এভাবে আর কতদিন?

হাবিবুল্লাহ ফাহাদ
| আপডেট : ২৫ আগস্ট ২০১৯, ১৩:১৩ | প্রকাশিত : ২৫ আগস্ট ২০১৯, ১৩:১০

বৃহস্পতিবার (২২ আগস্ট) রাতে বেসরকারি একটি টিভি চ্যানেলে আলোচনা হচ্ছিল। বিষয় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন। সঞ্চালক মুঠোফোনে একজন রোহিঙ্গা নেতাকে (মাঝি) যুক্ত করলেন। নাম দিল মোহাম্মদ। তিনি জানালেন, টেকনাফের সীমান্তবর্তী নো-ম্যানস ল্যান্ডে আছেন। খুব বৃষ্টি হচ্ছে।

প্রশ্নকর্তা দুবার প্রশ্ন করলেও বৃষ্টির কারণে তিনি শুনতে পারছেন না বলে জানান। সঞ্চালক আবারও প্রশ্ন ছুড়ে দেন, ‘আপনারা দেশে (মিয়ানমারে) ফিরে যেতে চাইছেন না কেন?’

দিল মোহাম্মদ এবার জবাব দিলেন। বললেন, ‘আমরা যাবো না।’

প্রশ্নকর্তা আবারো বললেন, ‘কেন যাবেন না?’

‘আমরা জেনেছি মিয়ানমারে এখনো পরিবেশ তৈরি হয়নি। নিরাপত্তা নেই। নিরাপত্তার গ্যারান্টি না পেলে আমরা তো যাবো না।’

‘আপনারা কী করে জানলেন যে, পরিবেশ তৈরি হয়নি?’

‘সেখানে এখনো অনেক রোহিঙ্গা আছে। তারা বলেছে।’

‘মিয়ানমারের সাথে তো যোগাযোগ করা কঠিন। যোগাযোগ করা যায় না। আপনারা কী করে জানলেন?’

দিল মোহাম্মদ এবার খানিকক্ষণ চুপ রইলেন। বললেন, ‘আমরা জেনেছি। জাতিসংঘ বলছে, সেখানে কোনো লোক থাকার পরিবেশ তৈরি হয়নি।’

এবার সংলাপের আমন্ত্রিত একজন অতিথি বললেন, ‘আপনাকে নিয়ে যদি সেখানকার অবস্থা দেখিয়ে আনা হয়, কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে আপনি যাবেন?’

এবার স্পষ্ট না করলেন রোহিঙ্গাদের এই নেতা। বললেন, ‘আমরা তো যাবো না।’

ভিডিও কলে যুক্ত ছিলেন বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের পরিচালক কে এম মোর্শেদ। তিনিও শুনছিলেন রোহিঙ্গা মাঝি দিল মোহাম্মদের কথা। এক পর্যায়ে তার কাছেও প্রশ্ন রাখা হয়, ‘অভিযোগ আছে এনজিওগুলোর অনেকেই চাচ্ছে না রোহিঙ্গারা ফিরে যাক। তারা যদি দেশে ফেরত যায় তাহলে এনজিওর বড় কর্মকর্তাদের সুযোগ-সুবিধা কমে যাবে। এ ধরনের কোনো বিষয় আপনার জানা আছে কি না?’

জবাবে বলেন, ‘আমাদের কাছে এরকম কোনো ঢালাও অভিযোগ নেই। যদি ঘটেই থাকে তাহলে এটা যে প্রকাশ্যে হয়েছে তা কিন্তু নয়। ওখানে ৩০০ এনজিও কাজ করছে। তার মধ্যে ২০০ এনজিও একেবারেই ছোট। দুই-একটি প্রকল্প আছে তাদের। তাই তারা কী চায় না চায় এতে কিছু আসে যায় না। সরকার এই রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে। সরকারই ঠিক করবে তারা এখানে কতদিন থাকবে। এখানে থাকবে না ভাসানচরে যাবে। এগুলো নিয়ে এনজিওদের কথা বলার সুযোগ আছে বলেও আমার মনে হয় না।’

আবার প্রশ্ন, ‘তাহলে কদিন ধরে সেখানে যেসব কাজ চলছে, পাঁচ দফা দাবির পক্ষে স্বাক্ষর নেওয়া হচ্ছে, লিফলেট বিতরণ হচ্ছে, প্ল্যাকার্ড টাঙানো হচ্ছেÑনিরীহ রোহিঙ্গাদের মাথায় তো এগুলো থাকবে না।’

কে এম মোর্শেদ বললেন, ‘থাকতেও পারে। রোহিঙ্গাদের মধ্যে কিন্তু ছয় থেকে সাতটি গ্রুপ আছে। যাদের কিছু ফান্ডিং বিদেশ থেকে আসে। কিছু আছে, যারা মিয়ানমারে বিভিন্ন গোষ্ঠীর সাথে জড়িত ছিল। তারা এসব করতে পারে।’

দুই. এভাবে আর কতদিন? বেঁচে থাকা মানে তো কেবল নিশ^াস নেওয়া নয়! কক্সবাজার, টেকনাফের বন উজাড় হয়েছে। পাহাড় কেটে গড়েছে বসতি। পর্যটন নগরীর নৈসর্গ চাইলেই অবলোকন করা যায় না। বাধা-বিপত্তি। নিরাপত্তা শঙ্কা তো আছেই। প্রকৃতিও তার সৌন্দর্য হারিয়েছে অনেকটা। চারদিকে কেবল মানুষ আর মানুষ। পায়ে পায়ে নাফ নদীতে ভেসে আসা মানুষের ঢল। সমুদ্র ঘেঁষা জনপদ এখন রোহিঙ্গা নিবাস।

খুন, ধর্ষণ, বসতভিটায় আগুন, লুটপাটের নির্মমতা সইতে না পেরে নাফ নদী পাড়ি দিয়েছিলেন রাখাইন রাজ্যের বহু মানুষ। ১৯৮২ সাল থেকে শুরু। ২০১৬ সাল পর্যন্ত কমবেশি এসেছে। বসতি গেড়েছে এ পাড়ে। ২০১৭ সালের আগস্টে ঘটে বড় ঘটনা। বানের পানির মতো ঢল নামে রোহিঙ্গাদের। এখন পর্যন্ত নতুন-পুরোনো মিলিয়ে নিবন্ধিত রাখাইন রাজ্যের নাগরিকের সংখ্যা ১১ লাখ ৫০ হাজার।

এই ভূখ- তো তাদের নয়। শরণার্থীর জীবন তাদের। অত্যাচার সইতে না পেরে প্রতিবেশী দেশে ঠাঁই নিয়েছে। তাই বলে ফিরতে হবে না? আন্তর্জাতিক চাপ আছে মিয়ানমার সরকারের ওপর। শুরু থেকেই। একটা দেশ তাদের প্রকৃত নাগরিকদের ওপর এমন অত্যাচার চালাতে পারে, বিস্মিত হয়েছে বিশ^। কিন্তু ভাবান্তর হয়নি মিয়ানমারের। চতুর্মুখী চাপ বন্ধ হয়নি। কেন তারা নাগরিকদের ফিরিয়ে নেবে না? রোহিঙ্গারা তো মিয়ানমারের মানুষ। বাংলাদেশে তো তাদের স্থায়ী নিবাস হতে পারে না! এই বাস্তবতা মেনে মিয়ানমার রাজি হয়েছে তাদের নাগরিকদের ফিরিয়ে নিতে।

আলোচনার পর আলোচনা করে দুই দফা সময় ঠিক হয়। গত বছরের ১৫ নভেম্বর। পরে এ মাসের ২২ তারিখ। দুই দেশেই প্রস্তুতি ছিল। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে। কিন্তু একজন রোহিঙ্গাও যেতে রাজি হননি। মিয়ানমার তিন হাজার ৫৪০ জন রোহিঙ্গার তালিকা দিয়েছিল। যাদের তারা প্রথম ধাপে ফিরিয়ে নিতে চায়। তাদের সাক্ষাৎকার হয়েছে দফায় দফায়। কেউই যেতে রাজি হয়নি। উল্টো দাবি দিয়েছে পাঁচটি। এগুলো পূরণ না হলে এদেশ ছাড়বে না, এমন মনোভাব তাদের।

প্রশ্ন হচ্ছে, রোহিঙ্গাদের দাবি পূরণের জন্য কি বাংলাদেশ বাধ্য? তাদের এই শরণার্থী জীবনের জন্য বাংলাদেশ দায়ী? মানবিক দিক বিবেচনায় বাংলাদেশ তাদের আশ্রয় দিয়েছে। বাসস্থানের ব্যবস্থা করেছে। অন্নের জোগান দিচ্ছে। তারা যেন নিজ ভুঁইয়ে ফিরতে পারে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সেই দেন-দরবার করে যাচ্ছে, এখন যদি রোহিঙ্গারা ফিরে না যায়, তাহলে এত তোড়জোড়ে কী লাভ?

একথা তো ঠিক যে, রোহিঙ্গারা এখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে পারবে না। তাদের ফিরে যেতে হবে নিজ দেশেই। কারণ তাদের জীবনযাত্রা, সামাজিক আচার-আচরণ, মানসিক অবস্থা কোনোটাই আমাদের মতো নয়। ভিন্নতা আছে। তাদের নিজেদের জন্যই রাখাইনে ফিরে যাওয়া উচিত। যেখানে তাদের পূর্বপুরুষের আদি নিবাস, তা কি তারা চাইলেই অস্বীকার করতে পারবে? ফিরে যেতে হবে নিজেদের দেশে।

২২ আগস্ট যখন গোটা বিশ^ তাকিয়ে ছিল কক্সবাজারের দিকে, রোহিঙ্গারা ফিরে যাচ্ছে কি যাচ্ছে না, তা জানার জন্য চেষ্টা করছিল, তখন মিয়ানমারের প্রশাসনিক রাজধানী নেপিডোতে দেশটির সেনাপ্রধান সিনিয়র জেনারেল মিন অং লায়েংয়ের সঙ্গে দেখা করেন চীনের রাষ্ট্রদূত শেন হেই। রাখাইনের রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আন্তর্জাতিক মহল চাপ দিলে চীন যে মিয়ানমারের পাশে থাকবে, তা তিনি ওই বৈঠকে উল্লেখ করেছেন। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর একটি ওয়েবসাইটকে উদ্ধৃত করে সেখানকার অনলাইন পত্রিকা ইরাবতি এই খবর দিয়েছে। আবার বৃহস্পতিবারই (২২ আগস্ট) প্রথম ঢাকায় চীনা দূতাবাসের দুই কূটনীতিক ও মিয়ানমার দূতাবাসের এক কূটনীতিক সরেজমিনে পরিস্থিতি দেখতে কক্সবাজারে ছিলেন। আসলে চীন কী চাইছে? তারা শুরু থেকেই মিয়ানমারের পাশে ছিল। এখনো তাদের গতিবিধি তা-ই বলছে।

রোহিঙ্গারা দাবি তুলেছে পাঁচটি। ১. রোহিঙ্গারা আরাকানের (রাখাইন) স্থায়ী বাসিন্দা। সে কারণে রোহিঙ্গাদের ‘স্থানীয়’ স্বীকৃতি দিয়ে সংসদে আইন পাস করতে হবে। ২. আরাকানে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ও পরিচয়পত্র দিতে হবে। ৩. রোহিঙ্গাদের নিজ গ্রামে ফিরিয়ে নিতে হবে। কেড়ে নেওয়া জমিজমা যথাযথ ক্ষতিপূরণসহ ফেরত দিতে হবে। ৪. আরাকানে রোহিঙ্গাদের জীবন ও সম্পদ সুরক্ষার জন্য রোহিঙ্গা পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন করতে হবে এবং ৫. মিয়ানমারের স্থানীয় আদালতের পরিবর্তে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে অপরাধীদের বিচার করতে হবে।

তাদের এই দাবিগুলো যৌক্তিক বটে। কিন্তু এই দাবি আদায়ের দায়িত্ব কি বাংলাদেশের? এখানে বসে দাবি জানালে মিয়ানমার কি মেনে নিতে বাধ্য হবে? এই দাবি দিয়ে তারা কি বাংলাদেশকে জিম্মি করতে পারে? প্রশ্ন ছিল পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেনের কাছে। বলেছেন, ‘আমরা তো তাদের দাবির কাছে জিম্মি হয়ে থাকতে পারি না। তাদের দাবি নিজের দেশে গিয়েই অর্জন করতে হবে।’

মিয়ানমারে ফিরে গিয়ে তারা সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে। এখানে বসে দাবি জানালে মিয়ানমার তা কেনই বা মেনে নিবে? তাদের দেশে ফিরে যেতে হবে। সেখানে গিয়ে সোচ্চার হতে হবে দাবি আদায়ে। তাছাড়া তারা যে নাগরিকত্বের দাবি তুলেছে এটি তো নতুন নয়। দূর দেশে বসে দাবি আদায়ে প্রচারপত্র বা লিফলেট বিতরণও তো কোনো ভালো কথা নয়। এখানে তো মিয়ানমারের কোনো কর্তৃপক্ষ নেই। তাহলে এসব লিফলেট বিতরণের মানে কী? এর পেছনে অন্য কেউ নেই তো? যারা ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীস্বার্থ রক্ষায় রোহিঙ্গাদের উস্কে দিচ্ছেন তাদের খুঁজে দেখতে হবে। কারণ সরকার তরফেও বারবার বলা হচ্ছে, তাদের স্বদেশে না ফিরতে প্ররোচিত করা হচ্ছে। কারা করছে এসব? বেসরকারি সংস্থাগুলোর ব্যাপারে অভিযোগ উঠছে। তারা চলমান প্রকল্প জিইয়ে রাখতে এই কৌশল নিচ্ছে। আসলেই যদি তা হয়, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর হতে হবে। দেশের স্বার্থের চেয়ে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীস্বার্থ যাদের কাছে বড়, তারা কখনোই দেশের ভালো চায় না। এদের ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে।

লেখক: সাংবাদিক ও গল্পকার।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :