শেয়ারবাজারে কারসাজি

বিএসইসি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নেমেছে দুদক

প্রকাশ | ২১ আগস্ট ২০১৯, ১৮:২৫ | আপডেট: ২১ আগস্ট ২০১৯, ২১:০৩

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাটাইমস

দুর্বল কোম্পানির প্রাথমিক পাবলিক অফার-আইপিও অনুমোদন দিয়ে শেয়ারবাজারে বিক্রি করে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে দেশের শেয়ারবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের চেয়ারম্যান ড. এম খায়রুল হোসেনের বিরুদ্ধে। আর এই অভিযোগের অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

বুধবার দুদকের সহকারী পরিচালক মামুনুর রশীদ চৌধুরী এ বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছেন। এছাড়া অর্থ আত্মসাতের পাশাপাশি তার বিরুদ্ধে বিদেশে অর্থপাচারের অভিযোগও খতিয়ে দেখছে দুদকের মানি লন্ডারিং শাখা।

দুদক সূত্র জানিয়েছে, বিএসইসি চেয়ারম্যান ড. এম খায়রুল হোসেনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন গোষ্ঠীর যোগসাজসে দুর্বল কোম্পানির শেয়ার আইপিও অনুমোদনের মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ করে অর্থ পাচারের অভিযোগ রয়েছে। সেই অভিযোগ তদন্ত করে দ্রুত সময়ে কমিশনের কাছে প্রতিবেদন দাখিল করার নির্দেশনা দিয়েছে দুদক।

সূত্র জানিয়েছে, ২০১০ সালে দেশের শেয়ারবাজারে বড় ধরনের ধস নামে। বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণে তদন্ত কমিটি গঠন করে সরকার। কমিটির সুপারিশের আলোকে বিএসইসির পুনগর্ঠনও করে সরকার। পরবর্তিতে পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতা, বিভিন্ন অনিয়ম ও আইনী দূর্বলতা দূর করার চ্যালেঞ্জ নিয়ে ড. খায়রুল হোসেনের নেতৃত্বে নতুন কমিশন দায়িত্ব নেন। তবে টানা আট বছরেরও বেশি সময় দায়িত্ব পালন করলেও আইপিও ও প্লেসমেন্ট নিয়ে বিতর্ক এড়াতে পারেনি বিএসইসি।

নিম্নমানের কোম্পানির তালিকাভুক্তি, অযৌক্তিক প্রিমিয়াম ও লাগামহীন প্লেসমেন্ট বানিজ্যের অনুমতির মাধ্যমে কিছু কোম্পানিকে পুঁজিবাজারকে টাকা বানানোর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ করে দিয়েছেন এসইসির চেয়ারম্যান ড. খায়রুল হোসেন। অচেনা, স্বল্প পরিচিত বিভিন্ন কোম্পানি আইপিও প্রসপেক্টাসে তথ্য অতিরঞ্জিত ও জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে আয় ফুলিয়ে ফাপিয়ে দেখালেও কয়েক বছরের মধ্যেই কোম্পানির আসল চিত্র বেরিয়ে এসেছে। আইপিওর অনুমোদন পাওয়ার দুই থেকে তিন বছরের মধ্যেই অধিকাংশ কোম্পানির শেয়ার প্রতি আয়ে (ইপিএস) মারাত্মক অবনতি দেখা দিয়েছে।

সর্বশেষ পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি কপারটেক লিমিটেডকে তালিকাভুক্তি করতে ঘাম ঝরাতে হয়। দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ ওই কোম্পানির তালিকাভুক্তির ব্যাপারে আপত্তি থাকলেও বিএসইসি চাপ প্রয়োগ করে তালিকাভুক্ত করে।

আইপিও পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১১ সালের ১৫ মে থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত বর্তমান কমিশনের অনুমোদন নিয়ে মোট ৮৫টি কোম্পানি স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত হয়েছে। তবে আইপিওর পারফরমেন্স পর্যালোচনার জন্য ২০১১ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত তালিকাভুক্ত কোম্পানিকে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। এ সময়ে বিএসইসির বর্তমান চেয়ারম্যানের অধিনস্ত কমিশনের অনুমোদন নিয়ে মোট ৭১টি কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয়েছে। এরমধ্যে ৩৮টি বা ৫৩ শতাংশ কোম্পানিই ছিল নিম্নমানের। কোম্পানির মান বিশ্লেষনে ইপিএস ও সংশ্লিস্ট শেয়ারে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহের বিষয়টিতে প্রধান্য দেওয়া হয়েছে। বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ মূলত শেয়ারের বাজার মূল্য দিয়ে যাচাই করা হয়েছে। এসব কোম্পানির শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) তালিকাভুক্তির সময়ের তুলনায় বর্তমানে অনেক কমে গেছে। উৎপাদন বন্ধ ও লোকসানের কারণে ইতিমধ্যেই ১০টি কোম্পানি ‘জেড ক্যাটাগরি’তে নেমেছে।

আইপিওর মাধ্যমে বর্তমান কমিশন প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা পুঁজিবাজার থেকে উত্তোলনের অনুমতি দিয়েছে কোম্পানিগুলোকে। এর বাইরে রাইট ও রিপিট পাবলিক অফারের মাধ্যমে আরো হাজার হাজার কোটি টাকা উত্তোলনের সুযোগ দিয়েছে কমিশন। প্রিমিয়াম পেতে যেসব কোম্পানি আয় বাড়িয়ে দেখিয়েছিল, সেগুলোর বড় অংশের আয়ই কমে গেছে। কোন কোন কোম্পানি পড়েছে লোকসানে।

জানা গেছে, মূলধন উত্তোলন বিষয়ে এসইসির আলাদা বিভাগ ও কমিশনার থাকলেও আইপিও অনুমোদনে বিএসইসির চেয়ারম্যানের ইচ্ছাই প্রাধান্য পায়। আইপিওতে স্টক এক্সচেঞ্জের মতামতও উপেক্ষা করা হয়েছে। আইপিও প্রসপেক্টাসে দেওয়া তথ্যের সত্যতা ও যথার্থতার দায় রাখা হয়েছে ইস্যু ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর। যদিওতে আইপিওতে দেওয়া ভূল বা মিথ্যা তথ্যের কারণে আজ পর্যন্ত কোন ইস্যু ম্যানেজারকে শাস্তি পেতে হয়নি।  বিতর্ক এড়াতে আইপিওর আবেদন করা কোম্পানির বাস্তব পরিদর্শনও প্রক্রিয়াও বন্ধ রাখা হয়েছে। ফলে এসইসির অনুমোদনে খেলাপি প্রতিষ্ঠানও নাম পাল্টিয়ে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হতে পেরেছে। আবার দূর্বল মৌলভিত্তির কোম্পানি শুধুমাত্র কাগজে কলমে মুনাফা দেখিয়ে পুঁজিবাজার থেকে শত শত কোটি টাকা মূলধন উত্তোলন করতে পেরেছে। দূর্বল কোম্পানির আইপিওর অনুমোদন দেওয়ায় ২০১৩ সালে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও এক কোম্পানির অর্থ উত্তোলন প্রক্রিয়া আটকে দেন।

পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১১ সালে প্রতি শেয়ার ২৫ টাকা (১৫ টাকা প্রিমিয়াসহ) বরাদ্দ মূল্যে পুঁজিবাজার থেকে ৫০ কোটি টাকা সংগ্রহ করে জাহিনটেক্স ইন্ডাষ্ট্রিজ লিমিটেড। তালিকাভুক্তির সময় কোম্পানিটি ছয় মাসে শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) দেখায় ৩ টাকা ৫ পয়সা, যা বছর শেষে প্রায় ৬ টাকা ১০ পয়সা হওয়ার কথা। তবে তালিকাভুক্তির পর থেকেই কোম্পানির আয় কমতে থাকে। ২০১৭-১৮ হিসাব বছরে ইপিএস নেমে আসে মাত্র ৬০ পয়সায়। আর চলতি হিসাব বছরের তৃতীয় প্রান্তিক শেষে কোম্পানিটি প্রতি শেয়ারে ১ টাকা ৩৭ পয়সা লোকসান দেখিয়েছে। প্রিমিয়ামে আসা কোম্পানিটির শেয়ার দর নেমে এসেছে অভিহিত মূল্যের নীচে ৭ টাকা ৪০ পয়সায়। একই গ্রুপের অপর কোম্পানি জাহিন স্পিনিং মিলস ২০১৫ সালে তালিকাভুক্ত হয় অভিহিত মূল্যে। আয় কমে যাওয়ায় এ শেয়ারটির দরও অভিহিত মূল্যের নীচে লেনদেন হচ্ছে।

২০১১ সালে রংপুর ডেইরী অ্যান্ড ফুড প্রডাক্টস চার মাসে ইপিএস দেখায় ৮৮ পয়সা, যা বছর শেষে ২ টাকা ৬৪ পয়সা হওয়ার কথা। ২০১৭-১৮ হিসাব বছরে ৩৯ পয়সায় নেমে এসেছে। আর চলতি তৃতীয় প্রান্তিকে ইপিএস হয়েছে ৪১ পয়সা। কোম্পানিটি প্রতি শেয়ারে ১৮ টাকা (৮ টাকা প্রিমিয়ামসহ) নিয়ে তালিকাভুক্ত হলেও এখন এর শেয়ার দর ১৩ টাকা ৪০ পয়সা।

আইপিও ও প্লেসমেন্টের মাধ্যমে কোম্পানিগুলো শত শত কোটি টাকা সংগ্রহ করলেও অধিকাংশ কোম্পানির আয়ে কোন প্রবৃদ্ধি দেখা যায়নি। বরং ইপিএস ধারাবাহিকভাবে কমতে দেখা গেছে। আইপিও পরবর্তিতে কোম্পানির নতুন করে অর্থের প্রয়োজন না হলেও বছর বছর বোনাস শেয়ার ইস্যু করছে। কিন্ত বোনাস ইস্যুর মাধ্যমে সংগৃহীত অর্খ কোথায় ব্যয় করেছে, তা কখনোই কোম্পানিগুলো জানায়নি।

বর্তমান কমিশনের আমলে অনুমোদন পাওয়া আইপিওর মধ্যে ১০টি রয়েছে জেড ক্যাটাগরিতে। এগুলো হচ্ছে সিঅ্যান্ডএ টেক্সটাইল, ঢাকা ডায়িং, এমারল্ড অয়েল, ইভিন্স টেক্সটাইল, ফারইষ্ট ফাইন্যান্স, জিবিবি পাওয়ার, আইএসএন লিমিটেড, খুলনা পেপার, পদ্মা লাইফ ইন্স্যুরেন্স ও তুংহাই ডায়িং।

২০১২ সালে এসইসির অনুমোদন নিয়ে ১০ কোম্পানির পুঁজিবাজার থেকে অর্থ সংগ্রহ করে। সে সময় অভিহিত মূল্যে তালিকাভুক্ত জেনারেশন নেক্সট ফ্যাশনের ইপিএস ছিল ২ টাকা ৯ পয়সা, যা চলতি তৃতীয় প্রান্তিকে দাঁড়িয়েছে ৪৪ পয়সায়। শেয়ার কেনাবেচা হচ্ছে ৪ টাকা ৩০ পয়সা দরে। জিবিবি পাওয়ার ৩০ টাকা প্রিমিয়ামসহ প্রতি শেয়ার ৪০ টাকায় বরাদ্দ মূল্যে তালিকাভুক্ত হয়। সে সময় ইপিএস ছিল ২ টাকা ৬৩ পয়সা, যা চলতি তৃতীয় প্রান্তিকে দাঁড়িয়েছে ৭৬ পয়সায়। ২০১৮ সালে কোন লভ্যাংশ দিতে না পারায় জেড ক্যাটাগরিতে নেমে এসেছে এ কোম্পানি।

তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের আপত্তি সত্বেও প্রতি শেয়ার ২২ টাকা বরাদ্দ মূল্যে ২০১৩ সালে আইপিওর অনুমোদন পায় অ্যাপোলো ইস্পাত কমপ্লেক্স। তালিকাভুক্তির সময় কোম্পানির ইপিএস দেখায় ২ টাকা ৩৬ পয়সায়। তালিকাভুক্তির পাঁচ বছরে লোকসানে নামে কোম্পানিটি। বর্তমানে এর শেয়ার অভিহিত মূল্যের নীচে ৫ টাকা ৯০ পয়সায় কেনাবেচা হ”্ছ।ে একই সময়ে তালিতাভুক্ত হওয়া আর্থিক প্রতিষ্ঠান ফারইষ্ট ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট বড় ধরনের লোকসানে রয়েছে। এর শেয়ার দর অভিহিত মূল্যের অর্ধেক দরে কেনাবেচা হচ্ছে।

ঢাকাটাইমস/২১আগস্ট/আরএ/ডিএম