‘আমরা স্বাধীনতা হারিয়েছি’
ভারত সরকার জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের বিশেষ সাংবিধানিক মর্যাদা প্রত্যাহার করে নেওয়ার ফলে সেখানকার মানুষ মনে করছেন তারা স্বাধীনতা হারিয়েছেন। এমনটাও কেউ বলছেন, যে চুক্তির মাধ্যমে কাশ্মীরের ভারতভুক্তি হয়েছিল, সেটাই তো এখন আর রইল না।
অন্যান্য রাজ্য থেকে কাশ্মীরে যাওয়া হাজার হাজার মানুষ সেখান থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছেন। বাইরে থেকে খবর সংগ্রহ করতে কাশ্মীরে যেসব সাংবাদিক গেছেন, তাদের প্রায় কেউই সর্বশেষ খবরাখবর জানাতে পারছেন না।
ভারত শাসিত কাশ্মীর রবিবার রাত থেকেই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন, কারফিউ চলছে, দোকান, স্কুল কলেজ সব বন্ধ। বন্ধ মোবাইল আর ল্যান্ডলাইন ফোন, ইন্টারনেট পরিষেবা, এমনকী কেবল টিভিও।
বিবিসির সংবাদদাতা জুবায়ের আহমেদ বেশ কয়েকদিন চেষ্টার পরে কোনোক্রমে সেখানকার পরিস্থিতি আর মানুষের কথা রেকর্ড করে দিল্লিতে পাঠাতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, রাজধানী শ্রীনগরে নিরাপত্তা বাহিনী গাড়িতে চড়ে মাইকে বলতে বলতে যাচ্ছে যে কারফিউ জারি রয়েছে, কেউ যেন বাড়ির বাইরে না বের হন। রাস্তাঘাট শুনশান কদিন ধরেই। প্রতিটা রাস্তায়, গলির মুখে নিরাপত্তা বাহিনীর পাহারা।
জুবায়ের আহমেদ জানান, ‘শ্রীনগর বা তার আশপাশের এলাকায় আমরা যেখানেই যাচ্ছি, সেখানে মানুষজন প্রায় চোখেই পড়ছে না। যে কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলতে পেরেছি, তারা সকলেই সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। বেশিরভাগ নেতাই আটক হয়ে রয়েছেন, তারা ছাড়া পাওয়ার পরে যেভাবে নির্দেশ দেবেন, সেইভাবে প্রতিবাদে রাস্তায় নামবেন মানুষ, এমনটাই বলছেন তারা।’
দিল্লির মানবাধিকার সংগঠন রাইটস এন্ড রিস্কস অ্যানালাইসিস গ্রুপের প্রধান, সুহাস চাকমা বলেন, ‘এই সিদ্ধান্তে স্থানীয় মানুষদের সমর্থন পাবে না বুঝেই সরকার গোটা রাজ্যকে বিচ্ছিন্ন করে রেখে দিয়েছে। সরকার যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছে, তাতে স্থানীয় মানুষের সমর্থন নেই। সেজন্যই যেকোন রকম প্রতিবাদ বন্ধ করার জন্য একরকম একনায়কতন্ত্র কায়েম করা হয়েছে সেখানে। কিন্তু হাতি মারা গেলে কি লুকিয়ে রাখা যায়?’
বহু রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে। আবার কিছু এলাকায় বিক্ষোভ চলছে। কিন্তু সেইসব খবর যাচাই করার উপায় নেই। অন্যদিকে কাশ্মীরের বেশিরভাগ মানুষ এখনও খুব ভাল করে জানেনই না, যে সংবিধানের যে ধারা দুটির মাধ্যমে তাদের রাজ্যটিকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়েছিল, তা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে।
তাদের কানে যেটুকু এসেছে, তাতেই তাদের মনে হয়েছে, যে স্বাধীনতা তারা ভোগ করতেন, সেটা হারালেন তারা। বারামুলার এক বয়স্ক লোক বলেন, ‘ওই ধারা দুটি আমাদের কাছে স্বাধীনতার মতো ছিল। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে যে আমি যেন স্বাধীনতা হারালাম। আমি এখন আর স্বাধীন নই।’
আরেক যুবকের কথায়, ‘ভারত সরকারের যা ভাল মনে হয়েছে তা করুক। কিন্তু জম্মু-কাশ্মীরকে পুরোপুরি বন্ধ কেন করে দিল সরকার! তার মানেই এখানকার মানুষের বিরুদ্ধে কোনো পরিকল্পনা এটা। ৩৭০ আর ৩৫এ- এই দুটো ধারার মাধ্যমেই তো কাশ্মীরের ভারতভুক্তি হয়েছিল। সেদুটো তুলে দেওয়ার অর্থ বিয়েটাই তো ভেঙ্গে গেল।’
অন্যদিকে বাইরে থেকে ওই রাজ্যে কাজে যাওয়া হাজার হাজার মানুষ সেখান থেকে ফিরে আসার চেষ্টা করছেন। তাদের কেউ কেউ বলছেন বাস স্টেশনে তারা বেশ কয়েকদিন ইতিমধ্যেই কাটিয়ে দিয়েছেন। কোনো খাবার নেই, পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগও করতে পারছেন না তারা। সেখানকার একজন জানান, ‘ঘরে ঘরে গিয়ে বলা হচ্ছে তাড়াতাড়ি চলে যেতে। অনেক কিছু হয়ে যেতে পারে’।
আরেকজন বলেন, ‘আমি বিহার থেকে এসেছি কাশ্মীরে রঙ মিস্ত্রির কাজ করতে। আগের দিন থেকে চেষ্টা করছি বাস ধরার। কিন্তু গাড়ি পাওয়াই কঠিন হয়ে পড়েছে। হাজার হাজার লোক ফিরতে চাইছে।’
এই রকম একটা অভূতপূর্ব পরিস্থিতি আগে কখনও ভারত শাসিত কাশ্মীরে হয়নি। ৩৭০ আর ৩৫এ প্রত্যাহারের প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলো যেমন দ্বিধাবিভক্ত, তেমনই অবস্থান ভারতের সংবাদমাধ্যমেরও। হাতে গোনা কয়েকটি টিভি চ্যানেল এবং সংবাদপত্র সরকারের এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিয়ে নানা ধরনের প্রশ্ন তুললেও বেশিরভাগ গণমাধ্যমই সরকারের পক্ষ নিয়েছে।
ঢাকা টাইমস/০৮আগস্ট/একে