পদ্মার ভাঙনে ‘পাল্টে যাচ্ছে’ উপজেলার মানচিত্র

এম মনিরুজ্জামান, রাজবাড়ী
| আপডেট : ৩১ আগস্ট ২০১৯, ১০:৩৫ | প্রকাশিত : ৩১ আগস্ট ২০১৯, ১০:৩৩

রাজবাড়ীর কালুখালী ও গোয়ালন্দ উপজেলায় পদ্মা নদীর তীব্র স্রোতের কারণে ভয়াবহ ভাঙন দেখা দিয়েছে। ভাঙনে একের পর এক বিলীন হচ্ছে ঘরবাড়িসহ ফসলি জমি। নদীর স্র্রোত বৃদ্ধির সঙ্গে ভাঙন দেখা দিয়েছে কালুখালি উপজেলার রতনদিয়া, কালিকাপুর এবং গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়া ও দেবগ্রাম ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি স্থানে। নতুন করে পানি ও স্রোত বৃদ্ধির সঙ্গে ভাঙন দেখা দেওয়ায় কালুখালী ও গোয়ালন্দ উপজেলার মানচিত্র পাল্টে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।

গত কয়েকদিনে পদ্মার ভাঙনে রতনদিয়া, কালিকাপুর ও দৌলতদিয়ার ধল্লাপাড়া ও দেবগ্রামের কাউয়াজানির মুন্সিপাড়াসহ ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থানে শত শত একর ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। ভাঙন আতঙ্কে রয়েছে রাস্তা-ঘাট, বাজার, কবর স্থান, স্কুল, ক্লিনিক, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও শত শত বসতবাড়ি।

গতকাল শুক্রবার কালুখালীর রতনদিয়া ইউনিয়নের পশ্চিম হরিনবাড়িয়া, লস্করদিয়া, কলসতলা, চররাজপুর, কৃষ্ণনগর ও রানীনগর এলাকায় ঘুরে কথা হয় ভাঙন কবলিত এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে। কথা হয় গোয়ালন্দ উপজেলার বেশ কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গেও।

জানা গেছে, গোয়ালন্দ উপজেলা চারটি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত। যার তিনটিই ভাঙন কবলিত। গত কয়েকদিনে পদ্মার তীব্র স্রোতে ব্যাপক ভাঙন শুরু হয়েছে। পানির তোড়ে শত শত একর ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। আরও ভাঙনের হুমকিতে রয়েছে অনেক জমি। জরুরি ভিত্তিতে স্থায়ী ব্যবস্থা না নিলে ভাঙনে ছোট হয়ে যাবে উপজেলাটির মানচিত্র।

ইতোমধ্যে দুই উপজেলার দৌলতদিয়া, দেবগ্রাম রতনদিয়া ও কালিকাপুর ইউনিয়নের প্রায় অর্ধেক অংশ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। বাকি অংশও দিন দিন ভাঙনে ছোট হয়ে আসছে। এতে কমছে ইউনিয়নের পরিধি।

ভাঙন কবলিত এলাকার মানুষ জানান, নদীতে ফসলি জমি ও ঘরবাড়ি ভেঙে গেলেও কেউ তাদের খোঁজ রাখছেন না। ফলে আনাহারে অর্ধহারে তাদের দিন কাটছে। পুনর্বাসন ব্যবস্থা না থাকায় ভাঙন কবলিত অনেকে খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবন যাপন করছে।

কৃষ্ণনগর মৌজার জলিল শিকদার (৭৫) জানান, চাষের জমি, ভিটামাটি, খাবার সব গ্রাস করে নিয়ে গেছে সর্বনাশা পদ্মা। আমাদের এসব খবর কেউ রাখে না।

পশ্চিম হরিনবাড়িয়ার অখিল মন্ডল (৭০) জানান, পদ্মার স্রোতে তার ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এখন থাকার জায়গাটুকুও ভাঙনের মুখে। যেকোনো সময় এটিও নদীর পেটে চলে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন।

অখিল মন্ডল বলেন, শুনেছি নদী ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য সরকার থেকে প্রচুর সাহায্য সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে। কোথায় যাচ্ছে সে সাহায্য। আমি তো কিছুই পেলাম না।

নদীতে ঘরবাড়ি ভেঙে নেওয়া লস্করদিয়া নারায়নপুর মৌজার বেদানা বেগম শখ করে পোষা গৃহপালিত পশুপাখির নিরাপদ আবাস সন্ধান করছিল। তিনি জানান, দুই দিন কিছুই খাননি। ঘরের সঞ্চিত খাদ্য, থালাবাটি সব নিয়ে গেছে সর্বনাশা পদ্মা।

একই অবস্থা ওই গ্রামের বিল্লাল ফকিরের। তার দূরাবস্থার কথা তুলে ধরে বিল্লাল কেঁদে ফেললেন। বিল্লাল জানালেন, তিনি পেশায় মৎস্যজীবী। সরকার কালুখালীর শত শত মৎস্যজীবীকে সাহায্য সহযোগিতা করেন, অথচ তাদের অনেকে ভুয়া। কিন্তু তার মতো প্রকৃত মৎস্যজীবীর ভাগ্যে কিছুই জোটেনি। পদ্মায় বিল্লালের ঘরবাড়ি সব গ্রাস করেছে। সব হারিয়ে অনাহারে দিন কাটাচ্ছে বিল্লাল। ওই এলাকার জনাব আলী, আকবর আলী, হবিবর রহমান, বাবলুর অবস্থাও একই।

এলাকাবাসী ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, এখনই ভাঙন রোধ করা না গেলে সামনে আরও কঠিন পরিস্থিতি হতে পারে। তারা জানান, সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে দৌলতদিয়া লঞ্চ ও ফেরিঘাট। ভাঙন রোধে পানি উন্নয়ন বোর্ড বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলার কাজ শুরু করলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই কম বলে অভিযোগ তাদের।

এদিকে ভাঙন ঠেকাতে পানি উন্নয়ন বোর্ড ৬০ লাখ টাকা ব্যয়ে দুটি প্যাকেজের মাধ্যমে ১২ হাজার ৮০০ জিও ব্যাগ ফেলার কাজ শুরু করেছে। তবে ভাঙন এলাকায় প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত কম জিও ব্যাগ ফেলা হচ্ছে।

স্থানীয়রা বলেন, তাদের অনেকের বাড়ি এখন পর্যন্ত দুই থেকে ছয়বার নদীতে ভেঙেছে। এখন তারা দিশেহারা। নতুন করে আবার ভাঙলে কোথায় যাবেন। ভাঙন ঠেকাতে বালুর বস্তা ফেলা শুরু হয়েছে, কিন্তু লাভ কী? ভাঙছে অনেক জায়গায়, আর বস্তা ফেলা হচ্ছে দু-একটি জায়গায়। এছাড়া যে পরিমাণ বস্তা ফেলা দরকার সে পরিমাণ ফেলা হচ্ছে না। এভাবে ভাঙন ঠেকানো যাবে না। তারা ভাঙন ঠেকাতে এবং স্থায়ীভাবে নদী শাসনের জন্য স্থানীয় সাংসদসহ প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন।

গোয়ালন্দ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও দৌলতদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মো. নুরুল ইসলাম মন্ডল বলেন, ভাঙন ঠেকাতে কাজ শুরু হয়েছে, কিন্তু তা প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত কম। ভাঙন ঠেকাতে বেশি বেশি জিও ব্যাগ ফেলতে হবে। ভাঙনে দিন দিন ছোট হয়ে আসছে উপজেলার মানচিত্র। তাই এখনই স্থায়ীভাবে নদী শাসন হওয়া প্রয়োজন।

গোয়ালন্দ উপজেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. আরিফ সরকার বলেন, উপজেলার দৌলতদিয়া ও দেবগ্রাম ইউনিয়নে নদী ভাঙন শুরু হয়েছে। সেই ভাঙন রোধে ২৭ আগস্ট থেকে পানি উন্নয়ন বোর্ড ৬০ লাখ টাকা ব্যয়ে দুইটি প্যাকেজের মাধ্যমে জরুরি আপদকালীন প্রতিরক্ষামূলক কাজ শুরু করেছে। দুইটি প্যাকেজে প্রায় ১২ হাজার ৮০০ জিও ব্যাগ ফেলা হবে।

ঢাকাটাইমস/৩১আগস্ট/প্রতিনিধি/এমআর

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :