মহাসড়কে তিন চাকার বিপদ

নিষিদ্ধ হলেও চলছে দেদার, ঈদযাত্রায় নিহতদের বেশিরভাগ এই বাহনের যাত্রী

সিরাজুম সালেকীন, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ১৯ আগস্ট ২০১৯, ১৮:৫৪ | প্রকাশিত : ১৯ আগস্ট ২০১৯, ১১:৩৩
গতকাল কুমিল্লায় বাসের সঙ্গে সিএনজি অটোরিকশার মুখোমুখি সংঘর্ষে একই পরিবারের ছয়জনসহ আটজন নিহত হন।

ঈদ শেষে শহরে ফেরার যাত্রা আর শেষ হয়নি কুমিল্লার নাঙ্গলকোট উপজেলার ঘোড়া ময়দান এলাকার একটি পরিবারের। একটি অটোরিকশায় ছয় স্বজন আর তার চালকের জীবনের যাত্রা থামিয়ে দেয় বাসের ধাক্কা। দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া সিএনজিচালিত অটোরিকশার সব যাত্রীই চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে যায় ধাতব বাসের আঘাতে। কারো বাঁচার উপায় ছিল না।

ঈদে স্বজনদের সঙ্গে আনন্দ শেষে কর্মস্থলে ফিরতে গিয়ে সড়কে প্রাণহানি নিয়মিত ঘটনা। প্রতিবারের মতো এবারও দেখা যাচ্ছে, ফিরতি পথে দুর্ঘটনায় যারা মারা যাচ্ছেন তাদের মধ্যে একটি বড় অংশই ধীরগতির তিন চাকার বাহন বা সিএনজিচালিত অটোরিকশার যাত্রী।

ফিরতি পথে প্রতিটি বাহনই যাত্রীতে থাকে পরিপূর্ণ, তিন চাকার ছোট গাড়িগুলোও তার ব্যতিক্রম নয়। আর দ্রুত নগরে ফেরার আশায় বড় গাড়িগুলোর গতি থাকে বেশি। আর ছোট গাড়িতে যাত্রী বেশি থাকায় সেগুলোতে ধাক্কা দিলে প্রাণহানি হয় বেশি।

এবার একাধিক দুর্ঘটনায় পুরো পরিবারের বা এক দুই জন ছাড়া বাকি সবার মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে, যেখানে গোটা পরিবারটি ছিল ছোট গাড়িতে। গতকাল কুমিল্লায়, দুই দিন আগে ময়মনসিংহে ঘটেছে এই ঘটনা।

ঈদে বাড়ি যাওয়া আর নগরে ফেরার পথে গণমাধ্যমে আসা সড়ক দুর্ঘটনার হিসাব করে যাত্রী কল্যাণ সমিতি জানাচ্ছে, যারা প্রাণ হারিয়েছেন, তাদের মধ্যে ২৮ শতাংশেরও বেশি বাহক হয়েছিলেন ধীরগতির এসব ছোট গাড়িতে। যেগুলো আসলে মহাসড়কে চলারই কথা না।

মহাসড়কে ধীর গতির এসব ছোট গাড়ি বন্ধ করা হয়েছে বহুবার। কিন্তু কদিন যেতে না যেতেই আবার গাড়িগুলো যাত্রী নিয়ে উঠে পড়ে মহাসড়কে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাধ্য হয়েই। কারণ, মহাসড়কের পাশে ধীরগতির গাড়ি চলার জন্য আলাদা লেন তৈরি হয়নি বেশিরভাগ এলাকাতে। আর বিকল্প সড়ক না থাকায় ঈদ শেষে ছোট গাড়িকে মহাসড়কে উঠতে বাধাও দিতে পারছে না পুলিশ।

যাত্রী কল্যাণ সমিতি গতকাল যে হিসাব দিয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে এবার ঈদযাত্রা ও ফিরতি পথে সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ইজিবাইক, নছিমনের ৪৮ জন যাত্রী নিহত হয়েছে বড় গাড়ির ধাক্কায়। কুমিল্লায় নিহত আটজন ধরলে এই সংখ্যাটি দাঁড়ায় ৫৭। শতকরা হিসাবে যত মানুষ প্রাণ হারিয়েছে তার ৩০ শতাংশের বেশি এসব গাড়ির যাত্রী।

ছোট গাড়িতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকে কম। সহজে ব্রেক করা যায় না, সংকেত বাতি থাকে না বেশির ভাগ ক্ষেত্রে। আর দূর থেকে দেখাও যায় না সেভাবে। এগুলোর চালকরাও সেভাবে দক্ষ নন, লাইসেন্স থাকে কমই। আর নিয়ম-কানুন না মেনে হুটহাট করে প্রধান সড়কে উঠে যেতে চান চালকরা।

সড়ক পরিবহন নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিআরটিএ এবং পুলিশ বলছে, মহাসড়কে এসব যানের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হচ্ছে নিয়মিত। কিন্তু বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না। আর ঈদের পর যখন শহরের পথে যাত্রী সংখ্যা থাকে অগুণতি, তখন সেভাবে বাধাও দেওয়া যায় না। কারণ, যাত্রীদেরকে কোনো না কোনোভাবে গন্তব্যে আসতেই হবে। গাড়ি আটকে দিলে ভোগান্তি বাড়বে।

যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাবে গতকালের আগ পর্যন্ত এবার ঈদ যাত্রা ও ফিরতে পথে ২০৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২২৪ জন নিহত ও ৮৬৬ জন আহত হয়েছে। নিহতদের মধ্যে ১৩.৫২ শতাংশ অটোরিকশা, পাঁচ শতাংশ করে ইজিবাইক ও ব্যাটারি চালিত রিকশার এবং নসিমন ও ভটভটির যাত্রী ছিলেন ৩.৫৫ শতাংশ। গতকাল কুমিল্লার দুর্ঘটনা হিসাব করলে অটোরিকশায় নিহতের সংখ্যা ও অনুপাত অনেক বাড়বে।

২০১৫ সালের ১ আগস্ট মহাসড়কে তিন চাকার অটোরিক্সা, অটোটেম্পু ও সব ধরনের অযান্ত্রিক যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ করে আদেশ জারি করে সরকার। এরপর কয়েক দিন অভিযানও হয় ঘটা করে। কিন্তু পুলিশ বা নিয়ন্ত্রক সংস্থার এই সক্রিয়তা সব সময় দেখা যায়নি। আবার বা হাতের কাজ বা ঘুষের অভিযোগও আছে। টাকা নিয়ে মহাসড়কে অবৈধ যানবাহন চলতে দেওয়ার অভিযোগ নতুন নয়।

তবে পুলিশ বলছে, এসব গাড়ির চালকরা নানা সময় গাড়িতে গ্যাস নেয়ার কথা বলে মহাসড়কে উঠে। আর প্রতিনিয়ত অভিযান চালিয়ে আটক করা হচ্ছে এসব যানবাহন।

হাইওয়ে পুলিশের প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মাহবুবুর রহমান ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘আমরা কয়েক হাজার অবৈধ যান আটক করেছি। অভিযান চলছে, তবে মহাসড়কে তা পুরোপুরি বন্ধ করতে সময় লাগবে। সম্পূর্ণ বন্ধ হয়েছে এমন দাবি আমরা করব না। কারণ কোন অপারেশন শুরু হলে সেটা বন্ধ করতে সময় লাগে। তবে এরই মধ্যে অনেক কমে গেছে, আরও কমে যাবে।’

সড়ক পরিবহন নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিআরটিএ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মাজহারুল ইসলাম ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘এসব অবৈধ যান খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। ঈদের আগেও আমি নিজে ঢাকা-চিটাগাং মহাসড়কে অভিযান চালিয়ে সিএনজি, ব্যাটারিচালিত প্রায় ৭৭টি যানবাহন জব্দ করে ডাম্পিংয়ে দিয়েছি। এ ছাড়া অধিকাংশ সময় ব্যাটারি খুলে নিয়ে আসি। আমরা যখন অভিযানে থাকি তখন মহাসড়কে এসব যান চলাচল বন্ধ থাকে। চলে এলেই তারা আবার চলাচল করে। আমরা কাজ করছি, পারছিও না পুরোপুরি বন্ধ করতে।’

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট- এআরআই এর সহকারী অধ্যাপক কাজী সাইফুন নেওয়াজ ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘মহাসড়কে ছোট গাড়িগুলোর চাহিদা রয়েছে। স্বল্প রুটে যারা যায় তাদের জন্য কোন ব্যবস্থা না থাকার কারণে এসব গাড়ি রাস্তায় আসছে। যতই আমরা বন্ধ করতে যায় এটা চাহিদা থাকার কারণে চুরি করে হলেও চলাচল করছে।’

এসব যানবাহন বন্ধে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি আলাদা পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন এই গবেষক। বলেন, ‘মালিক সমিতির সঙ্গে কথা বলে বিভিন্ন রুটে সার্ভে করতে হবে। দেখতে হবে স্বল্প রুটে কী পরিমান যাত্রী যাতয়াত করতে চাই। সেই রুটে ছোট ছোট কোস্টার টাইপের বাস চালানো যেতে পারে। সেটা বিআরটিসি বা অন্য বেসরকারি কোম্পানির হতে পারে। যাত্রী পরিবহনের পাশাপাশি পণ্য পরিবহনেরও সুযোগ রাখতে হবে।’

‘দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মধ্যে মহাসড়কের পাশাপাশি আলাদা লেন করা যেতে পারে। যাতে ছোট ছোট গাড়িগুলো যাতায়াত করতে পারে।’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও নানা সময় ছোট গাড়ির জন্য আলাদা লেন করার নির্দেশনা দিয়েছেন। ঢাকা-চট্টগ্রাম এবং ঢাকা ময়মনসিংহ মহাসড়ক চার লেন করার সময় এই লেন করা হয়েছে দুই ধারেই। ফলে সেখানে দুর্ঘটনার সংখ্যা এবং মৃত্যু কমেছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে। ঢাকা-টাঙ্গাইল চার লেনের কাজেও ধীরগতির ও ছোট গাড়ির জন্য আলাদা ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

ঢাকাটাইমস/১৯আগস্ট/ডব্লিউবি

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিশেষ প্রতিবেদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :