কাশ্মীর নিয়ে কী হচ্ছে?

মাসুদ কামাল
 | প্রকাশিত : ১৯ আগস্ট ২০১৯, ১১:২১

ভারত, পাকিস্তান, এমনকি বাংলাদেশেরও অনেকে এখন ভারতের সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদের বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠেছেন। ভারতের সংবিধান যারা কোনো দিন হাতে নিয়ে দেখেননি, তারা পর্যন্ত এখন এই আর্টিক্যাল ৩৭০ সম্পর্কে কিছু না কিছু জানেন। এই অনুচ্ছেদটি সম্পর্কে মানুষ আসলে ঠিক তখনই আগ্রহী হয়ে ওঠলো, যখন এটিকে বাতিল করা হলো। যতদিন এটা বহাল ছিল, তখন এ নিয়ে তেমন বেশি কাউকে আগ্রহী হতে দেখা যায়নি।

আসলে ভারতের সংবিধানের এই ধারাটির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ভারতেরই একটি রাজ্য জম্মু ও কাশ্মীরের ভাগ্য। ভারতের সর্বউত্তরের এই রাজ্যটি কিভাবে চলবে, কিভাবে শাসিত হবে, ভারতের কেন্দ্রীয় প্রশাসনের সঙ্গে এই রাজ্য প্রশাসনের সম্পর্ক কেমন হবেÑ সেসবই বলা ছিল এই ৩৭০ অনুচ্ছেদে। কেবল এই একটি অনুচ্ছেদই নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে ছিল আরও একটি ধারা ৩৫-এ। এই দুটি ধারা জম্মু ও কাশ্মীরকে ভারতের অন্য সকল রাজ্য থেকে অনেকটাই আলাদা মর্যাদা দিয়েছিল। সেই আলাদা মর্যাদার কারণে ভারতের অংশ হওয়া সত্ত্বেও জম্মু ও কাশ্মীরের আলাদা জাতীয় পতাকা ছিল, আলাদা একটি সংবিধান ছিল। এমনকি তাদের যে আইনসভা, তার চরিত্রও ছিল অন্য রাজ্যগুলোর চেয়ে ভিন্ন। অন্য রাজ্য এবং এমনকি কেন্দ্রে আইনসভার মেয়াদ পাঁচ বছর হলেও জম্মু ও কাশ্মীরে আইনসভার মেয়াদ ছিল ছয় বছর।

মাত্র কদিন আগে, আগস্টের প্রথম সপ্তাহে সেই অনুচ্ছেদ ৩৭০ বাতিলের মাধ্যমে জম্মু ও কাশ্মীরের আগের সেই বিশেষ মর্যাদাটি বাতিল করা হয়। এর মাধ্যমে জম্মু ও কাশ্মীরকে যে অন্য সব রাজ্যের সমান মর্যাদায় নামিয়ে আনা নয়, বরং তাদের চেয়েও নিচে নামিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রথমত এটিকে ইউনিয়ন টেরিটরিতে পরিণত করা হয় এবং এটি ভেঙে দুই টুকরা করা হয়। একটি জম্মু ও কাশ্মীর, অপরটি লাদাখ। দুটোই ইউনিয়ন টেরিটরি। এর অর্থ দাঁড়ায়Ñ অন্য রাজ্যগুলোর চেয়েও এদের ক্ষমতা অনেক কমে যাবে। যেমন রাজ্যের পুলিশের ওপরও এই রাজ্য সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। এটিকে বলা যায় কাশ্মীরের জন্য একেবারে ডাবল ডিমোশন!

এখানে একটা প্রশ্ন অবধারিতভাবে এসেই যায়, এতদিন কাশ্মীরকে একটা বিশেষ মর্যাদা দেয়া হতো কেন? কেন ভারতের অংশ হওয়া সত্ত্বেও তাদের একটা আলাদা পতাকা এবং আলাদা সংবিধান ছিল? এ প্রশ্নের উত্তর পেতে তাকাতে হবে সেই ১৯৪৭ সালের দিকে। ইংরেজরা এদেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় ভারতকে ভাগ করে দিয়ে যায়। এই ভাগ হয় দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে, অর্থাৎ হিন্দুদের জন্য একটি রাষ্ট্র এবং মুসলমানদের জন্য আর একটি রাষ্ট্র। সেই সময়ে এখানে বেশ কিছু রাজ্য ছিল রাজা বা মহারাজাদের দ্বারা শাসিত। সেই রাজ্যগুলোর জন্য ভারত কিংবা পাকিস্তানের সঙ্গে একীভূত হওয়ার কোনো বাধ্যবাধকতা ছিল না। এমনকি তারা চাইলে স্বাধীনভাবে থাকতে চাইতে পারতো। এরকম আড়াই শতেরও বেশি রাজ্যের মধ্যে মাত্র তিনটি রাজ্য তখন স্বাধীনভাবে থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করে, যার মধ্যে জম্মু ও কাশ্মীর একটি। অপর দুটি ছিল হায়দ্রাবাদ ও জুনাগড়। নানা চাপে পড়ে জুনাগড় দ্রুতই ভারতের সঙ্গে মিলে যায়। হায়দ্রাবাদ ছিল খুবই সম্পদশালী একটি রাজ্য। এই রাজ্যের বেশিরভাগ মানুষ ছিল হিন্দু ধর্মাবলম্বী, কিন্তু এর রাজা (তখন বলা হতোÑনিজাম) ছিলেন মুসলমান। নিজাম চাচ্ছিলেন পাকিস্তানের সঙ্গে মিলে যেতে। কিন্তু জনগণ চাচ্ছিলো ভারতের সঙ্গে মিলতে। তখন ভারত কিছুটা বলপ্রয়োগের মাধ্যমেই হায়দ্রাবাদকে নিজেদের অংশ করে নেয়। বাকি রইলো জম্মু ও কাশ্মীর। সেখানকার পরিস্থিতি হায়দ্রাবাদের ঠিক উল্টাÑ শাসক হিন্দু কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ মুসলমান। তবে এই হিন্দু রাজা হরি সিং কিন্তু শুরু থেকেই স্বাধীন থাকতে চেয়েছেন, পাকিস্তান কিংবা ভারত কারো সাথেই মিশে যেতে চাননি। কিন্তু ঝামেলটা শুরু করে পাকিস্তান, তারা তাদের বিপুল সংখ্যক মানুষকে এবং সেই সঙ্গে সেনাবাহিনীকে কাশ্মীরে ঢুকিয়ে দিতে থাকে। মহারাজ হরি সিং দেখলেন তিনি না চাইলেও রাজ্যটি ক্রমশ পাকিস্তানের অংশ হয়ে যাচ্ছে। তখন তিনি সাহায্য চান ভারতের। ভারতের সঙ্গে তখন তার একটি চুক্তি হয়। এটা ১৯৪৭-এর ২৬ অক্টোবরের কথা। এই চুক্তিটি ইতিহাসে ‘ইনস্ট্রুমেন্ট অব একসেশন’ নামে পরিচিত।

এ সময়ই জম্মু ও কাশ্মীরের দখল নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে প্রথম যুদ্ধটি হয়। বিষয়টি জাতিসংঘে পর্যন্ত যায়। নিরাপত্তা পরিষদ বলেÑ জম্মু ও কাশ্মীর কারও সঙ্গে মিশে যাবে নাকি নিজেরা স্বাধীন থাকবে সেটা নির্ধারণ করবে সেখানকার জনগণ। একটা গণভোট হবে, তার মাধ্যমেই সেটা নির্ধারিত হবে। তবে তার আগে সেখানে থাকা পাকিস্তানি ও ভারতীয় সেনাবাহিনীকে প্রত্যাহার করতে হবে। কিন্তু এই দুই দেশ তাদের সেনাবাহিনীকে এত বছরে কখনোই প্রত্যাহার করেনি, সেই গণভোটও আর হয়নি। ফলে মূল রাজ্যের ৪৫ শতাংশ এলাকা ভারতের দখলে থেকে যায়, যা এখনো জম্মু ও কাশ্মীর নামে ভারতের অংশ হিসাবে রয়েছে। এখানে রয়েছে জম্মু, কাশ্মীর উপত্যকা, লাদাখ এবং সিয়াচেন গ্লেসিয়ার। আর যে ৩৫ শতাংশ তখন পাকিস্তানের দখলে ছিল সেটা এখন আজাদ কাশ্মীর ও গিলগিট-বালতিস্তান দুটি আলাদা রাজ্য নামে পরিচিত। বাকি ২০ শতাংশের মধ্যে ছিল আকসাই চীন, যা এখন চীনের দখলে। এভাবেই কাশ্মীর হয়ে গেল তিন ভাগ। কাশ্মীরের এই দখল নিয়ে ভারত, পাকিস্তান আর চীন মাঝেমধ্যেই নিজেরা মারামারিতে লিপ্ত হয়। বরফে ঢাকা তাদের এই সীমান্ত প্রায়ই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।

আসলে কাশ্মীরকে নিজেদের কাছে রাখতেই ভারত শুরু থেকে এই রাজ্যটিকে বিশেষ কিছু সুবিধা দিয়ে এসেছে। বিষয়গুলো, ১৯৫০ সালে ভারতের সংবিধান যখন চালু হয়, তখন থেকেই সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করে রাখা হয়েছে। সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে ৩৭০ অনুচ্ছেদের মাধ্যমে। এরপর ১৯৫৪ সালে ভারতের প্রেসিডেন্ট ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ তিনি একটি প্রেসিডেন্সিয়াল আদেশ জারি করেন। আর্টিকেল ৩৫এ এই সময়েই জারি হয়। অনুচ্ছেদ ৩৭০ এবং ৩৫এ ধারার কারণে কাশ্মীরের জনগণ কিছু বিশেষ সুবিধা পেয়ে থেকে। বাইরে থেকে কেউ গিয়ে কাশ্মীরে জমিজমা কিনতে পারে না। কাশ্মীরের মেয়েরা বাইরের কাউকে বিয়ে করলে সম্পত্তির ওপর থেকে তার অধিকার হারায়। ফলে বাইরের কাউকে বিয়ে করতে কাশ্মীরের মেয়েরা উৎসাহ পায় না।

এবার ৩৭০ ধারা বাতিলের পর ভারত সরকার অবশ্য বলছে- এই পরিবর্তন ভারতের সকল রাজ্যের মধ্যে একটা সাম্যভাব নিয়ে আসবে, আর ৩৫এ ধারার জন্য কাশ্মীরে উন্নয়নের ক্ষেত্রে যে সকল প্রতিবন্ধকতা ছিল, তা দূর হয়ে যাবে। আগে অন্য রাজ্য থেকে যে শিক্ষিত এবং যোগ্য পেশাজীবীগণ কাশ্মীরে যেতে অনাগ্রহ দেখাতো, সেটা এখন দূর হবে। কাশ্মীরে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়বে। বড় বড় পুঁজিপতিরা সেখানে যাবে। পর্যটনশিল্প ফুলে ফেঁপে উঠবে। কাশ্মীরের মানুষের কর্মসংস্থান বাড়বে। তত্ত্বগতভাবে হয়তো তা হওয়ারই কথা। কারণ ৩৫এ ধারার কারণে ওইসব বিষয়ে প্রতিবন্ধকতা ছিল, এখন তা আর থাকবে না। বিজেপি সরকারও বলছে সেই কথাগুলো। তাদের যুক্তি হলো- অনুচ্ছেদ ৩৭০ এবং ৩৫এ এর কারণে যে বিশেষ সুবিধাগুলো কাশ্মীর গত সাত দশক ধরে পেয়ে এসেছে, তার মাধ্যমে কি এমন উন্নতি হয়েছে সেখানে? তেমন কিছুই হয়নি। এই যে হয়নি, তার কারণ হলো ওই ধারাগুলোই। তাই সেগুলো অপসারণ করে, জম্মু ও কাশ্মীরকে ভারতের অন্য রাজ্যগুলোর সমপর্যায়ে নিয়ে এলেই কেবল এর উন্নয়ন করা সম্ভব।

বিজেপি সরকারের এতসব যুক্তির সঙ্গে বাস্তবতার সম্পর্ক কতটুকু রয়েছে- তা নিয়ে কিন্তু বিতর্ক রয়েই গেছে। অনেকে এমনও বলছেন, কাশ্মীর তো কেবল একটি নির্জন ভূখ- নয়, সেখানে মানুষ আছে, মানুষের মন আছে, তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা আছে। কাশ্মীরের মানুষকে বাদ দিয়ে তো আর কাশ্মীরের উন্নয়ন করা যাবে না। উন্নয়ন করতে হলে সেই মানুষদের সঙ্গে নিয়েই করতে হবে। সেই একেবারে প্রাথমিক কাজটা করা হয়েছে? হয়নি যে, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হচ্ছেÑ লোকসভায় যেদিন কাশ্মীর সংক্রান্ত এতসব সিদ্ধান্ত নেয়া হলো, সেদিন কাশ্মীরের জনগণ ঘর থেকে বের হতে পারেনি। কেবল তাই নয়, টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে, টেলিভিশন সংবাদপত্র বন্ধ করে, পুরো দুনিয়া থেকেই কাশ্মীরকে আলাদা করে রাখা হয়েছে। ফলে তারা জানতেই পারেনি সেদিন লোকসভায় তাদের ভাগ্য নিয়ে কি বিশাল একটা সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে! এমন পরিস্থিতি নিঃসন্দেহে নজিরবিহীন!

বলা হয়ে থাকে ভারত হচ্ছে বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ, সেই সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষ দেশ। তবে গত পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে ভারতের রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থেকে হিন্দুবাদী বিজেপি সরকার ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ ইমেজকে কতটুকু অটুট রাখতে পেরেছেÑ তা নিয়ে সন্দেহ করাই যায়। এবার বোধকরি গণতান্ত্রিক ও ফেডারেল ইমেজ নিয়েও প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। এই যে অতি গর্বের ফেডারেলিজম, সেটিও বোধকরি এবার যেতে বসেছে।

আর গণতন্ত্রের কথা যদি বলা হয়, তাহলে এ কেমন ধারা এখন দেখতে হচ্ছে! প্রশ্ন উঠতেই পারে- আপনি কাশ্মীরের উন্নতির কথা বলে যে পদক্ষেপ নেবেন, তাতে এর জনগণকে কেন অন্ধকারে রাখবেন? জনগণকে বাদ দিয়ে যে সিদ্ধান্ত, তাকে গণতন্ত্র বলা যায় কিভাবে? বলা হচ্ছেÑ নতুন সিদ্ধান্তে কাশ্মীরের ভালো হবে। তাহলে এমন সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে কাশ্মীরের একজন মানুষকেও সাথে পাওয়া গেল না কেন? সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে গিয়ে পুরো রাজ্যকে বন্দি করে ফেলতে হলো কেন? কাশ্মীরের রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেফতার বা গৃহবন্দি করে রাখা হলো কেন? এর মধ্যে ঈদ এবং স্বাধীনতা দিবসের মতো দুটি গুরুত্বপূর্ণ দিবস এলো এবং গেলো। এই দুটি দিবসের কোনোটিই কি কাশ্মীরে যথাযথভাবে উদযাপিত হতে পেরেছে? আসলে কি হচ্ছে এখন কাশ্মীরে, কি হবে আগামীতে তা নিয়ে আগাম মন্তব্য হয়তো করা যাবে না। কিন্তু এতটুকু তো বলাই যে, সোয়া এক কোটি মানুষের ওপর দিনের পর দিন কারফিউ তো আর চাপিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। যখন এই নিয়ন্ত্রণ উঠে যাবে, মানুষ যখন বাইরে বের হতে পারবে, কথা বলতে পারবে, তখনই হয়তো বোঝা যাবে কি ঘটতে যাচ্ছে কাশ্মীরে। বোঝা যাবে মোদি-শাহ জুটি তাদের রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্তটি সঠিক, নাকি ভুল নিয়েছেন।

সংবাদটি শেয়ার করুন

আন্তর্জাতিক বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

আন্তর্জাতিক এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :