চামড়ার দরপতন

নেপথ্যে ট্যানারি মালিকদের বকেয়া তিনশ কোটি টাকা?

প্রকাশ | ১৫ আগস্ট ২০১৯, ১০:১৬

জহির রায়হান ও কাজী রফিক

কোরবানির পশুর চামড়ার দাম আগে কখনো এতটা কম ছিল এমনটা স্মরণ করতে পারছে না কেউই। গত কয়েক বছর ধরেই চামড়ার দর কম, তবে এবারের বিষয়টি অনেকের কাছে অবিশ্বাস্য। একটি লাখ টাকার গরুর চামড়া ২০০ থেকে ৪০০ টাকা বিক্রির উদাহরণ নিকট-অতীতে আর নেই।

কিন্তু এই দশা কেন হলো?- ট্যানারি মালিকরা দুষছেন আড়তদারদের, আড়তদাররা বলছেন ট্যানারি মালিকদের দায় এসব। তবে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে ট্যানারি মালিকদের নানা কৌশলের খোঁজ মিলেছে। তবে মালিকরা আবার তা স্বীকার করতে চান না।

অবিশ্বাস্য দরপতনে ক্ষতি হয়েছে দেশের। কারণ, ক্ষুব্ধ হয়ে প্রতিবাদস্বরূপ অনেকে চামড়া মাটিতে পুঁতে রাখছেন। কেউ কেউ ময়লার ভাগাড়ে ফেলে দিয়েছেন।

মৌসুমী ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, সিন্ডিকেট করে কাঁচা চামড়ার দাম কমানো হচ্ছে। অন্যদিকে আড়তদাররা বলছেন, চামড়া কেনার পুঁজিই নেই তাদের। এজন্য তারা চামড়া কিনছেন না।

ট্যানারি মালিকদের সংগঠন ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন প্রথমে বলেছিল, তারা ২০ আগস্ট  কিনবেন। পরে তিন দিন আগানো হয় এই সিদ্ধান্ত।

তবে চামড়ার দাম আড়তে এসে যে কম ছিল এমন না। মৌসুমি ব্যবসায়ীরাই এবার দাম কম বলেছিলেন। সেটা আবার গতবারের লোকসানের কারণে। দুইশ, আড়াইশ, তিনশ টাকাতেও গরুর চামড়া কিনেছেন তারা। কিন্তু তাতেও যে লাভ হয়েছে এমন নয়। আড়তে আসার পর একশ, দেড়শ টাকা দাম শুনে মেজাজ হারিয়ে এখানে সেখানে ফেলে দিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছেন তারা। কোথাও কোথাও গর্ত করে মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়েছে। ফেলা হয়েছে নদীতে।

পাইকারি চামড়া ব্যবসায়ীদের থেকে পাওয়া তথ্য মতে, ট্যানারি মালিকরা ঈদের আগেই তাদের হাতে মূলধন তুলে দেওয়ার কথা। যা দিয়ে তারা খুচরা ব্যবসায়ীদের থেকে এবং নিজেরা সরাসরি চামড়া কিনবেন। এ সময় চামড়া কিনতে নিজেরাও মোটা অঙ্কের বিনিয়োগ করেন তারা নিজেরাও। আর ট্যানারিতে চামড়া পৌঁছার পরেও বাকি থাকে টাকা। এক বছরের টাকা পরের বছরেও দেওয়া হয়।

কিন্তু ২০১৭ সালে এসে অগ্রিম টাকা দেয়া বন্ধ করে দেন ট্যানারি মালিকরা। সেই সাথে পাইকারদের অনেক টাকা বাকি পড়ে ট্যানারি মালিকদের কাছে। বকেয়া টাকা এক বছরেরটা পরের বছরও পাচ্ছেন না এসব পাইকারি ব্যবসায়ী। এখন পর্যন্ত প্রচুর টাকা বকেয়া আছে ট্যানারির কাছে।

ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে নিজেদের পকেট থেকে টাকা দিয়ে চামড়া কিনছিলেন এসব পাইকার। কিন্তু গত বছর পাইকারদের থেকে বাকিতে চামড়া নেয়ার পাশাপাশি ট্যানারি মালিকরা খুচরা ব্যবসায়ীদের সরাসরি চামড়া কিনেছেন এমন অভিযোগ পাওয়া গিয়েছিল।

পাইকাররা জানান, তাদের থেকে চামড়া নিতে হলে আগের বকেয়া পরিশোধ করতে হবে। তাই ট্যানারিগুলো নগদ টাকায় খুচরা ব্যবসায়ীদের থেকে সরাসরি চামড়া নিয়েছে।

২০১৮ সালে এমন ঘটনার কারণে চামড়ার দরপতন ঘটে। পাইকাররা নির্ধারিত দামে চামড়া নিতে রাজি না হওয়ায় কম দামেই চামড়া বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন অনেক খুচরা ও মৌসুমি ব্যবসায়ী। সেটি এবার চূড়ান্ত রূপ নিয়েছে।

গত বছর ট্যানারিগুলোর এই কারসাজিতে পচে যায় এক লাখ গরু ও ২০ লাখ ছাগলের চামড়া। ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন বলছে, ওই বছর কোরবানি হওয়া পশুর প্রায় ৩৫ শতাংশ চামড়া নষ্ট হয়েছিল।

সেই অভিজ্ঞতার কারণে এবার আগে ভাগেই সতর্ক পাইকাররা। এমনিতে প্রতি বছর ঈদের দিন বিকেল থেকে পাড়া-মহল্লায় দেখা মেলে পাইকারদের। এলাকায় এলাকায় এসে দর কষাকষি করে তারা চামড়া কিনে নিয়ে যান। এবছর চিত্র পুরো উল্টো। পাইকারদের দেখা নেই।

যেখানে খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে পাইকাররা প্রতিবছর ধর্ণা দেন, সেখানে এ বছর ধর্ণা ধরতে হয়েছে খুচরা ব্যবসায়ীদের। কিন্তু তারপরেও চামড়া কিনতে রাজি নন পাইকাররা। আবার যারা চামড়া কিনবেন তারাও দাম বলছেন দুইশ থেকে তিনশ টাকা।

আড়তদাররা জানিয়েছেন, তাদের কাছ থেকে চামড়া কিনে ৩০০ কোটি টাকা পরিশোধ করছেন না ট্যানারি মালিকরা। আর অর্থ সংকটে তারা চামড়া কিনতে পারছেন না।

এই অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ট্যানারি মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএ) সভাপতি শাহীন আহমেদ বলেন, ‘আড়তদাররা বকেয়া টাকা না পাওয়ার কথা বলে প্রান্তিক মানুষের কাছ থেকে কমদামে চামড়া কিনেছে। বড় আড়তাররা এবার চামড়ার বাজারটাকে ম্যানুপুলেট করেছে।’

বিটিএর সাধারণ সম্পাদক  শাখাওয়াত উল্লাহ ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আড়তদার ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা এর জন্য দায়ী । কারণ বাজার থেকে চামড়া সংগ্রহ করে তারা। আমরা লবণ দেওয়া চামড়া কিনে নেই তাদের কাছ থেকে। কিন্তু তারা কেন ন্যায্য দাম দিচ্ছে না সে সম্পর্কে আমাদের ধারণা নেই।’

যথাযথ মূল্য না পাওয়ায় চামড়া পুঁতে ফেলার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে এই ব্যবসায়ী বলেন, তাঁর ধারণা, যেসব চামড়াগুলো মাটিতে পোঁতা হয়েছে, সেগুলো বিক্রির উপযুক্ত নয়। এগুলো পচে গেছে।

‘কারণ মৌসুমি ব্যবসায়ী বা ফড়িয়ারা চামড়া কেন ঠিকই, কিন্তু তারা এটাকে সংরক্ষণ করার প্রক্রিয়া জানে না; বা ভালো দামের আশায় অনেক সময় পার করে সেগুলোকে নষ্ট করে ফেলে। সাধারণত ছয় বা সাত ঘণ্টার মধ্যে চামড়া প্রক্রিয়াজাত করা লাগে। সেটা করতে না পারলে পচে যায়।’

 

চামড়ার ব্যাপক দরপতনের পর এবারই প্রথম কাঁচা চামড়া রপ্তানির অনুমোদন দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।  মঙ্গলবার মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে চামড়া শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের দায়িত্বশীল হতেও বলা হয়।

কাঁচা চামড়া আড়তদারদের সংগঠন বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের (বিএইচএসএমএ) সেক্রেটারি টিপু সুলতান ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘কাঁচা চামড়া রপ্তানির জন্য সরকার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেটাকে আমরা স্বাগত জানাই। এর ফলে সরাসরি চামড়া রপ্তানি হবে। সেই সঙ্গে বৈধ পথে সরকারের রপ্তানি আয় বাড়বে।’

কিন্তু দাম কেন অস্বাভাবিক কম?- জানতে চাইলে এই ব্যবসায়ী নেতা বলেন, ‘ট্যানারি মালিকদের কাছ এখনও আমরা ৩০০ কোটি টাকা পাই। সে টাকা তারা পরিশোধ করেনি। টাকার অভাবে আমরা কোরবানির চামড়া কিনতে পারছি না। আর আমাদের কাছে টাকা না থাকলে কীভাবে কিনব?

বুধবারও কিছু কাঁচা চামড়া আসতে দেখা গেছে  লালবাগের কাঁচা চামড়া পাইকারি বাজার পোস্তায়। বুধবার কোরবানি দেওয়া গরুর বড় চামড়া বিক্রি হতে দেখা গেছে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকায়। আর ছোট চামড়া ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা। এমন সময় আগে যেখানে ট্রাক ভরে চামড়া আসত তেমন কোনো চিত্র দেয়া যায়নি।

১৮ বছর ধরে কাঁচা চামড়া কিনছেন শাহদাত হোসেন। তিনি বলেন, ‘আজ আমি ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা করে চামড়া কিনছি। তাহলে বলুন কেন আমরা প্রথম দিন চামড়া কিনব না? আসলে দেখা যায় ঈদের প্রথম দিন যে পশু কোরবানি দেয়া হয়েছে, সেগুলোর চামড়া পরদিন সকালেও আসছে। তার উপর রাতে বৃষ্টিতে ভিজেছে। এই চামড়া নষ্ট হয়ে গেছে। আর নষ্ট চামড়া দিয়ে কী করব আমরা?’

‘আমরা কোন সিন্ডিকেট করিনি। আসলে চামড়া সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা হয়নি। বা দ্রুত আমাদের কাছে আনা হয়নি। যারা এনেছে তারা ভালো দামই পেয়েছে।’

‘সরকার লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করছে। আমরা লবণ ছাড়া যে চামড়া কিনছি সেগুলো লবণ দেওয়ার পর গড়ে দাম পড়েছে ১২০০ টাকা।’ 

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (খামার) এ বি এম খালেদুজ্জামানের তথ্যমতে, গত বছর এক কোটি ১৫ লাখ পশু জবাই হয়। এর মধ্যে গরু-মহিষ সাড়ে ৫৪ লাখ, আর ছাগল ও ভেড়া ৫১ লাখের বেশি। এবার গতবারের চেয়ে পাঁচ শতাংশ বেশি বিক্রি ধরেছেন তারা। তাতে এক কোটি ১১ লাখ থেকে এক কোটি সাড়ে এগারো লাখ হবে। এর মধ্যে ৬৫ লাখের বেশি জবাই হয়েছে গরু।

এবার কোরবানির পশুর চামড়ার দাম গত বছরের হার অপরিবর্তিত রেখেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। সরকার নির্ধারিত মূল্য অনুযায়ী গরুর কাঁচা চামড়ার মূল্য রাজধানীতে প্রতি বর্গফুট ৪৫ থেকে ৫০ টাকা, ঢাকার বাইরে প্রতি বর্গফুট ৩৫ থেকে ৪০ টাকা। খাসির কাঁচা চামড়ার মূল্য সারা দেশে ১৮ থেকে ২০ টাকা এবং বকরির কাঁচা চামড়ার মূল্য সারা দেশে ১৩ থেকে ১৫ টাকা।

(ঢাকাটাইমস/১৫আগস্ট/ডব্লিউবি/জেবি)