দ্বিতীয় দফায়ও ভেস্তে গেল প্রত্যাবাসন

নজরুল ইসলাম
| আপডেট : ২২ আগস্ট ২০১৯, ২২:৩৮ | প্রকাশিত : ২২ আগস্ট ২০১৯, ২১:১৫
ফাইল ছবি
  • নিরাপত্তার নিশ্চয়তা ছাড়া যেতে রাজি নয় রোহিঙ্গারা
  • এখনো আশায় ঢাকা, প্ররোচনা দিলে ব্যবস্থার হুঁশিয়ারি
  • মিয়ানমারের উদ্যোগ লোক দেখানো, বলছেন বিশ্লেষক

‘নিরাপত্তা নেই, যাব না’- বাংলাদেশে ক্যাম্পে থাকা রোহিঙ্গাদের এই একই বক্তব্য আর তাদের আশ্বস্ত করতে মিয়ানমার সরকারের উদ্যোগহীনতায় আবার ভেস্তে গেল প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া। দ্বিতীয়বারের মতো সব ঠিকঠাক করেও একজনকেও পাঠানো গেল না।

গত বছরের ১৫ নভেম্বর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের প্রথম সময়সীমা ঠিক হয়েছিল। রোহিঙ্গারা রাজি না হওয়ায় সেবার একজনকেও রাখাইনে পাঠানো যায়নি। আজ দ্বিতীয় দফা প্রত্যাবাসন শুরুর দিনক্ষণ ঠিক হলেও রোহিঙ্গাদের সেই পুরনো অনাগ্রহই নতুন করে প্রকাশ পেয়েছে।

তবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে মোমেন হাল ছাড়তে রাজি নন। দুপুরে ঢাকায় নিজের কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা আশা করেছিলাম- আজ স্বল্প আকারে হলেও প্রত্যাবাসন শুরু হবে। তবে এখন পর্যন্ত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হয়নি। কিন্তু আমরা আশা ছাড়িনি, আশায় বুক বেঁধে আছি।’

রোহিঙ্গাদের দাবি, রাখাইনে প্রত্যাবাসনের সহায়ক পরিবেশ নেই। এর বাইরে সেখানে নাগরিকত্ব, ফেলে আসা সম্পত্তি ফেরত ও নিরাপত্তা নজরদারির শর্ত জুড়ে দিচ্ছে। সেগুলো আবার দেশটি দিতে নারাজ।

প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করতে উদগ্রীব বাংলাদেশ এটাও বলেছে, ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানো হবে না। এ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘সমস্যা মিয়ানমারের, সমাধানও তাদেরই করতে হবে। আমরা জোর করে কিছু করব না।’

এবার প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমার থেকে তিন হাজার ৫৪০ জন রোহিঙ্গার নামের তালিকা বাংলাদেশ সরকারকে দেওয়া হয়েছিল। তালিকায় থাকা এক হাজার ৩৭টি পরিবারের মধ্যে গত মঙ্গলবার ২১টি এবং গতকাল ২১৪টি এবং এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত মোট ২৯৫ পরিবারের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। এই প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।

এবারই প্রথম ঢাকায় চীনা দূতাবাসের দুই কূটনীতিক ও মিয়ানমার দূতাবাসের এক কূটনীতিক সরেজমিনে পরিস্থিতি দেখতে কক্সবাজারে ছিলেন। এরপরও প্রত্যাবাসন কেন ভেস্তে গেল জানতে চাইলে সাবেক রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ জমির ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘এটা পরিষ্কার ছিল যে এবারের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াও সফল হবে না। কারণ, রোহিঙ্গারা যা চাইছে সেটা নিশ্চিত করতে পারেনি মিয়ানমার সরকার। তাদের এই প্রস্তুতি ছিল প্রতীকী, তারা জানত এটাই হবে। যে পর্যন্ত মিয়ানমার তাদের লোকদের আশস্ত করতে পারবে সে পর্যন্ত এটা শুরু হবে না।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘এটা মিয়ানমারের কূটনৈতিক চাল। কারণ সেপ্টম্বরে জাতিসংঘ অধিবেশন বসবে, এটাকে তারা এই মুহূর্তে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছে। আসলে তারা সিরিয়াস না, বিশ্বকে দেখাচ্ছে। রোহিঙ্গাদের সেখানে ফেরাতে হলে, তাদের সব চাওয়া নিশ্চিত করতে হবে।’

কীভাবে এই প্রত্যাবাসন শুরু হতে পারে জানতে চাইলে ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘মিয়ানমারে এমন আইন রয়েছে যেটা রোহিঙ্গাদের অনুকূলে না সেটা পরিবর্তনের জন্য বাংলাদেশকে বিশ্বকে হাতে নিয়ে তাদের চাপ দিতে হবে। তখন জাতিসংঘ বা বাংলাদেশ কাউকেই লাগবে না, তারা নিজেই চলে যাবে।’

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যা যা ঘটেছে

যাদের সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছিল, তারা যেন মিয়ানমার ফিরে যেতে পারে, সে জন্য কক্সবাজারের টেকনাফের কেরুনতলী ঘাট ও নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম সীমান্তে দুটি প্রত্যাবাসনকেন্দ্র প্রস্তুত রাখা ছিল। এ ছাড়া তিনটি শিবিরের কাছে অন্তত পাঁচটি বাস ও একটি ট্রাক তৈরি রাখার পাশাপাশি স্থলপথে রোহিঙ্গাদের পাঠানোর জন্য যানবাহনও সংগ্রহ করা হয়েছিল।

এ দফায় রাখাইনে পাঠানোর জন্য নির্বাচিতদের মধ্যে ৯২৭টি পরিবার রয়েছে উখিয়ায় ২৬ নম্বর শিবিরে। এ ছাড়া কয়েকটি পরিবার রয়েছে অন্য তিনটি শিবিরে।

প্রত্যাবাসনের জন্য তালিকায় থাকা রোহিঙ্গা গতবার প্রত্যাবাসনের জন্য সাক্ষাৎকার দিতে রাজি না থাকলেও এবার তারা অন্তত কথা বলেছে এসে। তবে রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি দেশি বিদেশি প্রত্যাবাসনবিরোধী পক্ষগুলো বেশ সক্রিয় ছিল বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে তথ্য আসে।

রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে থাকার জন্য প্ররোচণা দিচ্ছে অভিযোগ এনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের থাকার জন্য অনেকেই প্ররোচনা চালাচ্ছেন। লিফলেট বিতরণ করছেন। ইংরেজিতে প্ল্যাকার্ড লিখে দিচ্ছেন। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

আশির দশক থেকেই প্রাণ বাঁচাতে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা মুসলিমরা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া শুরু করে। তবে সবচেয়ে বড় ঢল নামে ২০১৭ সালের আগস্টে। এখন সব মিলিয়ে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অবস্থান করছে।

এদেরকে ফিরিয়ে নিতে একাধিকবার দিন তারিখ ঠিক হলেও মিয়ানমারের টালবাহানা আর রোহিঙ্গারা নিরাপত্তার নিশ্চয়তা না পাওয়ায় প্রত্যাবাসন পিছিয়ে যাচ্ছে।

প্রত্যাবাসন শুরু করতে বাংলাদেশ বিভিন্ন ধরনের কূটনৈতিক তৎপরতা চালায়। গত ১ থেকে ৬ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরের সময় দেশটির সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে সহায়তার আশ্বাসও মেলে। রোহিঙ্গাদের নিজ ভূমিতে ফেরানোর পরিবেশ তৈরিতে চীন মিয়ানমারকে রাজি করানোর পদক্ষেপ নেবে বলে শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন চীনা প্রধানমন্ত্রী লি কেকিয়াং।

ওই সময় শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাতে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিসি) আন্তর্জাতিক বিষয় সম্পর্কিত মিনিস্টার সান তাও তাদের দলের পক্ষ থেকে মিয়ানমারের রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার আশ্বাসও দেন।

পরে চীনের প্রসিডেন্ট শি চিন পিংও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে দ্রুত রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে গুরুত্ব দেন।

এরপর প্রত্যাবাসনের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে ৮ আগস্ট প্রায় সাড়ে তিন হাজার রোহিঙ্গার তালিকা জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থাকে (ইউএনএইচসিআর) দেয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

গত মাসের শেষ সপ্তাহে মিয়ানমারের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে কক্সবাজারের উখিয়ার শিবিরে দুই দফা বৈঠকেও রোহিঙ্গারা রাখাইনে ফিরে যাওয়ার ক্ষেত্রে কয়েকটি শর্ত জুড়ে দিয়েছে। শেষ পর্যন্ত আলোচনা অব্যাহত রাখার আশ্বাস দিয়ে মিয়ানমারের প্রতিনিধিদল কক্সবাজার ছেড়ে যায়।

পরে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে কোনো সিদ্ধান্তে না আসতে পারা দুই দেশ মূলত চীনের কারণেই প্রত্যাবাসনের প্রস্তুতি নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

বাংলাদেশে কত রোহিঙ্গা?

২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইনের কয়েকটি নিরাপত্তা চৌকিতে হামলার পর মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগীদের হত্যা-ধর্ষণসহ বিভিন্ন সহিংসতা ও নিপীড়নের শিকার হয়ে সাড়ে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে।

১৯৮২ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত নানা অজুহাতে নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচার জন্য বাংলাদেশে পালিয়ে আশ্রয় নেওয়া অন্তত সাড়ে তিন লাখ রোহিঙ্গা আগে থেকেই কক্সবাজারের বিভিন্ন আশ্রয় শিবিরে ছিলেন।

এর ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালের জানুয়ারি রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে বাংলাদেশ-মিয়ানমার প্রত্যাবাসন চুক্তি হয়। একই বছরের ৬ জুন নেপিদোতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে মিয়ানমার ও জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর মধ্যেও সমঝোতা চুক্তি হয়। চুক্তি অনুযায়ী গত বছরের ১৫ নভেম্বর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের তারিখ নির্ধারণ করা হয়। তবে আবারও হামলার মুখে পড়ার আশঙ্কায় রোহিঙ্গারা নিজ দেশে ফিরতে অস্বীকৃতি জানানোয় ব্যর্থ হয় ওই উদ্যোগ।

সর্বশেষ চলতি বছরের জুলাই মাসে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে নতুন করে উদ্যোগের অংশ হিসেবে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন করে মিয়ানমারের পররাষ্ট্র সচিব মিন্ট থোয়ের নেতৃত্বাধীন একটি প্রতিনিধি দল। ১৫ সদস্যের দলটি দুই দিন ধরে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আলোচনা ও বৈঠক করে। এসব বৈঠকে রোহিঙ্গাদের তরফে ফিরে যাওয়ার ক্ষেত্রে মিয়ানমারের নাগরিকত্ব ও চলাফেরায় স্বাধীনতার দাবি তুলে ধরা হয়।

ঢাকাটাইমস/২২আগস্ট/ডব্লিউবি

সংবাদটি শেয়ার করুন

জাতীয় বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :