রোগ পরীক্ষার ফি নির্ধারণে স্বেচ্ছাচার

প্রকাশ | ২৭ আগস্ট ২০১৯, ০৮:৩৫ | আপডেট: ২৭ আগস্ট ২০১৯, ০৯:৫৭

আশিক আহমেদ, ঢাকাটাইমস

পুরো শরীরের এমআরআই পরীক্ষা করতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল নেয় তিন হাজার টাকা। তবে কোনো রকম ইনজেকশন লাগলে সেক্ষেত্রে বেড়ে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত লাগতে পারে। অন্যদিকে বেসরকারি চিকিৎসালয় পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারে এই পরীক্ষা করতে লাগে ন্যূনতম সাত হাজার টাকা। ল্যাবএইড হাসপাতালে লাগে আরও বেশি। যেকোনো অঙ্গের এমআরআইয়ের করতে সেখানে গুণতে হয় আট হাজার টাকা।

দুটি চিকিৎসালয় মোটামুটি একই মানের। তাহলে টাকার পার্থক্য কেন, এ নিয়ে প্রশ্নের জবাব নেই। আর জটিল রোগের পরীক্ষার জন্য এই পরীক্ষা করতে হয় বলে রোগীদের পক্ষে হাসপাতাল ঘুরে ঘুরে যাচাই করা সম্ভব হয় না।

আর অভিজাত হিসেবে পরিচিতি পাওয়া অন্য হাসপাতালে গেলে পকেটে টাকা আরও বেশি নিয়ে যেতে হয়। স্কয়ারে মাথার এমআরআই করতে ১১ হাজার ৫০০ আর পুরো শরীরে করতে নেয়া হয় ৪৭ হাজার টাকা। অ্যাপোলো হাসপাতালে আবার মাথার জন্য সাড়ে ১১ হাজার নিলেও পুরো শরীরের জন্য কিছুটা কম নেয়া হয়, ৪৪ হাজার ৫০০ টাকা।

অর্থাৎ ঢাকা মেডিকেলের ছয় থেকে প্রায় ১৬ গুণ টাকা নিচ্ছে স্কয়ার, অ্যাপোলো। সরকারি হাসপাতালের চেয়ে বেসরকারিতে টাকা বেশি নেয়াটাই স্বাভাবিক, কিন্তু এত বেশি নেয়া যুক্তিযুক্ত কি না, এ নিয়ে সাধারণের মনে আছে প্রশ্ন।

চিকিৎসা ব্যয় নিয়ে বরাবরই চাপে থাকে মানুষ। সরকারি হাসপাতালে স্বল্পমূল্যে চিকিৎসা করানো গেলেও অল্প কিছু হাসপাতাল বাদে বাকিগুলোতে রোগ পরীক্ষায় নানা ভোগান্তিতে পড়তে হয়। সরকারের পাঠানো যন্ত্রপাতি ইচ্ছা করেই অচল করে রেখে রোগীদের বেসরকারি হাসপাতালে যেতে বাধ্য করার অভিযোগ পুরোনো। এর ফলে ১০ বা ২০ টাকায় টিকিট কেটে ডাক্তার দেখানো গেলেও রোগ পরীক্ষা করতে ঠিকই বেসরকারি চিকিৎসালয়ে যেতে হয় বহুজনকে।

আর বেসরকারি হাসপাতালে বহুগুণ টাকায় রোগ পরীক্ষা করানোর পরও সেগুলো কতটা মানসম্পন্ন তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। হরহামেশা ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে দেখা যায়, মানহীন বা মেয়াদোত্তীর্ণ রি-এজেন্ট নিয়ে হয় পরীক্ষা, কখনো কখনো চিকিৎসকের বদলে মেডিকেল টেকনোলজিস্ট দিয়ে পরীক্ষা করানোর প্রমাণ মিলেছে। এমনকি পরীক্ষা ছাড়াই প্রতিবেদন দেওয়ার প্রমাণ পাওয়ায় সম্প্রতি ঢাকার উত্তরার একটি নামি হাসপাতালকে ১৭ লাখ টাকা জরিমানাও করা হয়েছে।

এর মধ্যে ডেঙ্গু জ্বর বিস্তারের শুরুতে বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে ফির নৈরাজ্যের বিষয়টি নতুন করে সামনে আসার পর সরকার ঠিক করে দেয়। তবে নিয়মিত রোগ পরীক্ষার ক্ষেত্রেও হাসপাতালগুলো অতিরিক্ত মুনাফা করে গেলেও এ বিষয়ে এখনো কেন নীরব, তা নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন।

বেশ কিছু বেসরকারি হাসপাতাল ও রোগ পরীক্ষাগারে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কোন পরীক্ষার ফি সর্বোচ্চ কত হবে, এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো সিদ্ধান্ত নাই। আর হাসপাতালগুলো নিজেদের মর্জি অনুযায়ী ফি ঠিক করে থাকে। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান আবার এ থেকে নির্ধারিত হারে ছাড় দেওয়ার ঘোষণা নিয়ে কৃতিত্ব নেয়ার চেষ্টা করে।

প্রশ্ন উঠেছে, ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর তাৎক্ষণিকভাবে উদ্যোগী হয়ে সিদ্ধান্ত নিলেও অন্য রোগ পরীক্ষার ক্ষেত্রে কেন উদাসীন তারা।

অথচ ২০১৮ সালের ২৪ জুলাই এ বিষয়ে হাইকোর্টের একটি আদেশও আছে। একটি রিট আবেদনের পর বিচারপতি বি এম হাসান ও খায়রুল আলমের বেঞ্চ রোগ পরীক্ষার ফি নির্ধারণ এবং তার তালিকা টানাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে নির্দেশ দেয়। ১৫ দিনের মধ্যে এটি যেন কার্যকর হয়, সেটি নিশ্চিত করেত স্বাস্থ্য সচিব, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএমডিসিকে নির্দেশ দেওয়া হয় আদেশে।

কিন্তু ৪০০ দিনেও আসল না সেই ১৫ দিন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কী উদ্যোগ নিয়েছে সেটা জানা যাচ্ছে না। অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল) বলছেন, তারা এ নিয়ে কাজ করছেন।

হাসপাতাল ফির স্বেচ্ছাচার নিয়ে উচ্চ আদালতে রিট আবেদনটি করেছিলেন ‘হিউম্যান রাইটস ল ইয়ার্স অ্যান্ড সিকিউরিং এনভায়রনমেন্ট সোসাইটি অব বাংলাদেশ’ নামে একটি সংগঠনের কোষাধ্যক্ষ শাহ আলম। তার হয়ে আদালতে লড়েন বশির আহমেদ। ঢাকা টাইমসকে তিনি বলেন, ‘আজ এই মামলার ধার্য তারিখ রয়েছে। ওইদিন ফাইল দেখে বিস্তারিত বলতে পারব স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এতদিনে কী করেছে।’

জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বেসরকারি হাসপাতাল শাখার পরিচালক আমিনুল হাসান ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘এটা (ফি নির্ধারণ) নিয়ে এখনও পর্যন্ত কোন নীতিমালা নেই । তবে আমরা উদ্যোগ নিয়েছি। এটা নিয়ে কাজ করছি।’

তবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কনক কান্তি বড়ুয়া মনে করেন, এখানে নীতিমালার নামে কালক্ষেপণের দরকার নেই। তিনি বলেন, ‘হাইকোর্ট যখন আদেশ দিয়েছে সেটাই ফলো করা উচিত। আমরা কিন্তু সব পরীক্ষার মূল্য বোর্ড টানিয়ে রেখেছি। আর আমাদের এখানে স্বল্পমূল্যেই সব প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানো হয়।’

কোন হাসপাতালে কত ফি

সরকারি হাসপাতালে রক্তের সিবিসি পরীক্ষার জন্য ফি নেয়া হয় ১৫০ টাকা, আর ইউরিন আরই জন্য ২০ টাকা। ‘আলট্রাসনোগ্রাম হোল অ্যাবডোমেন’ এর জন্য নেয়া হয় ৩৫০ টাকা।

পপুলার হাসপাতালে রক্ত সিবিসির জন্য ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা, ইউরিন আরই ৩৫০ টাকা, আলট্রাসনোগ্রাম এক হাজার ২০০ টাকা নেয়।

ল্যাবএইডে সিবিসি ৪০০ টাকা, ইউরিন আরই ২৮০ টাকা, আলট্রাসনোগ্রাম দুই হাজার ২০ টাকা নেয়া হয়।

শমরিতা হাসপাতালে সিবিসি ৪০০ টাকা, ইউরিন আরই ২০০ টাকা, আলট্রাসনোগ্রামের জন্য দেড় হাজার টাকা নেয়া হয়।

স্কয়ার ও অ্যাপোলো হাসপাতালে সিবিসির জন্য ৪০০, ইউরিন আরই ২৫০ এবং আলট্রাসনোগ্রামের জন্য নেয়া হয় দুই হাজার ৪০০ টাকা।

অন্য হাসপাতালের চেয়ে ফি বেশি কেন- এমন প্রশ্নে স্কয়ারের ফ্রন্টডেস্ক কর্মকর্তা বলেন, ‘অন্য হাসপাতালের সাথে তুলনা করলে হবে না। আমাদের মেশিন ভালো, পরীক্ষার ফলাফলও সঠিক আসে। তাই খরচও একটু বেশি।’

স্কয়ারের মতোই একই যুক্তি দেখিয়েছেন অ্যাপোলোর ফ্রন্টডেস্ক কর্মকর্তাও। তিনি বলেন, ‘আমাদেরটি আন্তর্জাতিক মানের হাসপাতাল। অন্য হাসপাতালের সঙ্গে তুলনা করে লাভ আছে?’

তবে অভিজাত বলে পরিচিতি পেলেও একাধিকার বার এই দুই হাসপাতালে ভুল রোগ পরীক্ষা, ভুল চিকিৎসায় মৃত্যুর অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিশেষ করে অ্যাপোলোতে অভিযোগ বেশি। আর মেয়াদোত্তীর্ণ বা বেআইনি ওষুধ বেঁচে একাধিকবার জরিমানাও দিয়েছে অ্যাপোলো।

ঢাকাটাইমস/২৭আগস্ট/এএ/ডব্লিউবি