‘আওয়ামী লীগকে কিছু করতে দেওয়া হবে না’

প্রভাষ আমিন
| আপডেট : ২৬ আগস্ট ২০১৯, ১৬:৪৪ | প্রকাশিত : ২৬ আগস্ট ২০১৯, ১৬:৩৬

২১ আগস্টের আলোচনা সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘এটা ঠিক, খালেদা জিয়াকে আসামি করা হয়নি। কিন্তু তার তো প্রচ্ছন্ন সহযোগিতা রয়েছে। কারণ, তিনি তো প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তার যে সম্পূর্ণ দায়-দায়িত্ব রয়েছে, সেটা তো অস্বীকার করা যায় না। আর তিনি তো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন এবং লুৎফুজ্জামান বাবর স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। উল্টো তারা দোষারোপ শুরু করল, এটা আওয়ামী লীগ নিজে নিজেই করেছে।’ শেখ হাসিনা যা বলেছেন, তা বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে না। কিন্তু বাস্তবতা হলো, যত অবিশ্বাস্যই মনে হোক, খালেদা জিয়া ঘটনার আগে থেকে না জানলেও পরে তদন্ত ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে ভূমিকা রেখেছেন। তদন্তের নামে একের পর এক আষাঢ়ে গল্প রচনায় নিশ্চয়ই তখনকার প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সায় ছিল। দৈনিক প্রথম আলো বিভিন্ন সময় ২১ আগস্টের ঘটনা নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। গত ২১ আগস্ট প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান ‘এমন নৃশংস ঘটনা আর চাই না’ শিরোনামে একটি মন্তব্য প্রতিবেদন লিখেছেন। সেখানে তিনি লিখেছেন, ‘তখনই প্রথম আলোর অনুসন্ধানে জানা গিয়েছিল, জোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরকে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা সম্পর্কে কোনো তদন্ত করতে নিষেধ করেছিলেন। শক্তিশালী এই সংস্থার প্রধানকেও তদন্ত প্রক্রিয়ায় যুক্ত করা হয়নি। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তার পছন্দের সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাদের দিয়ে ২১ আগস্টের হত্যাকা-ের তদন্ত করতে একটি কমিটি করেছিলেন। তবে সেই তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনও কোনো দিন প্রকাশ করা হয়নি।’ এত বড় ঘটনায় কেন ডিজিএফআইকে তদন্ত করতে দেওয়া হয়নি? সত্য আড়াল করতে? আমার ধারণা খালেদা জিয়া গ্রেনেড হামলার পরপরই সত্যটা জেনে যান। তাই সন্তান এবং সরকারকে বাঁচাতে তিনি বেপরোয়া হয়ে যান। শুধু সত্যটা আড়াল করেই ক্ষান্ত হয়নি বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার, উল্টো দোষ দিয়েছে আওয়ামী লীগকে। আওয়ামী লীগ নিজেরাই জনগণের সহানুভূতি ও সমর্থন পেতে ওই গ্রেনেড হামলা চালিয়েছিল বলে প্রচারণা চালানো হয়েছিল। চেষ্টা হয়েছিল একে আওয়ামী লীগের অন্তর্দ্বন্দ্ব হিসেবে চালানোর। শেখ হাসিনা ভ্যানিটি ব্যাগে করে গ্রেনেড নিয়ে এসেছিলেন এমন কথাও বলা হয়েছিল। বিএনপি-জামায়াত সরকার যতই চেষ্টা করুক, সত্য চাপা থাকেনি। ওয়ান-ইলেভেন সরকারের সময়ই সত্য বেরিয়ে আসে।

তবে সমস্যা হলো, বিএনপি এখনও এই সত্য মানতে চায় না। স্বীকার করা তো দূরের কথা, এখনও নানান তত্ত্ব হাজির করে। সমাবেশ কেন মুক্তাঙ্গন থেকে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আনা হলো, এত পরিকল্পনা সত্ত্বেও শেখ হাসিনার ট্রাকে গ্রেনেড বিস্ফোরিত হয়নি কেন, রাষ্ট্র যদি পৃষ্ঠপোষকতা করে তাহলে শেখ হাসিনা বেঁচে গেলেন কীভাবে? এসব প্রশ্ন এখনও ফেসবুকে ঘুরে বেড়ায়। যতদিন বিএনপি সত্যটা স্বীকার না করবে, ততদিন এ মহাপাপের প্রায়শ্চিত্ত শেষ হবে না। অবশ্য খালেদা জিয়া দেড় বছরের বেশি সময় ধরে কারাগারে, তারেক রহমান ১২ বছর ধরে পলাতক, সংসদে বিএনপির আসন মাত্র ৬টিÑ এ সবই সেই প্রায়শ্চিত্ত প্রক্রিয়ার অংশ। যদি বিএনপির লোকজন সত্যিটা বিশ্বাস করেও অস্বীকার করেন, তাহলে এক রকম। আর যদি তারা এখনও বিশ্বাস করেন, গ্রেনেড হামলা আওয়ামী লীগই ঘটিয়েছিল, তাহলে তাদের প্রায়শ্চিত্ত কখনো শেষ হবে না।

বলছিলাম মতিউর রহমানের মন্তব্য প্রতিবেদনের কথা। ঘটনার ৫ দিন পর তখনকার প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাতের বিবরণটি উদ্ধৃত করছি, ‘মনে আছে, ২৬ আগস্ট অপরাহ্নে খালেদা জিয়ার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে আলোচনার সময় তারেক রহমানও উপস্থিত ছিলেন। সেদিন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীকে বেশ বিচলিত মনে হয়েছিল। সে সময় খালেদা জিয়ার আমন্ত্রণে পত্রিকার সম্পাদকরা তার সঙ্গে আলাদাভাবে দেখা করেছিলেন। খালেদা জিয়া শুরুতেই আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, কারা এ ঘটনা ঘটাতে পারে বলে আপনি মনে করেন? আমার সরাসরি উত্তর ছিল, সুনির্দিষ্টভাবে আমার পক্ষে বলা মুশকিল। তবে ইসলামি জঙ্গিদের দল হরকাতুল জিহাদ, ভারতের আসামের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফা বা বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের ফ্রিডম পার্টি প্রভৃতি হয়তো এ ঘটনার সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারে। খালেদা জিয়া শুরুতেই বলেন, ফ্রিডম পার্টির এখন আর অস্তিত্ব নেই। তাদের জড়িত থাকার সম্ভাবনা নাকচ করে দেন তিনি। কিন্তু হরকাতুল জিহাদ ও উলফা সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করেননি। তবে তিনি বলেছিলেন, আপনারা ধর্মীয় সংগঠনগুলো সম্পর্কে অতিরঞ্জন করেন, বাড়িয়ে বলেন; আপনারা বায়াসড (পক্ষপাতমূলক) লেখালেখি করেন। আমার এখনও মনে আছে, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমার সেই আলোচনা কিছুটা সময়ের জন্য উত্তেজনাপূর্ণ ছিল। আমি অভিযোগ করেছিলাম, আপনারা আওয়ামী লীগের মামলা নিচ্ছেন না, নিহতদের লাশ দিচ্ছেন না এবং প্রতিবাদ সমাবেশ বা শোক পালন করতে দিচ্ছেন না। আওয়ামী লীগ শোক প্রকাশও করতে পারবে না? তখন একপর্যায়ে খালেদা জিয়া উত্তেজিত ভাষায় বলেছিলেন, আওয়ামী লীগকে কিছু করতে দেওয়া হবে না, প্রয়োজনে শায়েস্তা করা হবে এবং কিছুতেই ’৯৬ সালের অবস্থা তৈরি করতে দেবেন না।’

খালেদা জিয়া চেয়েছিলেন আওয়ামী লীগকে কিছু করতে দেবেন না। এই বাংলাদেশে আজ খালেদা জিয়ার স্বপ্নই বাস্তবায়িত হচ্ছে। খালি পাল্টে গেছে দলের নাম। বিএনপিকে আজ কিছুই করতে দেওয়া হচ্ছে না। ইচ্ছামতো শায়েস্তা করা হচ্ছে। এটা আসলে বিএনপির প্রায়শ্চিত্ত প্রক্রিয়ার অংশ। তবে আওয়ামী লীগকে শায়েস্তা করতে খালেদা জিয়ার আকাক্সক্ষাটা যেমন ঠিক ছিল না, তেমনি এখন যে আওয়ামী লীগ বিএনপিকে কিছু করতে দিচ্ছে না, শায়েস্তা করছে; সেটাও ঠিক না। নি¤œ আদালতে গ্রেনেড হামলা মামলার রায় হয়েছে। ১৯ জনের মৃত্যুদন্ড, ১৯ জনের যাবজ্জীবন এবং ১১ জনের নানা মেয়াদে কারাদ- হয়েছে। এখন মামলাটি উচ্চ আদালতে যাবে। আপিল নিষ্পত্তি হওয়ার পর রায় কার্যকর হবে। অপরাধের বিচার হবে আদালতে। কিন্তু রাজনীতি যেন থাকে রাজনীতির মাঠেই। কোনো রাজনৈতিক দলকে কিছু করতে না দেওয়া বা শায়েস্তা করাটা রাজনীতি নয়।

প্রভাষ আমিন: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :