বস্তিতে অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ বাড়াচ্ছে ঝুঁকি

কাজী রফিক, ঢাকাটাইমস
 | প্রকাশিত : ২০ আগস্ট ২০১৯, ১২:৩৪
রূপনগরের ঝিলপাড় বস্তিতে আগুনে পুড়ে যাওয়া হাজারো ঘর

রাজধানীর রূপনগরের চলন্তিকার মোড়ের ঝিলপাড় বস্তিতে আড়াই হাজারের বেশি ঘর পুড়ে যাওয়ার পেছনের কারণ হিসেবে বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিটকে প্রাথমিকভাবে দায়ী করা হচ্ছে। এর আগেও একাধিক বস্তিতে আগুনের ঘটনায় এই বিষয়টি সামনে এসেছে।

বারবার বিদ্যুতের শর্টসার্কিট থেকে আগুন কেন লাগছে- এই প্রশ্নের সরাসরি জবাব পাওয়া কঠিন। তবে এমন একটি তথ্য মিলেছে যা এই প্রশ্নের জবাবের কাছাকাছি যেতে সাহায্য করবে।

একাধিক বস্তি ঘুরে জানা গেছে, সেখানে বিদ্যুতের লাইনগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অবৈধ। আর এই ধরনের লাইনগুলো বরাবরই বিপজ্জনক। কারণ, সেখানে নিরাপত্তার যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হয় না। আর তার বা অন্যান্য উপকরণের যথাযথ মান নিশ্চিত করা হয়েছে কি না, সেটাও যাচাইয়ের কোনো নিয়ন্ত্রক থাকে না। চোরাই লাইনগুলো নিতে হয় লুকিয়ে।

বস্তিতে আগুনের ঘটনা নতুন নয়। সিংহভাগ ক্ষেত্রেই তদন্তে জানা যায়, বিদ্যুতের ত্রুটিপূর্ণ লাইন বহুলাংশে আগুনের জন্য দায়ী। কিন্তু এই সংযোগগুলো অপেক্ষাকৃত নিরাপদ করতে নেয়া হয়নি কোনো উদ্যোগ।

সরকার আনুষ্ঠানিক সংযোগ না দিলেও হাজার হাজার বাড়িতে সংযোগ যায়নি- এমন নয়। তবে এই বিদ্যুৎ ব্যবহারের বিপরীতে টাকা পায় না সরকার। যদিও বস্তিবাসীকে ঠিকই পরিশোধ করতে হয় অর্থ। আর সেই টাকার ভাগ যায় ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতা-কর্মী এবং বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মীদের পকেটে।

বস্তিতে বিদ্যুত সংযোগ অবৈধ থাকবে কেন- এই প্রশ্ন তুলেছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের প্রধান সারোয়ার জাহান। বলেছেন, বৈধ সংযোগ দেওয়া সরকারের দায়িত্ব।

এই বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘বস্তিকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। একটা আনুষ্ঠানিক ব্যবস্থা করা দরকার। এদেরও তো থাকতে হবে। মানবিক দিক থেকেও তাদেরকে দেখতে হবে। এটা সরকারের দায়িত্ব। কিন্তু যারা চেয়ারে বসেন, মনে হচ্ছে যেন তারা বস্তিবাসীর কথা ভুলে যান।’

সুনির্দিষ্ট সংখ্যা জানা না গেলেও ধারণা করা হয় অন্তত ৩০ লাখ মানুষের বসবাস বস্তিতে। আপাত দৃষ্টিতে গুরুত্ব না দিলেও এই মানুষরা নগর পরিচ্ছন্ন বা কায়িক পরিশ্রমের কাজ করে নগরকে বসবাস উপযোগী রাখেন। কিন্তু তাদের শ্রমের যথাযথ মূল্য পান কি না, এ নিয়ে আছে প্রশ্ন। আবার বস্তিতে বর্গফুট হিসেবে যে হারে ভাড়া দিয়ে থাকেন, তা বহুতল ভবনের ভাড়ার চেয়ে বেশি বলে নানা সময় হিসেব কষে দেখিয়েছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা।

তারপরেও এই লাখ লাখ মানুষকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিদ্যুৎ সংযোগ না দেয়ার কী কারণ, সে বিষয়ে বিতরণ সংস্থার কোনো বক্তব্যই মেলেনি। একাধিক কর্মকর্তাকে ফোন করা হলে কেউ কথা বলেননি।

সাধারণ বাড়িগুলোর তুলনায় বস্তিতে আগুনের ঝুঁকি এমনিতেই বেশি। কারণ, সেখানে যেসব উপকরণ ব্যবহার করা হয় সেগুলো সহজেই দাহ্য। আগুন লাগলে তা নিয়ন্ত্রণে আনা কঠিন হয়ে পড়ে। এ কারণেই দেখা গেছে, বস্তিতে আগুন লাগলে আগুন ছড়িয়ে পড়ে দ্রুত। আর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করেই তবে নিভে তা। আর এসব দুর্ঘটনা প্রায় নিঃস্ব মানুষকেরকে আবার নতুন করে করে নিঃস্ব।

রূপনগরের পুড়ে যাওয়া বস্তির ঘরে ঘরে ছিল বিদ্যুতের সংযোগ। কিন্তু ওই এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া ডেসকোর একজন কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন, তারা সেখানে বিদ্যুতের সংযোগ দেননি। তাহলে বাঁশ, কাঠ আর টিনের ঘরের ফাঁকা জায়গা দিয়ে বস্তিতে কীভাবে সংযোগ গেল, সে প্রশ্নে বস্তির নিয়ন্ত্রকদের জিজ্ঞেস করতে বলেন তিনি।

স্থানীয়রা জানান, প্রায় পাঁচ বছর আগেও বিদ্যুতের সর্ট সার্কিট থেকে সেখানে আগুন লেগেছিল। সে সময়ও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল।

ডেসকোর রূপনগর শাখার ডিউটি অফিসার রানা আহমেদ ঢাকা টাইমসকে জানান, ‘বস্তিতে থাকা বৈদ্যুতিক সংযোগগুলো অবৈধ। বিভিন্ন সময়ে আমরা অবৈধ সংযোগগুলো বিচ্ছিন্ন করেছি। কিন্তু বারবারই তারা বৈদ্যুতিক খুঁটি থেকে অবৈধভাবে সংযোগ নিচ্ছে।’

অবৈধ সংযোগ কেবল পুড়ে যাওয়া তিনটি বস্তির নয়। পাশে বেঁচে যাওয়া রজ্জবের বস্তিতেও গেছে এসব লাইন। রাজধানীর মোহাম্মদপুরেও দেখা গেছে এই চিত্র।

মোহাম্মদপুরে বিদ্যুৎ বিতরণকারী সংস্থা ডিপিডিসির মোহাম্মদপুর ইউনিটের ডিউটি অফিসার ইমরান হোসেন দাবি করেন, অবৈধ সংযোগ বন্ধে তারা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করেন। বলেন, ‘আমরা যখন খবর পাই কোথায় অবৈধ লাইন আছে, তখন আমরা অভিযান করি। রাতের বেলা গিয়ে আমরা সেখান থেকে তার কেটে নিয়ে আসি।’

এলাকার বাঁশবাড়ি বস্তি এবং কাটাসুর পুলপার বস্তিতে তাদের অবৈধ সংযোগ নেই বলে দাবি করেছেন এই কর্মকর্তা। তবে বাস্তবতা ভিন্ন।

ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, বস্তির উত্তর ও পূর্ব পাশে বেশ কিছু দোকান রয়েছে। এসব দোকানে বৈধ সংযোগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বস্তির ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ে ভিন্ন চিত্র। পুরো বস্তির কোনো ঘরই বিদ্যুৎ সংযোগের বাইরে নয়। কিন্তু ভেতরের অংশে বিদ্যুতের কোনো বৈধ কোনো মিটারই খুঁজে পাওয়া যায়নি।

২০১৭ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি বাঁশবাড়ি বস্তিতে আগুনে চার শতাধিক ঘর পুড়ে যায়। তখনও আগুন লাগার কারণ হিসেবে বৈদ্যুতিক সট সার্কিটকে দায়ী করা হয়। এরপর আবার সেখানে গড়ে উঠেছে বস্তি। কিন্তু সেখানে নিরাপদ বিদ্যুতের লাইন দেওয়ার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

ডিপিডিসি জানায়, বেড়িবাঁধ তিন রাস্তার মোড়ের চাঁদ উদ্যান এলাকা, বছিলা রাস্তার পার্শ, রায়ের বাজার শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধের বিপরীতের বস্তির বেশ কিছু অবৈধ সংযোগ তারা সম্প্রতি ছিন্ন করেছে। তবে এসব বস্তিতে গেলেও চোখে পড়ে বিদ্যুৎ ব্যবহারের চিত্র।

চাঁদ উদ্যান এলাকার বছিলা অংশে দেখা মিলিছে একাধিক বস্তি। সেখানেও রয়েছে বিদ্যুৎ সেবা। নেই কেবল বৈধ মিটার। স্থানীয়রা জানান, বৈদ্যুতিক খুঁটি থেকে তারের মাধ্যমে সরাসরি সংযোগ নিয়ে তা ব্যবহার করছেন স্থানীয়রা। তবে সে তার নিরাপদ কি না, সে বিষয়ে ধারণা নেই কারো।

বৈদ্যুতিক খুঁটিগুলোতেও সে চিত্র দেখা যাচ্ছে। পুরো খুঁটি জুড়ে একাধিক ব্যক্তিগত তার। যা চলে গেছে স্থানীয় টং দোকানগুলোতে।

মাস তিনেক আগে এখানে একটি গ্যাস সিলিন্ডারের দোকানে আগুন লাগে। সিলিন্ডারগুলো বিষ্ফোরিত হওয়ার আগেই আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে পারায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়নি।

একই চিত্র রায়েরবাজার শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধের বিপরীতের বস্তিতে। বৈদ্যুতিক খুঁটি থেকে একটি তারের মাধ্যমে নেয়া হয়েছে সংযোগ। আর তা বস্তিতে ঢুকে ভাগ হয়েছে একাধিক সংযোগে।

মোহাম্মদপুর জাফরাবাদ এলাকার পুলপার বস্তিতে ২০১৫ সালের ১২ জানুয়ারির আগুনে ঘরসহ সম্পদ হারায় প্রায় পাঁচ শতাধিক পরিবার। সেই আগুনের কারণ বিদ্যুতের সর্ট সার্কিট। আর চার বছর পরেও সেখানে অবৈধ সংযোগের অভাব নেই। কেবল বস্তির সামনের অংশে গড়ে ওঠা দোকানে নেয়া হয়েছে বৈধ সংযোগ।

অবৈধ বৈদ্যুতিক সংযোগের চিত্র দেখা গেছে, তেজগাঁও রেললাইন বস্তি, আদাবর ১০ নম্বর, গাবতলী থেকে সদরঘাট পর্যন্ত বেড়িবাঁধের দুই পাশে।

বেড়িবাঁধ এলাকার জায়গাটি পানি উন্নয়ন বোর্ডের হলেও সেখানে সুদীর্ঘকাল থেকে বসবাস করে আসছে কয়েক হাজার পরিবার। কেউ কেউ গড়ে তুলেছেন দোকানপাট। আর এসব দোকানের প্রতিটিতেই বিদ্যুৎ সংযোগ রয়েছে। কিন্তু সেগুলো বৈধ নয় বলেই জানা যাচ্ছে।

বেড়িবাঁধের দ্বীপ নগর, সুইজগেট, সুনীবিড় হাউজিং, লোহারগেট, বুড়িগঙ্গা ফিলিং স্টেশন এলাকা, মিনাবাজারের বিপরীতের অংশ সহ পুরো বেড়িবাঁধের দুই পাশে বৈদ্যুতিক খুঁটিতে দেখা গেছে তারের ছড়াছড়ি। এই তারগুলো সরাসরি চলে গেছে বস্তি ঘর এবং দোকানে। কিন্তু এরমধ্যে অধিকাংশ দোকান এবং ঘরে বৈদ্যুতিক মিটারের দেখা মেলেনি।

ঢাকাটাইমস/২০আগস্ট/কারই/ডব্লিউবি/এমআর

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিশেষ প্রতিবেদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :