মহাশঙ্কা মহাজনি সুদ
প্রকাশ | ২৮ আগস্ট ২০১৯, ০৮:২৬
ব্যবসা শুরু করতে গিয়ে আর্থিক সংকটের কারণে বা পুঁজির অভাবে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের একটি বড় অংশকে এখনো মহজনি সুদের ওপর নির্ভর করতে হয়। মূলত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর শর্ত পূরণ করতে না পারায় তাদের বাধ্য হয়ে সহজ শর্তে উচ্চসুদে এ ধরনের কারবারিদের কাছ থেকে টাকা নিতে হয়। আর এই ঋণ নিয়ে কোনো কারণে নিয়মিত পরিশোধে ব্যর্থ হলে তৈরি হয় মহাশঙ্কা। ঋণের জাল ছিড়তে সহায়-সম্বল বেচে পথে বসতে হয়।
জাতিসংঘ অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের একটি জরিপে বলা হয়েছে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলসহ জেলা-উপজেলায় গড়ে ওঠা ছোট ছোট আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও সমিতির একটি বড় অংশ ব্যক্তিপর্যায়ে সুদের সঙ্গে জড়িত। সংস্থাটির জরিপে উচ্চ সুদে টাকা নেওয়ার মূল কারণ হিসেবে বলা হয়, সরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের ঋণ দেওয়ার অপ্রতুলতার কারণেই তারা ঝুঁকছে উচ্চ হারে সুদের দিকে।
কৃষিঋণ ও খাদ্যনীতির আন্তর্জাতিক পরামর্শক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (ইফপ্রি) প্রতিবেদনে দেখা গেছে, দাদন ব্যবসায়ী, আত্মীয়স্বজন, বেসরকারি সংস্থা (এনজিও), বেসরকারি ব্যাংকসহ বিভিন্ন বেসরকারি উৎস থেকে কৃষকরা ৮৩ শতাংশের বেশি ঋণ নেন। এসব ঋণের বড় অংশের সুদের হার বার্ষিক ৩৬ থেকে ১০০ শতাংশ। আর সরকারের কৃষি ব্যাংক কৃষকদের ৯ শতাংশ হার সুদে যে ঋণ দেয়, তা মোট ঋণের মাত্র ৬ শতাংশ কৃষক পেয়ে থাকেন।
সরকার ক্ষদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জীবনমান উন্নয়নে স্বল্প সুদে ঋণ প্রদানের কথা বলছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী সরকারি ব্যাংকগুলো কৃষিঋণের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ সুদ রাখা হয়। তবে এই হারে কৃষিঋণ পাচ্ছেন দেশের মোট কৃষকের মাত্র ৬ শতাংশ। আর বাকি ৯৪ ভাগ কৃষকের বেশির ভাগের ঋণের শেষ ভরসা ‘মহাজন’, সুদের কারবারি বা ব্যক্তি পর্যায়ে এনজিওর ঋণ। তাদের কাছ থেকে কৃষক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ঋণ নিতে হয় ব্যাংকের সুদহারের চেয়ে ৫-১১ গুণ বেশি সুদহারে, যা বার্ষিক হিসাবে আসলের শতভাগ ছাড়িয়ে যায়।
সম্প্রতি একটি খবরের সূত্র অনুসন্ধান করে জানা গেছে, সরকারি সুদের চেয়ে বার্ষিক ৪০ গুণ বেশি হারে একজন ঋণ গ্রহণ করেছেন। অর্থাৎ শতকরা হিসাবে বার্ষিক ৩৬০ শতাংশ হারে সুদে টাকা নিয়েছেন ওই ব্যক্তি। এ ধরনের সুদের টাকা পরিশোধ করতে গিয়ে সহায়-সম্বল হারিয়ে পথে বসে গেছেন এমন অনেক পরিবার।
আর প্রচলিত সুদের কারবারিরা প্রতি মাসে ১০ বা ১৫ শতাংশ সুদ নিয়ে থাকে ঋণগ্রহণকারীর কাছ থেকে। এর অর্থ হলো, বছরে ১২০ বা ১৫০ শতাংশ হারে সুদ দিতে হচ্ছে। কেউ যদি ১০ হাজার টাকা ঋণ নেয় তাকে মাত্র এক বছর পর আসল ১০ হাজার টাকা এবং অতিরিক্ত ১২ বা ১৫ হাজার টাকা সুদ দিতে হবে। অর্থাৎ ১০ হাজার টাক নিলে মোট ২২ বা ২৫ হাজার টাকা পরিশোধ করতে হয়। এক লাখ টাকা নিলে বছর শেষে এক লাখ ২০ হাজার টাকা সুদসহ মোট দুই লাখ ২০ হাজার টাকা ঋণদাতাকে দিতে হবে। অনেকে এত টাকা ফেরত দিতে পারে না। ফলে তারা নিজেদের সামান্য সম্বলটুকু বিক্রি করে ঋণের জাল থেকে বেরিয়ে আসে।
রাজধানীর খিলগাঁও বাজারের মুদি ব্যবসায়ী চান মিয়া। গত মাসে দোকানের মাল কেনার জন্য একটি এনজিও থেকে ১ লাখ টাকা নিয়েছেন। প্রতিদিন কিস্তি পরিশোধ করছেন ৭২২ টাকা। এভাবে ছয় মাসে পুরো টাকা পরিশোধ করতে হবে তাকে। কোনো কিস্তি বকেয়া না করে মোট ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা পরিশোধ করবেন তিনি।
এই ব্যবসায়ীর ঋণের সুদ হিসাব করে দেখা যায়, তাকে বার্ষিক ৬০ শতাংশ সুদ দিতে হচ্ছে, যা সরকারি ব্যাংকের চেয়ে অন্তত ৭ গুণ বেশি।
এত উচ্চহারে সুদ নিয়ে পোষায়? জানতে চাইলে ঢাকা টাইমসকে চান মিয়ার ভাষ্য, তারা বাধ্য হয়ে এই ধরনের ঋণের উ’সের কাছে যান। তিনি বলেন, ‘আমাদের তো কেউ টাকা ধার দেয় না। কী করব! তাছাড়া আমরা বড় ব্যবসায়ীও না।’
কমলপুর কলোনি বাজারের মোকাররম হোসেন নামের এক চালের ব্যবসায়ী ১ লাখ টাকা নিয়েছেন বন্ধু সমিতির কাছ থেকে। প্রতি মাসে তাদের সুদ দেন ৫ হাজার টাকা। কোনো মাসে দিতে না পারলে পরের মাসে এক হাজার টাকা বেশি দিতে হয়। আর আসলের পুরোটা পরিশোধ করতে হবে এক বছরের মধ্যে। তিনি জানান, ১ লাখ টাকা সুদে-আসলে এক বছরে তাকে দিতে হবে ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা।’ তাকে আসলের অর্ধেকের বেশি সুদ দিতে হবে এক বছরে।
নওগাঁর মাছ চাষি আপেল মাহমুদের ঋণের সুদহার আরও ভয়াবহ। ঋণের জালে জড়িয়ে এক বছরের মাথায় পাঁচ বিঘা জমি বিক্রি এ থেকে মুক্ত হয়েছেন তিনি। এ ঘটনায় তিনি পত্রিকায় খবরের শিরোনাম হয়েছেন।
মহাদেবপুর উপজেলার চেরাগপুর ইউনিয়নের অর্জুন গ্রামের এই ব্যবসায়ী এক বছর আগে দাদন ব্যবসায়ী বিপ্লবের কাছ থেকে ৫ লাখ টাকা নেন। ৫ লাখে মাসে দেড় লাখ টাকা সুদ দেন তিনি। একদিকে ব্যবসায় লোকসান অন্যদিকে দাদনদার; এক বছরের মাথায় পাঁচ বিঘা ফসলি জমি বিক্রি করে সুদে আসলে ১৫ লাখ টাকা শোধ করেন। খবরে বলা হয়, আপেলের মতো নওগাঁর অনেক সাধারণ মানুষ এমন উচ্চ হারে সুদের জের টেনে সর্বস্বান্ত হয়েছে।
গ্রামীণ পর্যায়ে উচ্চহারে মহাজনি সুদ যারা নিচ্ছেন, তাদের বেশির ভাগ ব্যবসা ও লাভের বিষয়ে অনভিজ্ঞ কিংবা অসচেতন বলে মনে করেন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক মোহাম্মদ ইফতেখার হোসেন। এ ধারা চালু থাকার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, উচ্চহারে যে ঋণ নেওয়া হয় তাতে ব্যবসায় লাভবান হওয়ার চেয়ে বেশির ভাগই ক্ষতিগ্রস্ত হন। আর এদের বেশির ভাগই সুদের হারটা অনুমান করতে পারেন না। বা পরিণতির কথা ভাবেন না। ফলে উচ্চহারে সুদ নেন।’
মোহাম্মদ ইফতেখার হোসেন আরও বলেন, ‘১ লাখ টাকায় যিনি মাসিক ৩০ হাজার টাকা নেন, তিনি নিশ্চয়ই ব্যবসয়ী নন। লাখ টাকায় ৩০ হাজার টাকা সুদ দিলে তিন মাসের সুদই হয়ে যায় মূল টাকার সমান। তাহলে এই টাকা দিয়ে ঋণগ্রহিতা লাভ করবে কত?’
এ ক্ষেত্রে আমাদের ব্যাংকিং খাতের কোনো দুর্বলতা আছে কি না জানতে চাইলে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ওই শিক্ষক বলেন, ‘আমাদের অর্থনীতি মাত্রই দাঁড়াতে শুরু করেছে। সব ক্ষেত্রে গ্রামেগঞ্জে ক্ষুদ্র উদ্যোক্ত বা কৃষিকাজে ঋণ সেভাবে এখনো ভালো জায়গায় যায়নি। এ ক্ষেত্রে ডাটাবেজ নেই। সরকারি টাকা দেওয়ার ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের মধ্যে উৎসাহ নেই। এমন অভিজ্ঞতা অনেক সময় ব্যাংকগুলোর আছে। ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্বলতা কাটিয়ে উঠবে ব্যাংকিং সেক্টরও।’
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) ‘বাংলাদেশের আর্থিক বাজার উন্নয়ন এবং চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে একটি তথ্য প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়, প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাংলাদেশে অনেক বেশি। উচ্চ ঋণের সুদের কারণে বিনিয়োগ এবং অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। ব্যাংকিং খাতে সুশাসন নিশ্চিত করতে না পারায় এর প্রভাব পড়েছে প্রান্তিক পর্যায়েও।
বাংলাদেশে গত একবছরের বেশি সময় ধরে ব্যাংক ঋণের সুদের হার বেড়ে চলেছে। সরকারি তাগিদ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের নানা ছাড়ের পরেও এই অবস্থার কোন পরিবর্তন হয়নি। ২০১৭ সালেও যেখানে ব্যাংকগুলো একক সংখ্যায়, অর্থাৎ ৯ শতাংশ হারে ঋণের সুদ গ্রহণ করতো, ২০১৮ সালের পর থেকে সেই হার এখন ব্যাংক ভেদে ১২ থেকে ১৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
ছোট ঋণের বড় সুদ!
১০০ টাকা ঋণ দিয়ে বছরে এনজিওগুলোর সুদ ২৭ টাকা, এতে সুদের হার পড়ছে প্রায় ২৭ শতাংশ। কোনো কোনে ক্ষেত্রে ৩৭ শতাংশ সুদ আদায়ের রেকর্ড আছে। এভাবেই পরিচালিত হচ্ছে এনজিওসহ বিভিন্ন সংস্থার ক্ষুদ্র ঋণ। এ খাতের সুদ এখনো ব্যাংকের চেয়ে বেশি। এনজিওগুলোর দাবি তাদের তহবিল ব্যবস্থাপনায় ব্যয় অনেক বেশি। যে কারণে ব্যাংকের স্বাভাবিক ঋণের তুলনায় ক্ষুদ্র ঋণে সুদের হার অনেক বেশি। সূত্রমতে, ১০০ টাকা ঋণ দিয়ে বছরে ২৭ টাকা সুদ নিচ্ছে এনজিওগুলো। ওই হিসেবে ক্ষুদ্র ঋণের সুদের হার পড়ছে প্রায় ২৭ শতাংশ। যেখানে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ৯ থেকে ১০ শতাংশ সুদে ঋণ দিচ্ছে। ২০১০ সালে প্রথমবারের মতো ক্ষুদ্র ঋণের সুদের হার সর্বোচ্চ ২৭ শতাংশ নির্ধারণ করে এ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা।