হংকং বিক্ষোভে চীনের হস্তক্ষেপ নিয়ে আশঙ্কা

আন্তর্জাতিক ডেস্ক, ঢাকা টাইমস
 | প্রকাশিত : ১৭ আগস্ট ২০১৯, ০৯:১৮

কয়েক সপ্তাহ ধরে বিক্ষোভ চলছে হংকংয়ে। বিতর্কিত প্রত্যর্পণ আইনের বিরোধিতায় এই বিক্ষোভ ক্রমশই সহিংস হয়ে উঠেছে। সহিংসতা আর হরতাল জনজীবনে বড়ধরনের ব্যাঘাত সৃষ্টি করছে। চীন সরকার বিক্ষোভকারীদের কড়াভাষায় সমালোচনা করেছে। অনেকের মনেই এখন প্রশ্ন চীন কি শেষ পর্যন্ত ধৈর্য হারাবে এবং সরাসরি পদক্ষেপ নিতে উদ্যোগী হবে?

কিন্তু চীনের এক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করার আইনগত কতটা অধিকার আছে? হংকংয়ে চীনা সামরিক পদক্ষেপের সম্ভাবনা কতটা?

মূল আইন খুবই পরিষ্কার। ১৯৯৭ সালে ব্রিটেন হংকং এর প্রশাসন চীনের কাছে ফিরিয়ে দেবার পর হংকং এর একটা নতুন সংবিধান তৈরি করা হয়েছিল। সে অনুযায়ী যতক্ষণ না হংকংয়ে সার্বিকভাবে জরুরি অবস্থা জারি হচ্ছে অথবা হংকংয়ে যুদ্ধাবস্থা ঘোষণা করা হচ্ছে, ততক্ষণ চীনের সামরিক হস্তক্ষেপ একমাত্র ঘটতে পারে হংকং সরকার সে অনুরোধ জানালে। এছাড়া জন শৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে এবং দুর্যোগের সময় ত্রাণকাজে।

তবে বেশিরভাগ বিশ্লেষক বলছেন এই পর্যায়ে পিএলএ বা পিপলস লিবারেশন আর্মির সৈন্যদের হংকংয়ের রাস্তায় নামানোর বিষয়টা প্রায় চিন্তার বাইরে। চীনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইভান চয় বলেন, ‘এটা কাঠামোগত এবং অর্থনৈতিক পরিবেশে একটা নাটকীয় পরিবর্তন নিয়ে আসবে। 'এধরনের পদক্ষেপের পরিণতি সূদুর-প্রসারী হতে পারে।’

চয় বলেন, হংকংয়ের দায়িত্ব হস্তান্তরের পর থেকে যে ‘এক দেশ- দুই পদ্ধতি’ মডেলে হংকং এর শাসন ব্যবস্থা চলে এসেছে, এ ধরনের পদক্ষেপের ফলে তার ওপর আস্থা পুরো ভেঙে যাবে- এতটাই যে তা সম্ভবত সে বিশ্বাস আর পুনরুদ্ধার করা যাবে না।

হস্তান্তরের পর থেকে হংকংয়ে পিএলএ এর প্রায় ৫ হাজার সৈন্য রয়েছে। ম্যাককোয়ারি ইউনিভার্সিটির গবেষক অ্যাডাম নাই বলেন, এটা মূলত চীনা সার্বভৌমত্বের একটা প্রতীকি উপস্থিতি।

তবে ৩১শে জুলাই সেনানিবাস তাদের নীরব ও পরোক্ষ ভূমিকা ভঙ্গ করেছে। প্রতিবাদ নিয়ে একটি ভিডিও প্রকাশ পেয়েছে যাতে দেখা যাচ্ছে সৈন্যরা ক্যান্টনিজ ভাষায় চিৎকার করছে, ‘এর পরিণতির জন্য আপনারা পুরো দায়ী থাকবেন’! সৈন্যরা বিক্ষোভকারীদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে এবং ফুটেজের একটি দৃশ্যে দেখা যাচ্ছে পুলিশ একটি ব্যানার ধরে রয়েছে যাতে লেখা ‘এগোন বন্ধ কর, নাহলে আমরা শক্তি ব্যবহার করব’। সাধারণত অসন্তোষের সময় হংকং পুলিশ এধরনের ভাষা ব্যবহার করে থাকে।

চয় বলেন, বেইজিং ক্রমাগত চেষ্টা করছে হংকং এর মানুষকে মনে করিয়ে দিতে এমন (সামরিক শক্তি ব্যবহারের) সম্ভাবনা আছে। তারা এমন পদক্ষেপের সম্ভাবনা নাকচ করে দিতে চায় না। তাদের আশা এটা একধরনের মনস্তাত্ত্বিক চাপ তৈরি করবে।

এ যাবৎ চীনের হংকং বিষয়ক সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারনী দপ্তর বলে এসেছে যে হংকং পুলিশ অসন্তোষ দমন করতে পারবে সে ব্যাপারে তাদের পূর্ণ আস্থা আছে। তবে তাদের মুখপাত্র ইয়াং গুয়াং এমন হুঁশিয়ারিও দিয়ে বলেছেন, যারা আগুন নিয়ে খেলছে, সেই আগুনই তাদের ধ্বংস করবে এবং বিক্ষোভকারীরা যেন মনে না করে যে সংযমের অর্থ দুর্বলতা।

নাই বলেন, সামরিক হস্তক্ষেপ চীনা সরকারের জন্য মস্ত বড় একটা রাজনৈতিক ঝুঁকি তৈরি করবে, দেশের ভেতর এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও। এছাড়াও যে কোনরকম সামরিক হস্তক্ষেপ পরিস্থিতি আরও খারাপ করতে পারে- আরও প্রতিরোধ গড়ে উঠতে পারে।

চীন কি রাজনৈতিকভাবে হস্তক্ষেপ করতে পারে?

হংকং এর রাজনৈতিক ব্যবস্থা পুরোপুরি গণতান্ত্রিক নয়। বিক্ষোভকারীদের বিরোধিতার পেছনে সেটা একটা কারণ। তারা গণতান্ত্রিক সংস্কারের আহ্বান জানাচ্ছে। অন্যদিকে, চীন হংকং এর রাজনীতিতে বেশ কিছু হস্তক্ষেপ করেছে। তার থেকেই সর্বসাম্প্রতিক এই বিক্ষোভের জন্ম।

হংকং এর সংসদ চীনপন্থী এবং অংশত গণতান্ত্রিক। এর প্রায় অর্ধেক আসনে প্রার্থী নির্বাচিত হন ভোটারদের প্রত্যক্ষ ভোটে। প্রধান নির্বাহীকে নির্বাচিত করেন প্রধানত বেইজিংপন্থী একটি নির্বাচনী কমিটি। ভোটারদের মাত্র ৬ শতাংশের ভোটে এই কমিটি নির্বাচিত হয়। সমালোচকরা বলেন, হংকং এর নেতৃত্বের দায়বদ্ধতা চীনের কাছে- হংকং এর জনগণের কাছে নয়।

ক্যারি ল্যাম নির্বাচিত হন ২০১৭ সালে। বর্তমানে অকার্যকর প্রত্যর্পণ বিলটি তিনিই চালু করেন এবং এই বিক্ষোভে জনরোষের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠেন। হংকংয়ে বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডিক্সন মিং সিং বলেন, চীন 'তার ক্ষমতা প্রদর্শনের লক্ষ্যে অনেক কিছুই করেছে...এছাড়াও ক্যারি ল্যামের পদত্যাগের প্রশ্নে প্রবল আপত্তি বজায় রেখেছে, পাশাপাশি প্রত্যর্পণ বিলটি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রত্যাহার করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।

‘বেইজিং যদি ক্যারি ল্যামের পদত্যাগ চায় সেটা কি সম্ভব?’ এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলছেন, ‘অবশ্যই। কিন্তু চীন কর্তৃপক্ষ সেটা চায় না, কারণ তারা দেখাতে চায় যে জনগণের দাবিতে তারা নীতি বদলায় না।’

তবে, মিস ল্যাম তার পদ ছেড়ে দিলেও, তার উত্তরসূরীও আসবেন বেইজিং এর সমর্থনপুষ্ট হয়েই।

চীন কি আন্দোলনকারীদের চিহ্ণিত করে পদক্ষেপ নিতে পারে?

হংকং এ বিক্ষোভের সূত্রপাত হয় প্রত্যর্পণ আইন বিষয়ক বিল নিয়ে। সমালোচকদের আশঙ্কা রাজনৈতিক আন্দোলনকারীদের চীনের মূল ভূখন্ডে নিয়ে যাবার জন্য চীন এই আইন ব্যবহারের পরিকল্পনা নিয়েছিল। সেখানে তাদের দণ্ড দেওয়া প্রায় নিশ্চিত হয়ে যেত।

ক্যারি ল্যাম বলেছেন এই বিল এখন মৃত। কিন্তু এই বিল না থাকলেও এধরনের আইনের পাশ কাটিয়ে চীনের হংকং এর নাগরিকদের আটক করার যথেষ্ট দৃষ্টান্ত রয়েছে। যেটা হংকং এর নাগরিকদের জন্য উদ্বেগের।

গুই মিনহাইয়ের হংকংয়ে একটি বইয়ের দোকান ছিল। তিনি চীনা সরকার বিরোধী বই বিক্রি করতেন। ২০১৫ সালে তিনি থাইল্যান্ডে নিখোঁজ হয়ে যান। এরপর ২০০৩ সালে এক ভয়াবহ গাড়ি দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে চীনে তিনি ধরা পড়েন।

চীনের এক আদালত তাকে দু’বছরের কারাদণ্ড দেয়। ২০১৭ সালে তিনি মুক্তি পান, কিন্তু পরের বছরই চীনে একটা রেলগাড়ি থেকে তাকে আবার আটক করা হয়। এরপর থেকে কেউ আর তাকে দেখেনি।

হংকং বিক্ষোভকারীরা ভয় পাচ্ছেন তারা নিজেরা ধরা না পড়লেও চীনের মূল ভূখন্ডে তাদের পরিবারের সদস্যরা দমনপীড়নের শিকার হতে পারেন। হংকংয়ে এই মুহূর্তে চীনের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ নিয়ে আশংকা বিরাজ করছে। পাশাপাশি বিক্ষোভ দমনে চীনের সবচেয়ে কার্যকর অস্ত্র এখন অর্থনৈতিকভাবে হংকংকে শাস্তি দেয়া।

হংকং অর্থনীতির একটা মূল কেন্দ্র। হস্তান্তর চুক্তির অংশ হিসাবে যেসব বিশেষ সুবিধা তাদের দেওয়া হয়েছিল তা হংকংকে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী করেছে। কিন্তু এরপরেও ১৯৯৭ সালের পর থেকে মূল ভূখন্ডে শেনঝেন আর শাংহাই দ্রুত অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সিঁড়ি বেয়ে উঠে এসেছে।

এখন হংকং যদি চীনের কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ জানানো অব্যাহত রাখে, তাহলে চীন সরকার বিনিয়োগ ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে মূল ভূখন্ডকেই অগ্রাধিকার দেবে এবং চেষ্টা করবে হংকংএর অর্থনীতিকে চাপে রাখতে। তারা চাইবে এমন পরিস্থিতি তৈরি করতে যাতে হংকং তার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য চীনের মুখাপেক্ষী হতে বাধ্য হয়।

ঢাকা টাইমস/১৭আগস্ট/একে

সংবাদটি শেয়ার করুন

আন্তর্জাতিক বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

আন্তর্জাতিক এর সর্বশেষ

তীব্র গরমে বিশ্বব্যাপী বছরে ১৯ হাজার শ্রমজীবীর মৃত্যু

গাজা ইস্যুতে উত্তাল যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো 

ফের দফায় দফায় ভূমিকম্পে কেঁপে উঠল তাইওয়ান

ইরানে ছোড়া একটি ক্ষেপণাস্ত্র নিজেরাই ধ্বংস করে ইসরায়েল!

মালদ্বীপে সংসদ নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী চীনপন্থি প্রেসিডেন্ট মুইজ্জুর দল

পাকিস্তান সফরে ইরানের প্রেসিডেন্ট রাইসি 

ব্যর্থতার দায় নিয়ে ইসরায়েলের সামরিক গোয়েন্দা প্রধানের পদত্যাগ 

২৬ হাজার শিক্ষকের চাকরি বাতিল করলো কলকাতা হাইকোর্ট

ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান তুরস্কের

সিরিয়ায় মার্কিন ঘাঁটিতে ইরাকি সশস্ত্র গোষ্ঠীর রকেট হামলা  

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :