ডেঙ্গুর প্রজনন

কতটুকু সচেতন আমরা?

প্রকাশ | ২০ আগস্ট ২০১৯, ১৭:২১

সারওয়ার-উল-ইসলাম

ডেঙ্গু নিয়ে সারা দেশের মানুষ চিন্তিত। ঘরের কর্তাব্যক্তি থেকে শুরু করে পাড়া-মহল্লায় জনপ্রতিনিধিদের ঘুম হারাম হওয়ার মতো অবস্থা। বাসাবাড়িতে যেখানে পানি জমে থাকার সম্ভাবনা থাকে সে সব জায়গায় যাতে পানি না জমে সে ব্যাপারে বর্তমানে সবাই সচেতন। ফার্মেসি থেকে নানা ধরনের ক্রিম কেনার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন মানুষ। যে সব ক্রিম শরীরে মেখে রাখলে ডেঙ্গু মশা কামড় দিতে পারবে না, সে সব ক্রিম অনেকে দ্বিগুণ-তিনগুণ দাম দিয়েও কিনেছেন। আর এই সুযোগে মুনাফাখোররা কামিয়ে নিয়েছেন অনেক টাকা।

সরকারসহ প্রশাসন বেশ তৎপর, যাতে আর একজনও ডেঙ্গু আক্রান্ত না হন। আর যারা ইতিমধ্যে আক্রান্ত হয়েছেন তারা যেন সঠিক চিকিৎসা পান সে ব্যাপারেও সার্বক্ষণিক খোঁজখবর নেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন বড় বড় কর্তাব্যক্তিরা। স্বাস্থ্যমন্ত্রী তার পারিবারিক সফর সংক্ষিপ্ত করে বিদেশ থেকে চলে এসেছেন দেশে। চিকিৎসকদের ছুটিছাটা বাতিল করে ডেঙ্গু প্রতিরোধে নানা রকমের ওষুধ শহর থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পর্যন্ত যেন সহজেই পাওয়া যায় সেই উদ্যোগ নিয়েছেন।

ঢাকার দুই নগর পিতা তাদের ব্যর্থতার বিষয়ে মিডিয়াসহ সাধারণ মানুষের যে অভিযোগ তা ঢেকে ফেলার জন্য যারপরনাই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাদের কুশপুত্তলিকাও দাহ করেছে বিক্ষুব্ধ মানুষ। যাদের ঘরের সদস্যরা আক্রান্ত হয়েছে ডেঙ্গু রোগে, তাদের এই ক্ষোভ প্রকাশ স্বাভাবিক হিসেবেই ধরে নিয়েছেন হয়তো দুই নগর পিতা। কারণ যারা ডেঙ্গু রোগী নিয়ে এই হাসপাতাল, সেই হাসপাতাল ঘুরেছেন তাদের মনের অবস্থা বোঝার মতো আবেগ-অনুভূতি নিশ্চয়ই রয়েছে দুই নগর পিতার।

ডেঙ্গু মশা এখন একটি আতঙ্কের নাম। কারণ এ পর্যন্ত প্রায় একশ মানুষ মারা গেছেন আক্রান্ত হয়ে। যদিও সরকারি হিসেবে এ সংখ্যা অর্ধেকেরও কম। 

ডেঙ্গু আতঙ্কে এখন অনেকেই সাধারণ জ্বর নিয়েও হাসপাতালে ছুটছেন। যার খেসারত দিচ্ছে অন্য ডেঙ্গু আক্রান্তরা। আতঙ্কিত হয়ে হাসপাতালে ছুটে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। প্রিয়জন যখন অসুস্থ হন আর সেটি যদি জ্বর হয়, তাও এই মহামারি ডেঙ্গুর সময়কালে, তা হলে তো কথাই নেই।

ডেঙ্গুর এই দুর্যোগের সময় অনেক হাসপাতালসহ ডায়াগনোস্টিক সেন্টার ডেঙ্গুর পরীক্ষার চার্জ দ্বিগুণ-তিনগুণ করে অসহায় মানুষের পকেট কেটে নিচ্ছে এমন অভিযোগ আমাদের হতবিহ্বল করে। পাশাপাশি দু-একটি হাসপাতাল আর সেবাদান প্রতিষ্ঠান তাদের মানবিক দিকটি উন্মোচন করেছে এই ক্রান্তিকালে। বিনা পয়সায় ডেঙ্গু রোগ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। আমাদের সমাজে সুযোগ সন্ধানী মানুষ যেমন আছে, তেমনি বিপদের সময় পাশে দাঁড়িয়ে সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানও আছে। যা মিডিয়ার মাধ্যমে জানা যাচ্ছে।

সরকার কেন এই ডেঙ্গু মোকাবেলায় আগাম প্রস্তুতি নিয়ে রাখলো না? কেন ডেঙ্গু পরীক্ষার পর্যাপ্ত কীট মজুদ করে রাখা যায়নি? এ রকম নানা অভিযোগ আছে সরকারের বিরুদ্ধে বা সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে। এটি যুক্তিসংগত অভিযোগ।

যেহেতু কয়েক বছর ধরে ডেঙ্গু আর চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে দেশের মানুষ, সরকারের উচিত ছিল ডেঙ্গু যাতে ভয়াবহ আকার ধারণ না করে সে জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে ওষুধ সংগ্রহ করে রাখা। আবার এমন অভিযোগের খবরও মিডিয়ায় এসেছে- কোথাও ওষুধ পর্যাপ্ত থাকলেও সেগুলোর কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সব কিছু মিলিয়ে সরকারের দুর্বলতার খবরই আমরা বেশি করে জানতে পেরেছি। আর সেই দুর্বলতার বিষয়টি কিছুটা অনুধাবন করতে পেরেই হয়তো তৎপর হয়েছে সরকার। 

হাসপাতালে হাসপাতালে ছুটছেন বর্তমান এবং সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রীরা। যাতে সরকারের ব্যাপারে সাধারণ মানুষ নিজেদের ক্ষোভ কিছুটা হলেও প্রশমন করতে পারে।

এই তো পর্দার সামনের চিত্রটা। পর্দার পেছনের দিকটায় একটু দেখা যাকÑ আমরা যারা সাধারণ মানুষ, যারা মনে করি ডেঙ্গুর জন্য সিটি করপোরেশন বা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়নি বলেই ডেঙ্গুর প্রকোপ মহামারির দিকে মোড় নিয়েছে বা নিচ্ছে। কিন্তু আমি কি আমাকে একবারও প্রশ্ন করেছি? ডেঙ্গু মশার বসবাসের সুন্দর পরিবেশ তৈরিতে আমি কিছুটা হলেও ভূমিকা রাখিনি? আমরা বাড়ির নিত্যদিনের ময়লা আবর্জনা পলিথিনে ভরে ব্যাগটি ডাস্টবিনে না ফেলে স্যুয়ারেজের ড্রেনে ছুঁড়ে মারিনি? আমাদের প্রত্যেকের একটি একটি করে পলিথিনের ব্যাগ জমে ময়লা পানি যাওয়ার ড্রেনটি ভরাট হয়ে গেছে কোথাও সেটি খেয়াল করিনি। তাই প্রতিদিনের গৃহস্থালির পানি উপচে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। আর সেখানেই ডেঙ্গু মশা উপযুক্ত স্থান পেয়েছে ডিম পাড়ার। জন্ম নিয়েছে শত শত ডেঙ্গু। হয়তো সে মশা আমাকে কামড়ায়নি। কামড়িয়েছে আমারই কোনো প্রতিবেশীকে।

বহুতল ভবনে বাস করেন অনেকেই। পাশেই হয়তো রয়েছে আরেকটি বহুতল ভবন। দুই ভবনের মাঝখানে হাতখানেক খালি জায়গা রয়েছে। সেই খালি জায়গায় জানালা দিয়ে কলার খোসা, চিপসের খালি প্যাকেট, আমের আঁটি কিংবা পানীয়র খালি বোতল ছুঁড়ে ফেলিনি? দিনের পর দিন সেই ছুঁড়ে ফেলা জিনিস জমে ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। আর সেখানে বৃষ্টির পানি জমে নর্দমার সৃষ্টি হয়েছে। পাড়ায় বাসাবাড়ির ময়লা-আবর্জনা নেওয়ার কাজে নিয়োজিতরা ওই দুই ভবনের মাঝখানে যাওয়ার সুযোগ পায় না। তাই ওইখানে ডেঙ্গু মশা ডিম পাড়ার সুযোগ পায়।

বাসাবাড়িতে একটু খালি জায়গা পেলেই ফুলের গাছ লাগাই। আস্তে আস্তে তৈরি হয় বাগান। খুবই ভালো উদ্যোগ। টবে নিয়মিত পানি দিয়ে যতœ নেই গাছগুলোর। কিন্তু পানি জমতে জমতে কখন যে স্যাঁতসেঁতে নোংরা হয়ে গেছে টবের পাশের জায়গাটি খেয়াল রাখি না। সেখানে ডেঙ্গু মশা সুখে বসবাস করার সুযোগ পায়। 

বাসায় এয়ারকুলার আছে অনেকেরই। সেই এয়ারকুলার থেকে পানি চুয়ে চুয়ে যে পাত্রে জমা হয়, সেটিতে আমাদের খেয়াল না থাকায় মশারা ডিম পাড়ার সুযোগ পায়।

গাড়ির পুরোনো টায়ার ফেলে রেখেছি দিনের পর দিন গ্যারেজের পাশেই। খেয়াল করিনি পানি জমে গেছে টায়ারের ভেতরে। সেই পানিতে ডেঙ্গু ডিম পাড়তে ভুল করেনি। 

এসব প্রশ্নের পর স্বভাবতই কারো কারো মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে পরোক্ষভাবে সরকারের পক্ষাবলম্বন করছি?

আমরা নিজেদের সচেতন নাগরিক হিসেবে তৈরি করতে পারলেই সরকারের যেকোনো ভুলত্রুটি দেখিয়ে দিতে সাহস পাব। আগে আমরা নিজেদের জায়গাটা ঠিক রাখি। নিজ নিজ জায়গা থেকে নিজের জন্য, প্রতিবেশীর জন্য, সমাজের জন্য, সর্বোপরি দেশের জন্য যতটুকু দায়িত্ব-কর্তব্য আছে সেটুকুই যথাযথভাবে পালন করলেই আর দুর্যোগ বা মহামারি আমাদের আক্রান্ত করতে পারবে না।

তবে সেই পরিবেশ তৈরিতে সরকারের ভূমিকা বিশাল। কারণ আমরা সুন্দর পরিচ্ছন্ন থাকব, সরকার তাদের সংশ্লিষ্ট মহলকে নজরদারিতে রাখবে না, সেখানে চুরি হচ্ছে কি না, দেখভাল করবে না, তা হলে ডেঙ্গুর মতো আতঙ্ক আমাদের প্রতি বছর গ্রাস করবেই।

সিটি করপোরেশনের লোকজন নিয়মিত মশার ওষুধ ছিটাচ্ছে কি না তা স্থানীয় জনপ্রতিনিধির দেখার দায়িত্ব। যদি ওষুধ ছিটাতে কোনো প্রকার টালবাহানা করে তা হলে সিটি মেয়রকে সরাসরি অভিযোগ করার দায়িত্ব তার ওপরই বর্তায়।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সময় মতো আগাম প্রস্তুতি নিয়ে রাখলেই ডেঙ্গু মোকাবেলায় হিমশিম খেতে হবে না। সরকার সরকারের জায়গায় কাজ করে যাবে, আমরা যারা নিয়মিত কর পরিশোধ করি পৌরসভাকে, সেই পৌর কর্তৃপক্ষের উচিত পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থায় নিয়োজিতদের দেখভাল করা।

প্রয়োজন শুধু সদিচ্ছা। সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল আর নাগরিক হিসেবে আমরা যতদিন সচেতন না হব ততদিন ডেঙ্গুর মতো দুর্যোগ আমাদের আতঙ্কিত করেই রাখবে।

লেখক: ছড়াকার ও সাংবাদিক