বাসন্তীর জাল পরা ছবি এবং চামড়া দাফন!

প্রকাশ | ১৭ আগস্ট ২০১৯, ১৫:০৩

আলম রায়হান

এবার কোরবানির পশুর চামড়ার দরপতন ৩১ বছরের রেকর্ড ছাড়িয়েছে। এটি এক হতাশাজনক ও উদ্বেগের খবর। স্বীকার করতেই হবে, কোরবানির পশুর চামড়া নিয়ে এবার মহা এক কেলেঙ্কারি হয়েছে। এ খবর সবাই জানে। সাথে সাথে সতর্ক হবার মতো একটি খবরও রয়েছে। তা হচ্ছে, লাশ দাফনের আদলে চামড়া মাটিচাপা দেয়া। এ বিষয়টি নানান প্রশ্ন সামনে নিয়ে এসেছ। প্রধান প্রশ্ন, এর পেছনে পঁচাত্তরের থিংকট্যাংকয়ের কৌশলের পুনরাবৃত্তি হয়নি তো!

স্মরণ করা যেতে পারে, ১৯৭৪-এর দুর্ভিক্ষে বাসন্তির জাল পরা সাজানো ছবি বড় রকম সর্বনাশের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল বাংলাদেশের জন্য। এবার চামড়া ‘দাফনের’ পেছনেও একই রকম কারসাজি আছে কি না তাও ভেবে দেখা প্রয়োজন! বরিশালের সাংবাদিক মামুন অর রশিদ তার ফেসবুক পোস্টে চামড়ার দরপতর প্রসঙ্গে প্রশ্ন তুলেছেন, ‘ইসলাম ও মুসলমানদের ক্ষতি, নাকি সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে এমন সিন্ডিকেট?’

চামড়ার বাজারে এবার ভিন্ন চিত্র প্রসঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ৮০ হাজার টাকার গরুর চামড়া এবার বিক্রি হয়েছে ২০০ টাকারও কম দামে। ৩০০ টাকার কমে বিক্রি হয়েছে এক লাখ টাকা মূল্যের গরুর চামড়া। চামড়া প্রাথমিক সংরক্ষণের এ দামের চেয়ে লবণ কিনতে হয় বেশি টাকায়।

বলা হচ্ছে, সিন্ডিকেটের কারণে চামড়ার দরপতন হয়েছে। আগের বছরগুলোতে কোরবানির কয়েকদিন আগ থেকে চামড়া প্রত্যাশা করে দ্বারে দ্বারে ধর্ণা একটি সাধারণ বিষয় ছিল। নামাজের পরপরই পাড়া-মহল্লায় অসংখ্য মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীর ভিড় দেখা যেতো। কিন্তু এবার তাদের দেখা মেলেনি। একসময় চামড়া কেনার জন্য রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় মৌসুমি ব্যবসায়ীদের ব্যস্ততা ছিল চোখে পড়ার মতো। চামড়া কেনা নিয়ে হানাহানি-মারামারি-খুনোখুনির ঘটনাও ঘটেছে অসংখ্য। কিন্তু এবারের দৃশ্যপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। তবে, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায়  মাদ্রাসা ও এতিমখানার লোকজন বিনা পয়সায় কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করছেন। তবে তাও অনেক ক্ষেত্রে ‘বিনে পয়সায় আলকাতরা’ খাবার মতো অবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সরকার নির্ধারিত দাম অনুযায়ী, ঢাকায় কোরবানির গরুর প্রতিটি ২০ থেকে ৩৫ বর্গফুট চামড়া লবণ দেওয়ার পরে ৯০০ থেকে এক হাজার ৭৫০ টাকায় কেনার কথা ট্যানারি মালিকদের। কিন্তু, বাস্তবে তা হয়নি। সরকার নির্ধারিত মূল্যে চামড়া বিক্রি তো দূরের কথা, এবার চামড়ার দামে বিপর্যয় ঘটেছে। এ বিপর্যয়ের ঘটনাকে কেন্দ্র করে সরকারের নেতা-মন্ত্রীরা নানান ধরনের বিরক্তিকর কথা বলেছেন। সবচেয়ে হাস্যকরা কথা হচ্ছে, কাঁচা চামড়া রপ্তানির সিদ্ধান্তের আওয়াজ দেওয়া। এ আওয়াজ দিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী স্বয়ং। ফলে বাণিজ্য সম্পর্কে তার কোনো ধারণা আছে কি না সেটিই এক বড় প্রশ্ন। আবার নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী আর কাঠি সরেস! তিনি চামড়া মাটিচাপা দেবার কারণ অনুসন্ধানের দায়িত্ব দিয়েছেন সাংবাদিকদের!

এবার যারা কোরবানি দিয়েছেন, তারা যেমন চামড়ার দাম পাননি তেমনই দাম পাননি মৌসুমি ব্যবসায়ীরাও। সংশ্লিষ্ট কেউ কেউ বলছেন, আর্থিক সংকটে আড়তদাররা চামড়া কিনতে পারছেন না। আবার ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, সিন্ডিকেট করে চামড়ার দাম একেবারেই কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা বলছেন, চামড়ার দাম নিয়ে অন্তরালে কেউ কেউ নোংরা খেলা খেলেছেন। মৌসুমি ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, আড়তদার ও ব্যবসায়ীর সিন্ডিকেট করে চামড়ার বাজার কমিয়ে দিয়েছেন।

নেপথ্য কারণ যাই হোক, এবার কোরবানির চামড়া নিয়ে বড় রকমের কেলেঙ্কারি হয়েছে, মানতেই হবে। এর ফলে অনেকেই রাতভর ক্রেতার জন্য বিফল অপেক্ষায় থেকে অবশেষে রাস্তায় চামড়া ফেলে রেখে চলে গেছেন। এ ঘটনা ঘটেছে অসংখ্য; দেশের বিভিন্ন স্থানে। কিন্তু অন্যরকম ঘটনা ঘটেছে সুনামগঞ্জে। কোরবানির পশুর ৯০০ চামড়া মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়েছে। সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার শাহারপাড়া ইউনিয়নের সৈয়দপুর গ্রামে এ ঘটনা ঘটেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, বিনামূল্যে সংগ্রহ করা চামরাগুলো প্রাপ্তমূল্যে বিক্রি না করে মাটি চাপা দেবার মতো পরিশ্রম কেন করা হলো? মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ কি এতোই দায়িত্ববান ও পরিবেশ সচেতন!

চামড়ার দরপতন নিয়ে দেশব্যাপী চরম ক্ষোভের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে সুনামগঞ্জে চামড়া মাটিচাপ দেবার ঘটনা। সাথে সাথে অনেককেই স্মরণ করিয়ে দিয়েছে, বাসন্তির জাল পরা ছবির বিষয়টি। ইত্তেফাকে প্রকাশিত ছবির মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, অভাবের তারনায় কঙ্কালসার এক যুবতী আব্রু রক্ষায় মাছধরা জাল পরেছে। আফতাব আহমদের তোলা এ ছবিটি বঙ্গবন্ধু সরকারের বারোটা বাজিয়েছিল। অনেক পরে জানা গেল, অই ছবিটি ছিল পঁচাত্তরের থিংকট্যাংকয়ের কারসাজি। কিন্তু ততক্ষণে যা হবার তা হয়ে গেছে! অপকৌশলের পুনরাবৃত্তি হয়। সুনামগঞ্জে চামড়া মাটি চাপ দেবার পেছনে কোনো রকম অপকৌশল থাকা বিচিত্র কিছু নয়। বিষয়টি খতিতে দেখা প্রয়োজন।

এ ব্যাপারে এক ধরনের ইঙ্গিতও দিয়েছেন নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। ১৪ আগস্ট দুপুরে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বলেছেন, ‘কারা চামড়া মাটিতে পুঁতে ফেলছে সেটাও সাংবাদিকদের দেখা দরকার। এরা কারা? আমাদের দেশে তো দেশবিরোধী একটা বিরাট চক্র বিরাজমান।’ কিন্তু নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী এতো বড় একটি দায়িত্ব সাংবাদিকদের দিলেন কেন? এ কাজ করার জন্য তো সরকারের অনেক সংস্থা রয়েছে। যাদেরকে জনগণের কাড়িকাড়ি টাকা খরচ করে পোষা হয়। কোনো কিছু খতিয়ে দেখার দায়িত্ব তো তাদের, সরকারের। কোনো বিবেচনায়ই সাংবাদিকদের নয়। আর তিনি কোন বিবেচনায় বললেন, ‘আমাদের দেশে তো দেশবিরোধী একটা বিরাট চক্র বিরাজমান।’ সকল সরকারেরই একই একটি দোষ, দেশবিরোধী কেবল একটি চক্র দেখে!

বাস্তবে আমাদের দেশে দেশবিরোধী কেবল একটা চক্র নয়, রয়েছে একাধিক চক্র। এদের কেউ পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট রক্তপিপাষু হয়ে হরণ করে জাতির পিতাসহ ২৬ জনের প্রাণ। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা করে ২৪ জনের জীবন কেড়ে নেয়। এক গ্রুপ আছে যারা ইসলামের নামে জঙ্গিবাদকে পৃষ্ঠপোষকতা করে। এদেরই একটি অংশ সারাদেশে একযোগে বোমা ফাটায়। আর এক গ্রুপ আছে যারা প্রিয়া সাহার মাধ্যমে বাংলাদেশে হস্তক্ষেপ করার আহ্বান জানায় মার্কিন প্রেসিডেন্টকে। সেই সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত দিতে পেরেছিলেন বলেই নানান পরিচয়ে ঘাঁপটি মেরে থাকা প্রিয়া সাহাদের ষড়যন্ত্রের কড়াল গ্রাস থেকে রক্ষা পেয়েছে বাংলাদেশ। আপাতত কারণ প্রিয়া সাহা কেবল একজন ব্যক্তি নন। তিনি দেশবিরোধী একাধিক বর্ণচোরা চক্রের একজন প্রতিনিধি। এরকম অনেক আছে।

বিচেনায় রাখা উচিত, এবার চামড়া নিয়ে যে কেলেঙ্কারি ঘটনা ঘটেছে তা কেবল অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার বিষয় নয়। এর সঙ্গে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় আবেগও জড়িত। হয়তো এই আবেগ পুঁজি করার জন্যই সুনামগঞ্জে ঘটা করে চামড়া ‘দাফন’ করা হয়েছে। যেমন ৭৪-এর দুর্ভিক্ষের ভয়াহতা ফুটিয়ে তোলার জন্য বাকপ্রতিবন্ধী বাসন্তীকে জাল পরিয়ে সাজানো ছবি তুলে তা ছাপা হয়েছিল দৈনিক ইত্তেফাকে। বঙ্গবন্ধু সরকারের ওপর যার বিরূপ প্রভাব হয়েছিল ভয়ংকর। এ রকম অনেক ঘটনার ওপর ভিত্তি করেই ১৫ আগস্টের আঘাত হানার প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে। কাজেই কোনো ঘটনাকেই হালকাভাবে নেবার সুযোগ একবারেই কম। তা হোক মার্কিন মুল্লুকে গিয়ে প্রিয়া সাহায় অপ্রিয় উদ্ভট নালিশ অথবা সুনামগঞ্জে চামড়া দাফন! লাশ দাফনের আদলে কোরবানির চামড়া মাটিচাপা দেয়ার বিষয়ে প্রধান প্রশ্ন, পঁচাত্তরের থিংকট্যাংকের কৌশলের পুনরাবৃত্তি হয়নি তো!

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক