মশাতঙ্ক এবং ল্যারি দ্য ক্যাট!

অরুণ কুমার বিশ্বাস
 | প্রকাশিত : ১০ আগস্ট ২০১৯, ১১:২৬

যারা বার কয়েক যুক্তরাজ্য ভ্রমণ করেছেন তারা দেখবেন, লন্ডনের ওয়েস্ট মিনস্টারে অবস্থিত ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে ব্রিটিশ প্রধানন্ত্রীর যে বাড়ি সেখানে বহাল তবিয়তে চাকরি করছে একটি প্রাণী। যে সে প্রাণী সে নয়, বাঘ-ভালুক নয়, শাখামৃগ বা বানরও নয়, সে হলো গিয়ে একখানা জলজ্যান্ত বিড়াল, তুচ্ছার্থে আমরা যাকে হামেশাই বিলাই, বিল্লি কিংবা ম্যাঁও বলে ডাকি। এখানে বলে রাখা ভালো, ইংরেজ জামানায় দুটো প্রাণীর খুব কদর রয়েছে। এক হলো গিয়ে পেঁচা। পেঁচাকে ব্রিটিশরা খুব জ্ঞানী-বুদ্ধিমান প্রাণী বলে জানে এবং মানে। প্রত্যেকের ঘরের দরজায় একটা করে পেঁচার ডামি ঝুলতে দেখা যায়।

আর দ্বিতীয় প্রাণীটি হলো এই বিড়াল। বিড়ালের গুরুত্ব কিন্তু অন্যখানে। লন্ডন শহরে প্রচুর ইঁদুরের আনাগোনা। শহর হ্যামিলনের চেয়ে কম নয়। ইঁদুর আছে বলেই খোদ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মাস মাইনে দিয়ে তার বসতঘরে একখানা ইঁদুর রেখেছেন। সে দেখতে বেশ চৌকস, নাদুসনুদুস। ইঁদুর তো খাচ্ছেই, সেই সঙ্গে খোদ প্রাইম মিনিস্টারের টেবিলে বসে কলাটা মুলোটাও বেশ চাখছে সে। সেই বিড়ালের নাম ল্যারি। বেশ বুদ্ধিমান দেখতে। চোখে চশমা নেই বটে, তবে তার বিচক্ষণতা রীতিমতো প্রবাদপ্রতিম।

ল্যারি দ্য ক্যাট ২০১১ সালে প্রথম ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটের চাকরিতে বহাল হয়। তখন ডেভিড ক্যামেরনের আমল। তিনি আবার ঘুমে বিশ্বাসী। রাতের বেলা ইঁদুরের খুটখাট শব্দে তার কাঁচা ঘুম ভেঙে যায়। ফলে পরদিন তিনি ঘুমচোখে ঠিকমতো অফিস করতে পারেন না। মেজাজও ঠিক কন্ট্রোলে থাকে না তার। ফলে অনেক ভেবেচিন্তে ক্যামেরন সাহেব একটা বিড়ালকে তার বাসায় নিয়োগ দিলেন। তার মূল কাজই হলো ডাউনিং স্ট্রিটের সকল ইঁদুর মেরে সাফ করা। কেউ কেউ অবশ্য ল্যারির একটা সঙ্গীর কথাও বলেছিলেন বটে, তবে বুদ্ধিমান ডেভিড সাহেব তাদের কথা কানে তোলেননি। সঙ্গী পেলেই বিড়াল খোশগল্পে মেতে উঠবে, ইন্টুমিন্টু করবে, চাই কি, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে উল্টাপাল্টা সব গুজবও ছড়াতে পারে। আর গুজব ভাইরাল হলে তা কেমন দুর্গন্ধ ছড়ায়, সে তো আমাদের সকলেরই জানা।

যে যাই হোক, ল্যারি মহাশয় ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটের ‘চিফ মাউসার’ হিসেবে নিয়োগ পেল। তখন তার ভাবসাবই গেল বদলে। ক্ষমতা পেলে শুধু মানুষ কেন, সকল প্রাণীই তা ভোগ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ফলে কি হল, ল্যারির আর কাজেকামে মন নেই। সে শুধু খায় আর স্বজাতিকে নিজের ক্ষমতার বহর দেখিয়ে বেড়ায়। বছর খানেক বাদে ক্যামেরন দেখলেন যে, ল্যারি আর ইঁদুর ধরে না, পড়ে পড়ে শুধু ঘুমায় আর হাই তোলে। অবাধ ক্ষমতা পেলে যা হয় আর কি! নিজের গোত্রবিচার করতেও ভুলে যায়।

পিএম গেলেন রেগে। না না, এমন অকম্মার ধাড়ি আর সুযোগসন্ধানী বিড়াল তার চাই না। একে বরখাস্ত করো। কিন্তু সেবার রানির হস্তক্ষেপে ল্যারি দ্য ক্যাট বেঁচে গেল। তবে হালে আবার নতুন পিএম আসীন হওয়ায় অনেকেই মনে করছেন ডেভিডের আমলের বিড়ালকে তিনি আর রাখবেন না। কারণ বরিস জনসন অলরেডি ঘোষণা দিয়ে ফেলেছেন, পুরনো সবকিছু তিনি ঝেড়ে ফেলবেন। নতুন করে পুরোটা সাজাবেন। নিজেকে নাকি দেশকে, তা অবশ্য তিনি খোলসা করে কিছু বলেননি।

তবে এ যাত্রায়ও হয়তো ল্যারি বেঁচে যাবে। কারণ সদ্যবিদায়ী প্রিমিয়ার থেরেসা মে তার পক্ষে আছেন। নারীর মন বলে কথা। শোনা যায়, ল্যারি নাকি মোটা অংকের পাউন্ডের বিনিময়ে শক্ত লবিস্টও নিয়োগ দিয়েছে। সে-ই নাকি ল্যারির হয়ে ম্যাডাম মে’র কাছে গিয়েছিল। থেরেসা মে বলছেন যে ল্যারির কেসটা তিনি দেখবেন।

তবে ল্যারির বদনাম যা হবার এরই মধ্যে হয়ে গিয়েছে। সবাই তার নাম দিয়েছে ‘ল্যাজি ল্যারি’। মানে তার অলসতা এখনও প্রবাদতুল্য। ল্যারির চাকরি বাঁচলেও তাকে আর কোনোভাবেই ‘চিফ মাউসার’ অর্থাৎ প্রধান ইঁদুর নিধনকারীর পদে রাখা যাবে না। সমীচীনও হবে না।

সে না হয় হলো। কিন্তু তাহলে আমাদের মেয়রগণের কী হবে! তারা কি আর স্বপদে থাকতে পারবেন! কেননা, দেশব্যাপী ডেঙ্গুমশার আক্রমণে ক্ষণে ক্ষণে লোক মারছে। এখন শুধু ঢাকা শহরে নয়, সারা দেশ থেকে ডেঙ্গুর আক্রমণে মৃত্যুর খবর আসছে। এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞ যারা তারা গলার শিরা ফুলিয়ে বলছেন, ডেঙ্গু পরিস্থিতি ক্রমশ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। টিভি খুললেই মহাজ্ঞানীদের জ্ঞানগর্ভ সব বুলি শোনা যায়, অথচ তারা কেউ কাজের কাজ কিছু করছেন না বা পারছেন না।

এবার আসুন কেসটা একটু তলিয়ে দেখি। ল্যারি ইঁদুর মারে না তাই তার চাকরি ‘আছে কি নেই’ এই নিয়ে মেলা গবেষণা চলছে। অথচ আমাদের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা কাজের কাজ কিছু না করেই নিজ নিজ পদে বহাল তবিয়তে আছেন। মহামান্য হাইকোর্ট বারংবার তাদের নির্দেশনা দিলেও সিটি করপোরেশন উল্লেখযোগ্য কিছু করতে পারছে না।

কী করে পারবে শুনি! তারা তো সব টিভি-মিডিয়ার চেহারা দেখানোর কার্যে নিয়োজিত। কেউ কাঁধে ফগার মেশিন ঝুলিয়ে অযথাই কামান দাগছেন, আবার কেউ কেউ ঝাড়– দিয়ে মশা মারছেন খোলা রাস্তায়। তাদের এহেন নির্লজ্জতা ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের মনে আরও বেশি বেশি বিষ ঢালছে। তাদের দুর্ভোগ নিয়ে কর্তাব্যক্তিদের এ কেমন রসিকতা! তাদের কি মরণের ভয় বলেও কিছু নেই! মশারা তাদের ছাড়বে ভেবেছেন!

এতদিনে জানা গেল যে, সিটি করপোরেশনের ওষুধে মশা মরছে না। কী করে মরবে! এসব কি ওষুধ, নাকি স্রেফ কেরোসিন কে জানে! গোয়ালা যেমন এক কিলো দুধে সাত কিলো পানি মিশিয়ে বাজারে আনে, এই ওষুধও ঠিক তেমনি। ওষুধে ‘আসল জিনিস’ নেই, আছে খালি ভেজাল। সিটির লোকেরা এখন বলছে তারা নাকি দুজন আমদানিকারকের কাছে জিম্মি! পাবলিক এত বোকা নয় যে এটুকু বুঝতে পারবে না, এখানে ইঁদুর-বিলাই খেলা চলছে। এ ওকে দুষষে, সে আবার অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপাবে। লাভের মুলো তো সেই আগেই খেয়ে সেরেছে।

ডেঙ্গুর কারণ হলো গিয়ে এডিস মশা। তা কি আর অ্যাসিডে ছাড়া মরবে! করপোরেশনের কর্তারা ভেজালমিশ্রিত কিউলেক্স মশা নিধনের ওষুধ ছিটাচ্ছে। আপনারাই বলুন, ডালের কাজ কি আর চালে হয়! চা আর কফি কি আর এক জিনিস হলো! এডিস-উপযোগী ওষুধ না এনে তারা অযথাই কালক্ষেপণ করছে। তাদের এহেন বালখিল্য আচরণ দেখে দেড়মাসের দুগ্ধপোষ্য শিশুও খিলখিলিয়ে হাসবে।

ভয়ের কথা এই, এডিস কিন্তু বড়-ছোটো বোঝে না। এরা বড্ড সমাজতান্ত্রিক মশা। যাকে পায় তাকেই কামড়ায়। পুলিশ-প্রশাসন-আমলা-কিষাণ সবাইকে খাচ্ছে। ভয়ে আছি, আবার না আমার মতো নিরীহ লেখককেও খেয়ে বসে! কাল মারা গেল ষষ্ঠ শ্রেণির এক স্কুলছাত্র, তার ছোটো বোনও হসপিটালে ভর্তি। একবার ভাবুন তো তাদের বাবা-মায়ের মনের অবস্থা এখন কেমন!

এর দায় কে নেবে! যারা ক্ষমতায় তাদেরকেই নিতে হবে। কাজ করো, নইলে পদ ছাড়ো। দুই মেয়র শুরু থেকেই বলে এসেছেন এসব নাকি মিডিয়ার অপপ্রচার। পুরোটাই গুজব। তখন এসব না বলে যদি যার যার কাজে মন দিত, তাহলে আর আজ তাদেরকে সেই ‘ল্যারি দ্য ক্যাটে’র মতো চাকরি খোয়ানোর ঝুঁকিতে থাকতে হতো না। আমাদের পোড়াকপাল- ব্রিটেনে আছে ‘ল্যাজি ল্যারি’, আর আমাদের এখানে আছেন ‘পুওর মেয়র’!

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও অতিরিক্ত কমিশনার, বাংলাদেশ কাস্টমস।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :