বঙ্গবন্ধুকে ধারণ করতে হবে অন্তরে

প্রভাষ আমিন
 | প্রকাশিত : ১৬ আগস্ট ২০১৯, ০৯:২৯

এখন বাংলাদেশে লাখ লাখ, কোটি কোটি বঙ্গবন্ধুপ্রেমিক। কিন্তু পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পর বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ করার মতো সাহসী মানুষ ছিল খুব কম। ২১ বছর বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ছিলেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশ টেলিভিশনে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচার করা হয়, তখন দেশজুড়ে দারুণ এক আবেগের ঢেউ খেলে গিয়েছিল। সময়ের কারণে সেই আবেগ অনেকটাই থিতিয়ে এসেছে। তবে বঙ্গবন্ধুর আবেদন চিরকালীন। ব্যক্তিগতভাবে আমি যতবার বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ শুনি ততবার শিহরিত হই, উদ্বেলিত হই।

কিন্তু আওয়ামী লীগের অতি ব্যবহার আর দলীয়করণই বঙ্গবন্ধুর প্রতি সেই উত্তাল আবেগ থিতিয়ে আসার জন্য কিছুটা দায়ী। তবে বঙ্গবন্ধুর প্রতি সাধারণ মানুষের ভালোবাসা কমেনি। বঙ্গবন্ধুর দুটি বই ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’ প্রকাশের পরও আমরা দেখেছি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সর্বস্তরের মানুষের আবেগ কতটা শুদ্ধ। দুটি বই-ই বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বাধিক বিক্রীত। তবে কতটা পঠিত সে নিয়ে সন্দেহ আছে। পড়লেও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বঙ্গবন্ধুর বই দুটি কতটা আত্মস্থ করতে পেরেছে বা করতে চাইছে, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।

ইদানীং আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারকরা বুঝতে পেরেছেন, বঙ্গবন্ধুকে দলীয় আবর্তে কুক্ষিগত রাখা তাদের জন্যই ক্ষতি। তাই নানামুখী চেষ্টা চলছে বঙ্গবন্ধুকে সর্বস্তরে ছড়িয়ে দেওয়ার। এমনকি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কমিকস পর্যন্ত বানানো হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে মানুষের হৃদয়ে পৌঁছে দেওয়ার সবচেয়ে সহজ উপায় হলো শিশুদের কাছে নিয়ে যাওয়া। তাহলেই বঙ্গবন্ধু যুগ যুগ ধরে বেঁচে থাকবেন। আর এটা করার জন্য শিশুদের বঙ্গবন্ধু পাঠ বাড়াতে হবে, তাদেরকে বঙ্গবন্ধুর গল্প শোনাতে হবে, মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনাতে হবে। চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় বঙ্গবন্ধুর ছবি আঁকাকে উৎসাহিত করতে হবে। কিন্তু আওয়ামী লীগের সে বার্তা ঠিকভাবে তৃণমূলে পৌঁছেছে বলে মনে হয় না। তাই তো পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রীর আঁকা বঙ্গবন্ধুর ছবি দিয়ে স্বাধীনতা দিবসের কার্ড করায় জেলে যেতে হয় ইউএনওকে। যদিও কঠোর ব্যবস্থা নিয়ে সে ঘটনার মীমাংসা করা গেছে, কিন্তু কারো কারো বাণিজ্যমনস্কতা এবং অতি স্পর্শকাতরতা বঙ্গবন্ধুকে সাধারণ মানুষ থেকে দূরে ঠেলে রাখছে। বিশেষ করে ইউএনওর কারাগারে যাওয়ার পর বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এক ধরনের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে। আমি নিশ্চিত বরিশালের ঘটনার পর শিশুরা আর ভয়ে বঙ্গবন্ধুকে আঁকবেন না।

বঙ্গবন্ধু নিছক একজন ব্যক্তি নন, বঙ্গবন্ধু একটি প্রতিষ্ঠান, একটি চেতনার নাম। টুঙ্গিপাড়ার অজপাড়াগাঁ থেকে উঠে আসা অতি সাধারণ একজন মানুষ হয়ে উঠলেন একটি জাতির আশা-আকাক্সক্ষার প্রতীক। তার ডাকে মৃত্যুকে উপেক্ষা করে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ল সবাই। একাত্তরে বঙ্গবন্ধু ছিলেন সবার। কিন্তু এখনকার বাংলাদেশ দেখলে মনে হতে পারে, বঙ্গবন্ধু শুধু আওয়ামী লীগের। কিন্তু তা তো হওয়ার কথা নয়। বঙ্গবন্ধু সবার, বঙ্গবন্ধু জাতির পিতা। বঙ্গবন্ধুকে দলীয় গ-িতে কুক্ষিগত করে রাখলে আওয়ামী লীগের ক্ষতি। বঙ্গবন্ধু যত বিস্তৃত হবেন, আওয়ামী লীগের তত লাভ।

বলছিলাম বাণিজ্যমনস্কতার কথা। ওবায়দুল কাদেরের ভাষায় ‘হাইব্রিড’, ‘ফার্মের মুরগি’ আর ‘কাউয়া’ মানে নব্য আওয়ামী লীগারদের মূল পুঁজি বঙ্গবন্ধু। তারা বঙ্গবন্ধুকে সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করে আওয়ামী লীগার হতে চান। আগস্ট মাস এলেই তোরণে, পোস্টারে, র‌্যালিতে বঙ্গবন্ধুর অপব্যবহার হয়। গত বছর শোক দিবসের বিরানির প্যাকেটেও বঙ্গবন্ধুর ছবি ব্যবহার করা হয়েছিল। বিরানি খেয়ে নব্য বঙ্গবন্ধুপ্রেমিকরা সেই প্যাকেট ছুঁড়ে ফেলেছিল রাস্তায়। বঙ্গবন্ধুর নাম ব্যবহার করে গত কয়েক বছরে কয়টি সংগঠন হয়েছে, সেটা কি জানেন আওয়ামী লীগের নেতারা? গত কয়েক বছরে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তিনশরও বেশি বই প্রকাশিত হয়েছে। খুব ভালো কথা। কিন্তু এই বঙ্গবন্ধু বিশেষজ্ঞরা এতদিন কোথায় ছিলেন? তার চেয়ে বড় কথা এই বইগুলোর কয়টি সত্যিকারের গবেষণাগ্রন্থ? আর কয়টি নিছক আওয়ামী লীগের শীর্ষ মহলের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য করা?

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সংগঠন গড়া, বই লেখা, গবেষণা করায় আমার আপত্তি নেই। বঙ্গবন্ধু পরিবারের প্রতি খালি একটা অনুরোধ, বঙ্গবন্ধুর নাম ব্যবহারের ক্ষেত্রে একটা ফিল্টারিংয়ের ব্যবস্থা করা হোক। যেখানে-সেখানে বঙ্গবন্ধুর নাম ব্যবহার করে কেউ যেন ধান্দাবাজি করতে না পারে, বঙ্গবন্ধুকে যেন খাটো করতে না পারে।

এক অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে চাঁদাবাজি না করতে সতর্ক করে দিয়েছেন। এই সতর্ক বার্তায় এটা পরিষ্কার, জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে দেশজুড়ে চাঁদাবাজি হয়। ওবায়দুল কাদের আগেই সতর্ক হয়েছেন বলে এবার হয়তো কম হবে। কিন্তু একেবারেই কি বন্ধ হয়ে যাবে? আগেই বলছিলাম, বঙ্গবন্ধুর বই দুটি কয়জন পড়েছেন বা আত্মস্থ করেছেন। গলার রগ ফুলিয়ে ফুলিয়ে যে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কথা বলেন, বোঝেন কয়জন? বঙ্গবন্ধু ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য রাজনীতি করেননি, করেছেন একটি জাতির মুক্তির জন্য। জীবনের স্বর্ণালি সময়টা তার কেটেছে কারাগারে। বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি ছিল ত্যাগের, ভোগের নয়। তিনি পায়ে হেঁটে, সাইকেলে চড়ে, ট্রেনের তৃতীয় শ্রেণিতে চড়ে রাজনীতি করেছেন। ক্ষমতার প্রভাব বলয়ে থাকা কেউ কেউ বিলাসী জীবনে আছেন। এর মধ্যে কিছু ছাত্রনেতার বিষয়েও অনেক অভিযোগ আছে। তাদের বিলাসী জীবনের আয়ের উৎস নিয়ে প্রশ্ন তোলেন খোদ সংগঠনের নেতারাই। ক্ষমতার সংস্পর্শে থাকা বড় একটি অংশ দেশজুড়ে যে চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, ধর্ষণ, নিজেদের মধ্যে মারামারি, টেন্ডারবাজি করে; তারা কি একবারও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কথা ভাবে? ভাবলে কি এমনটা করতে পারতো? এ বিষয়ে আবারও নতুন করে লাগাম ধরে টানতে হবে শীর্ষ নেতৃত্বকে।

১৫ আগস্ট চাঁদাবাজির টাকা দিয়ে বড় বড় কাঙালি ভোজ করলেই বঙ্গবন্ধুর আত্মা শান্তি পাবে না। পোস্টারে নয়, বিরানির প্যাকেটে নয়; বঙ্গবন্ধু ও আদর্শকে ধারণ করতে হবে হৃদয়ে।

লেখাটি শেষ করছি বঙ্গবন্ধুর একটি ভাষণ উদ্ধৃত করে।

১৯৭৫ সালে বাকশাল গঠনের পর জাতীয় সংসদে তিনি বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগ একটি মাল্টি-ক্লাস পার্টি। আমি তার নামের আগে কৃষক শ্রমিক লাগিয়েছি বৈকি, কিন্তু দলটির চরিত্র এখনো বদলাতে পারিনি, রাতারাতি তা সম্ভবও নয়। আমার দলে নব্য-ধনীরাও আছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ায় তাদের লুটপাটের সুযোগ বহুগুণ বেড়ে গেছে। আমি তাদের সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্যই বাকশাল করেছি। যদি এই ব্যবস্থা সফল করতে ব্যর্থ হই এবং আমার মৃত্যু ঘটে, তাহলে দলকে কব্জা করে ওরা আরও লুটপাটে উন্মত্ত হয়ে উঠতে পারে। এমনকি স্বাধীন বাংলাদেশের মূলমন্ত্রে শত্রুপক্ষের নীতি ও চরিত্র অনুসরণ করে আওয়ামী লীগেরও চরিত্র ও নীতি পাল্টে ফেলতে পারে। যদি তা হয়, সেটাই হবে আমার দ্বিতীয় মৃত্যু। সেজন্য আগেই বলেছি, আমার দল, আমার অনুসারীদের হাতেই যদি আমার এই দ্বিতীয় মৃত্যু ঘটে, তাহলে দীর্ঘকালের জন্য বিস্মৃতির অন্ধকারে চলে যেতে হবে। কবে ফিরব তা জানি না।’ বঙ্গবন্ধু দূরদর্শীও ছিলেন বটে।

লেখক: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :