্মী তো ফাঁকা রাস্তাতেই স্প্রে করবে তাই না? এর সবই তামাশা। এসব বন্ধ হওয়া জরুরি।

লেখক: সাংবাদিক