ছাত্রলীগের নামে বিতর্কিত আয়োজন

হল ভাড়া করা মাহমুদ হাসান কে?

প্রকাশ | ২২ আগস্ট ২০১৯, ০৯:০৬ | আপডেট: ২২ আগস্ট ২০১৯, ১০:৩৭

সৈয়দ ঋয়াদ, ঢাকাটাইমস

ইসলামপন্থীদের নিয়ে ছাত্রলীগের নামে যে কোরআন খতম ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছিল, সেই অনুষ্ঠানের জন্য ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে মিলনায়তন ভাড়ার আবেদন করা হয়েছিল মাহমুদ হাসান নামে একজনের নামে। তবে তার পরিচয় কেউ নিশ্চিত করতে পারছেন না।

এই মিলনায়তন ভাড়ার জন্য যে আবেদন করা হয়েছে, সেখানে একটি মোবাইল ফোন নম্বর আছে। কিন্তু বিতর্ক ওঠার পর নম্বরটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন কর্তৃপক্ষও হল ভাড়ার বিষয়ে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে কাউকে পাচ্ছে না।

এই পোস্টারটি নিয়ে তুমুল বিতর্কের পর ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে অস্বীকার করা হয়েছে আয়োজনের। যদিও পোস্টারটি সাঁটানো হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর কেন্টিন ও আশপাশের এলাকাতে। আর ছাত্রলীগের কেউ যদি এই উদ্যোগে না থাকে, তাহলে আদৌ এটা সম্ভব হবে কি না-এ নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন।

পোস্টারে ১৫ আগস্ট নিহত বঙ্গবন্ধু এবং তার পরিবারের সদস্যদের স্মরণে বৃহস্পতিবার রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে এই কোরআন খতম ও দোয়া মাহফিলের কথা জানানো হয়েছিল।

আয়োজনে সভাপতি হিসেবে নাম ছাপা হয় ছাত্রলীগপ্রধান রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন, প্রধান অতিথি হিসেবে নাম ছাপা হয় ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ।

তবে বিতর্ক ওঠে হামদ-নাত পরিবেশনকারী হিসেবে মুহিব খানের নাম দেখে, যার উপাধি দেওয়া হয় ‘জাগ্রত কবি’। আরও বেশ কয়েকজনের নাম আছে, যারা আসলে আওয়ামী লীগ বা ছাত্রলীগের রাজনৈতিক আদর্শের অনুসারী নন না। মুকিব খান মূলত কবি ও কওমি ধরানার সঙ্গীতশিল্পী।

মুহিব খানের বাবা বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য আতাউর রহমান খান। তিনি ১৯৯১ সালে কিশোরগঞ্জ সদর আসন থেকে ধানের শীষ নিয়ে জিতেছিলেন।

শোক দিবসের আয়োজনে বঙ্গবন্ধু বা তার মেয়ে শেখ হাসিনার ছবি না দেখে ক্ষুব্ধ হয়েছেন ছাত্রলীগের একাংশের নেতাকর্মীরা। আবার পোস্টারের ধরনটি ছাত্রলীগের বহু নেতাকর্মীদের মতে ‘মৌলবাদী সংগঠনের আদলে’ করা হয়েছে।

এ নিয়ে ফেসবুকে ক্ষোভ ঝাড়ার পর ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে অবশ্য দাবি করা হয়, এই অনুষ্ঠান তাদের ছিল না। এতে বলা হয়, বিতর্কিত অতিথিদের ও এই পোস্টার যারা তৈরি করেছেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

পরে যেখানে অনুষ্ঠানটি হওয়ার কথা, সেই ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউশনে খোঁজ নিয়ে ঢাকা টাইমস জানতে পেরেছে, ২২ আগস্টের জন্য মিলনায়তনটি ভাড়া করা হয় বেশ কিছুদিন আগে। ছাত্রলীগ যে প্যাডে বিজ্ঞপ্তি বা সংগঠনের নানা সিদ্ধান্ত পাঠায়, সেই প্যাডের আদলে একটি আবেদন করা হয়েছে হল ভাড়া করতে।

আবেদনপত্রে খেলা হয়েছে, জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে ‘ছাত্রলীগের উদ্যোগে’ কোরআন তেলাওয়াত, হামদ নাত ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে। এ জন্য যেন হলরুমটি বরাদ্দ দেওয়া হয়।

আবেদনপত্রটির নিচে নিবেদক হিসেবে ‘মাহমুদ হাসান’ এর নাম দেওয়া আছে, তবে কারো সই নেই। তবে এ জন্য কোনো অগ্রিম দেওয়া হয়নি।

আবেদনপত্রে একটি ফোন নম্বরও দেওয়া আছে। পোস্টার বিতর্কের পর অবশ্য সেই নম্বরটি বন্ধ পাওয়া গেছে। ফলে তিনি আসলে কে, এ নিয়ে প্রশ্নের সুরাহা হয়নি।

ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের কর্মী নুরুল হক এই আবেদনটি পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ঢাকা টাইমসকে। বুধবার তিনি বলেন, ‘প্যাডে যে ফোন নম্বর উল্লেখ করা হয়েছে, এই নম্বর থেকে গতকালও (মঙ্গলবার) আমার সাথে ৩৩ সেকেন্ড কথা হয়েছে। কিন্তু এ নিয়ে বিতর্ক হওয়ার পর আমরা চেষ্টা করেও নম্বরটিতে কাউকে পাইনি। কারণ, সেটি বন্ধ হয়ে গেছে।’

পরে ছাত্রলীগের নেতৃত্বের তালিকা ঘেঁটে দেখা গেছে, মাহমুদুল হাসান নামে একজন আছেন, যিনি বর্তমান কমিটির সহ-সভাপতি। তার ফোন নম্বর অবশ্য অন্য একটি এবং সেই নম্বরে কল করার পর তিনি রিসিভ করে ঢাকা টাইমসের সঙ্গে কথাও বলেছেন।

হল ভাড়া করার বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে মাহমুদুল বলেন, ‘আমি হল বুকিং দিই নাই... আর এটা আমার ফোন নম্বর না। তবে আমাদের ২২ তারিখ একটা অনুষ্ঠান আছে, এটা আমি জানি।’

সেই অনুষ্ঠান কী বিষয়ে এবং কারা আয়োজন করেছে, সে বিষয়ে অবশ্য কিছু জানাতে পারেননি সহসভাপতি মাহমুদুল হাসান।

এদিকে যাকে অনুষ্ঠানে অতিথি করা নিয়ে তুমুল সমালোচনা, সেই মুহিব খান এখন হজে আছেন বলে তথ্য মিলেছে। ধর্ম প্রতিমন্ত্রী নিজেও হজে গিয়েছেন। ফলে এই দুজনের কেউ এই অনুষ্ঠানের বিষয়ে আদৌ জানতেন কি না, এ নিয়েও আছে প্রশ্ন।

এই আয়োজন নিয়ে ধোঁয়াশা ও নানা সমালোচনার মধ্যে ছাত্রলীগের একটি অংশের নেতাকর্মীদের ক্ষোভ মিটছেই না। সংগঠনটির বিগত কমিটির সমাজসেবা সম্পাদক রানা হামিদ ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘ছাত্রলীগ স্বধীনতার পক্ষের শক্তি। ছাত্রলীগের অনুষ্ঠানে এমন একজন মানুষকে অতিথি করা হয়েছে, যে কিনা অতীতে বঙ্গবন্ধু, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও ইতিহাসকে নানান ভাবে বিকৃত করেছে।’

ছাত্রলীগ তো বলছে এই অনুষ্ঠানের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই- এমন প্রশ্নে রানা বলেন, ‘তাদের সম্পৃক্ততা না থাকলে ছাত্রলীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের ভেরিফাইড ফেসবুক ওয়াল থেকে এই ছবি শেয়ার করল কে? তাদের টুইটার থেকেই এই ছবি শেযার করল কে?’

‘পোস্টারে বঙ্গবন্ধুর ছবি থাকবে না, আপার ছবি থাকবে না, এটা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের ছাত্রলীগ এর কাজ হতে পারে না। এই পোস্টার হিযবুত তাহরীর আদলে করা।’

ছাত্রলীগের সাবেক কর্মসূচি ও পরিকল্পনাবিষয়ক সম্পাদক রাকিব হোসেন ফেসবুকে লিখেন, ‘শোক দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কর্মসূচির আয়োজন করবে। সেই কর্মসূচির পোস্টারে জাতির পিতাসহ শহীদদের কারও ছবি নেই। এটা ছাত্রলীগের কর্মসূচির সঙ্গে যায় না। মুহিব খান স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। সে জাতির পিতাকে স্বীকার করে না, জাতীয় সঙ্গীতকে মানে না।’

এসব বিষয় জানতে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীর ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।

ঢাকা টাইমসকে সংগঠনটির উপদপ্তর বিষয়ক সম্পাদক মাহমুদ আবদুল্লাহ বিন মুন্সি বলেন, ‘আমাদের আয়োজন নয়, এটি কওমি মাদ্রাসার একটি সংগঠন।’

অনুষ্ঠানের হল ভাড়া তো করা হয়েছে ছাত্রলীগের প্যাডে, এমন প্রশ্নের পর মুন্সি বলেন, ‘প্যাড যে কেউ ব্যবহার করতে পারে। ছাত্রলীগ তো সেসব দেখে রাখে না। তবে এই অনুষ্ঠানের বিতর্কিত অতিথিরা আসবে সেসব বিষয়ে শোভন ভাই, রাব্বানী ভাই কিছু জানেন না।’

ছাত্রলীগের গত কমিটির সহ-সভাপতি হাফিজুর রহমান সজিব বলেন, ‘মুহিব খান আমাদের জাতির পিতাকে স্বীকার করে না। এমন একজন মানুষ বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকতে পারেন না। আমার বিশ্বাস, বর্তমান সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক বিষয়টি সম্পর্কে ভালো ভাবে খোঁজখবর নেবেন। বঙ্গবন্ধুর ছাত্রলীগে কোনো বিতর্ক সহ্য করা হবে না। আশা করি, বিষয়টিকে আমলে নিয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ নেবে।’

ছাত্রলীগের ধর্মবিষয়ক সম্পাদক তাজ উদ্দিনও অস্বীকার করেন এই অনুষ্ঠান আয়োজনের বিষয়ে। তিনি বলেন, ‘আমরা জানি না। জানার জন্য আমি শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছি। কিন্তু তারা ফোন ধরছে না।’

নিজের ফেসবুক ওয়ালে অনুষ্ঠানের বিতর্কিত পোস্টার আপলোড করে ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক আফরিন নুসরাত লিখেছেন, ‘বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রলীগে আপনাকে স্বাগতম।’

ডাকসুর সদস্য ও ছাত্রলীগের গত কমিটির সদস্য তানভীর হাসান সৈকত তার ফেসবুক ওয়ালে হতাশা প্রকাশ করে লিখেন, জাতির পিতা ও জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে কূটক্তিকারী এই জাগ্রত কবি মুহিব খান। যিনি জামায়াতের সব প্রোগ্রামে গান পরিবেশন করতেন।

ঢাকাটাইমস/২২আগস্ট/এসআর/ডব্লিউবি