আমেরিকায় দারিদ্র্যের না বলা গল্প

প্রকাশ | ৩০ আগস্ট ২০১৯, ০৯:০৪

সুলতানা রহমান

তিন সন্তান নিয়ে এসেছেন আমাদের নতুন প্রতিবেশি। গেল ঈদের পর পাশের বাসার একটি বেইসমেন্ট ভাড়া নিয়েছেন। নিউইয়র্ক এসেছেন আরও মাস খানেক আগে। পারিবারিক সূত্রে অভিবাসী হয়েছেন। আলাপের শুরুতে হাস্যোজ্জ্বল থাকলেও কথায় কথায় একটু পর কেঁদে দিলেন। তিন শিশু সন্তান নিয়ে আমেরিকা এসে কি যে বিপদে পড়েছেন তা বলতে গিয়ে তার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে এলো।

বললেন, তিনি এবং তার স্বামী রোজা আছেন, কিন্তু ছেলেমেয়েগুলো তিনবেলা খাবার চায়। দিতে পারেন না! শুধু ডালভাতও তারা খেতে চায় না।

নিউইয়র্ক আসার পর মাসখানেক ভাসুরের বাসায় থাকার পর বিদায় নিতে হয়েছে। ভাসুর জানিয়ে দিয়েছে নিজেদের জীবন নিজেদের গড়ে নিতে। এরপর বেইসমেন্টে ১২০০ ডলার ভাড়া দিয়ে উঠে যান। স্বামী একটি রেস্টুরেন্টে কাজ নিয়েছেন। সপ্তাহে চার শ ডলার মানে মাসে ১৬ শ ডলার আয়। বাসা ভাড়া ১২০০ ডলার, ইলেক্ট্রিসিটি মোবাইল বিলসহ খরচ আছে এক শ ডলার। যাতায়াতের জন্য মেট্রোকার্ড ১২০ ডলার। তারপর মাত্র দুই শ ডলারে তিনি আর কোনও কিছুর হিসেব মেলাতে পারেন না।

নিউ ইয়র্কে এখন মিনিমাম ওয়েজ ঘণ্টায় ১৫ ডলার। তাহলে আট ঘণ্টা কাজ করলে সপ্তাহে ৪০ ঘণ্টা কাজ করে মাসে পাওয়ার কথা ২৪০০ ডলার। এই হিসেব বলতেই তিনি জানান-প্রত্যেক চেকে ট্যাক্স কেটে নেয় প্রায় ১৮০ ডলার। আমি অংকে বরাবরই কাঁচা। হিসেব মেলাতে পারি না।

বললাম-আপনি তো বাসায়ই থাকেন, ছেলেমেয়ের দেখাশুনা করেন, স্বামীকে বলেন দুইটা কাজ করতে। বললেন- অত পরিশ্রম করে অভ্যাস নাই, আরও শ্রম দিলে বাঁচতো না!

ভদ্রমহিলা বললেন-আমাকে কোনও বাসাবাড়ির কাজ দিতে পারেন? যেকোনও কাজ...ঘর ঝাড়ামোছা, রান্নাবান্না, কাপড় ধোঁয়া...আমি সব পারি।! সামান্য কিছু টাকা পয়সা যা পারেন দিয়েন।!

একটা মানুষ তারা সারাজীবনের সব কিছু ফেলে রেখে আসে নিজ দেশে। প্লেনে ওঠে দুই হাতে দুটি স্যুট কেস নিয়ে। নতুন যে দেশে আসে সেই দেশে আক্ষরিক অর্থেই তার সূতাটিও থাকে না। ধূ ধূ শূন্যতা নিয়ে জীবন শুরু করে। এসময়ই তার সাহায্য প্রয়োজন হয়। আর্থিক সাহায্য, মানসিক সাহায্য। আমেরিকার সোশ্যাল সেফটি নেট মূলত এমন ভালনারেবল মানুষদের জন্যই। ফুড স্ট্যাম্প, চিকিৎসা ব্যয়, বাড়ি ভাড়া এসবই আছে নতুন অভিবাসীদের জন্যও। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আগামী অক্টোবর থেকে এসব বন্ধ করার উদ্যোগ নিয়েছেন।

আমার প্রতিবেশি তিন সন্তানের মা হয়তো তিন বছর পর তার এই দুসহ জীবনের গল্প বলবেন গর্বিতভাবে। তার হয়তো তখন সবই থাকবে। কিন্তু বিদেশের অচেনা অজানা পরিবেশে তার এই জীবন যুদ্ধের শুরুতে থাকার কথা সামাজিক নিরাপত্তা বলয়।

প্রশ্ন হচ্ছে এই নিরাপত্তা বলয় ডোনাল্ড ট্রাম্প বন্ধ করতে চাচ্ছেন কেন? উত্তরটা খুব সহজ। তার যে সমর্থক গোষ্ঠী রয়েছে তাদের খুশি রাখা। ২০২০ নির্বাচনে জয় লাভ করা।

প্রশ্ন আরও আছে। অনেকে মনে করে-আমেরিকা মানে কোনও কাজ না করে বিনা শ্রমে বসে বসে খাওয়ার জায়গা! সক্ষমতা থাকা সত্বেও অনেকে সামাজিক নিরাপত্তামূলক কর্মসূচিগুলোর এতো অপব্যবহার করে যে অনেকেই মনে করছে অভিবাসিরা দেশের জন্য বোঝা। এ অভিযোগ একেবারে অসত্য নয়। কিন্তু এ ও অসত্য নয়-হাজারটা অপরাধী যদি পার পেয়েও যায় তবু যেনো কোনও নিরাপরাধী সাজা না পায়!

সক্ষমতা থাকা সত্বেও কারা ওইসব সামাজিক সুযোগ সুবিধার অপব্যবহার করছে তাদের কিভাবে শাস্তির আওতায় আনা যায় কিংবা কোন ফাঁক ফোকর গলে তারা সুযোগ সন্ধানী হচ্ছে তা খুঁজে না দেখে, সিস্টেমকে জোরালো না করে সিস্টেমটাকেই বাতিল করা মাথাব্যথার জন্য মাথা কেটে ফেলার সমান।

লেখক: সাংবাদিক, আমেরিকা প্রবাসী।