বাস ভাড়া বাড়ানোর প্রস্তাবে তথ্য গোপন

খরচ বৃদ্ধির অজুহাতে আবেদনে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের তথ্য নেই; যত বার ভাড়া নির্ধারণ হয়েছে, তা কখনো মানেনি বাস মালিকরা; নানা কৌশলে নির্ধারিত ভাড়ার দ্বিগুণ বা তারও বেশি আদায়

কাজী রফিক, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ৩১ আগস্ট ২০১৯, ১৩:৫৭ | প্রকাশিত : ৩১ আগস্ট ২০১৯, ১৩:৫৩
ফাইল ছবি

জ্বালানি খরচ বৃদ্ধি আর যন্ত্রাংশের দাম বাড়ার কথা বলে বাস ভাড়া বাড়ানোর যে প্রস্তাব করেছেন বাসমালিকরা, তাতে তথ্য গোপনের অভিযোগ উঠেছে। সরকার চার বছর আগে সবশেষ ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীর যে ভাড়া নির্ধারণ করেছিল, দিনে দিনে এমনিতেই যে তার চেয়ে দ্বিগুণের বেশি আদায় করা হচ্ছে, সেই কথাটি উল্লেখ করা হয়নি।

প্রশ্ন উঠেছে, নিয়ন্ত্রক সংস্থা কখনো ভাড়া ঠিক করে দিয়েও যেখানে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি বিআরটিএ, সেখানে ভাড়া নতুন করে নির্ধারণ করে আরেক দফা বাড়িয়ে দেওয়ার কাজ কেন করতে যাচ্ছে তারা?

সরকার যতবার ভাড়া ঠিক করে দেয়, প্রতিবারই দেখা গেছে বাসগুলোতে এর চেয়ে বেশি হারে ভাড়া আদায় করা হয়। প্রতিটি বাসে শতকরা ৮০ শতাংশ আসনে যাত্রী ধরে- ভাড়া নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু মহানগরীগুলোতে দিনের সিংহভাগ সময়েই আসনের চেয়ে বেশি এমনকি ঠাসাঠাসি করে যাত্রী নিয়ে থাকে বাসগুলো।

আবার সরকার ছোট বাসের ক্ষেত্রে সর্বনি¤œ ভাড়া পাঁচ আর বড় বাসের ক্ষেত্রে সাত টাকা ঠিক করে দিলেও বাসে উঠলেই কোথাও সর্বনি¤œ দিতে হয় ১০, কোথাও ১৫, কোথাও বা ২০ টাকা।

এর বাইরে প্রতিটি স্টপেজে দাঁড়ালেও ‘সিটিং’-এর নামে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় নিয়মিত প্রবণতা হয়ে উঠেছে। ইদানীং শুরু হয়েছে ওয়েবিল যন্ত্রণা। একটি নির্দিষ্ট পথে যত দূর যাত্রী যাবেন, তার চেয়ে বেশি পথের ভাড়া আদায়ে এই কৌশল ঠিক করা হয়েছে।

মিরপুর, মোহাম্মদপুর, সাভার বা উত্তরা থেকে আসা বাসগুলো কারওয়ানবাজারের পরে কোনো স্টপেজে যাত্রী নামালে তার কাছ থেকে আদায় করছে গুলিস্তান বা মতিঝিল বা সায়দাবাদের ভাড়া। একই পরিস্থিতি অন্যান্য রুটেও। মহাখালী হয়ে সাত রাস্তা দিয়ে চলা বাসগুলোও সাতরাস্তার পর যেখানেই যাত্রী নামুক, তার কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে গুলিস্তান, যাত্রাবাড়ী বা সায়েদাবাদের ভাড়া।

২০১৫ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর সবশেষ ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরে জন্য বাস ভাড়া নির্ধারণ করে বিআরটিএ। তখন বড় বাসে কিলোমিটার প্রতি এক টাকা ৭০ পয়সা আর মিনিবাসে ১ টাকা ৬০ পয়সা ভাড়া নির্ধারণ করা হয়। নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, মুন্সিগঞ্জ, গাজীপুর, মানিকগঞ্জ ও ঢাকা জেলার বিভিন্ন রুটের জন্য এই ভাড়া কার্যকর।

এর আগে ২০১৩ সালে দূরপাল্লার বাসের ভাড়া নির্ধারণ হয় ১ টাকা ৪৫ পয়সা। আর ডিজেলের দাম কমায় ২০১৬ সালের ৩ মে দূরপাল্লায় ডিজেলচালিত বাস ভাড়া কিলোমিটার প্রতি ৩ পয়সা কমিয়ে করা হয় এক টাকা ৪২ পয়সা। যদিও তখন এক পয়সাও ভাড়া কমেনি।

অতিরিক্ত আদায়ের কৌশলের শেষ নেই

পরিবহন কোম্পানিগুলো যাত্রীদের পকেট কাটতে যে কৌশল নেয় সেটা হলো, যাত্রা শুরু এবং শেষ অবধি যে পথের দূরত্ব, সেটার ভাড়া ঠিক রেখে মাঝের পথে অতিরিক্ত আদায় করতে থাকে।

কিন্তু সিটিং, ওয়েবিল আর ‘ঝাওয়ালীর’ (ডায়রেক্ট) যন্ত্রণায় মাঝপথের যাত্রীরা অতিষ্ঠ। মোহাম্মদপুর এলাকায় সকালে অফিসগামী এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগামী যাত্রীদের থেকে বাড়তি ভাড়া আদায়ে এই ঝাওয়ালী (ডায়রেক্ট) সার্ভিস দেখা যায়। বাসে উঠলেই দূরত্ব যাই হোক না কেন ভাড়া গুনতে হচ্ছে ২০ টাকা।

বিমা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত জালাল হোসেন ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘মোহাম্মদপুর থেকে মতিঝিলের ভাড়া ২০ টাকা। কিন্তু সকালে এরা ডাইরেক্ট সার্ভিস শুরু করে। তখন মোহাম্মদপুর থেকে সিটি কলেজ গেলেও ২০ টাকা ভাড়া দিতে হচ্ছে। এটা তো আমাদের উপর জুলুম।’

একই চিত্র দেখা গেছে রাজধানীর মিরপুরসহ বিভিন্ন এলাকায়। কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছানোর তাগিদে বাড়তি ভাড়া গুনতে বাধ্য হচ্ছেন যাত্রীরা।

বৈধতা না থাকলেও ওয়েবিলেও শুরুতে যে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছিল, সেটাও বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। মোহাম্মদপুর থেকে ডেমরা স্টাফ কোয়াটার রুটে চলাচলকারী স্বাধীন পরিবহন। এক ওয়েবিল থেকে অপর ওয়েবিল পর্যন্ত ভাড়া ১০ টাকা নির্ধারণ করা হলেও সে নিয়মও মানছে না এই বাস। মোহাম্মদপুর থেকে বাংলামোটর পর্যন্ত ভাড়া আদায় করা হয় ১৫ টাকা। যদিও এই দূরত্বের মধ্যে এই বাসের ওয়েবিল চেক মাত্র একটি।

আসাদগেট থেকে বাংলামোটরের নিয়মিত যাত্রী ইমরান হোসেন। ঢাকাটাইমসকে তিনি বলেন, ‘আসাদগেট থেকে উঠি বাংলামোটর নামি, ভাড়া ১৫ টাকা। কিন্তু এখানে ওয়েবিল একটা। ওয়েবিলে পাঁচ টাকা তো কোনো ভাড়াই নাই। তাও তারা নিচ্ছে, আমরাও দিতে বাধ্য হচ্ছি।’

মোহাম্মদপুর রিংরোডের জাপান গার্ডেন থেকে উত্তরা আব্দুল্লাহপুর পর্যন্ত চলাচল করে ভূঁইয়া পরিবহন। রুটের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দূরত্ব ১৯ কিলোমিটার। সে হিসেবে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ভাড়া হওয়ার কথা ৩২ টাকা। কিন্তু ওয়েবিলের নামে এখানে ভাড়া আদায় করা হয় ৪৫ টাকা।

যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই রুটে চলাচলকারী অধিকাংশ বাসের ভাড়াই বেশি। আবার ভাড়ার তুললায় যাত্রী সেবার মান অতি নগণ্য।

নিয়মিত যাত্রী নীলিমা মান্নান ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘এমনতেই পুরো রাস্তায় ভাড়া বেশি। সব জায়গা থেকে যাত্রী তুলছে। ইচ্ছে মতো দাঁড়িয়ে থাকছে। দাঁড় করিয়ে যাত্রী নিচ্ছে। একটা যাচ্ছেতাই অবস্থা। আবার দেখেন, শ্যামলী থেকে শিয়া মসজিদ পর্যন্ত তারা ভাড়া নিচ্ছে ১৫ টাকা। এইটুকু রাস্তায় রিকশা ভাড়াই তো ২০ টাকা। সেখানে বাস ভাড়া ১৫ টাকা হয় কীভাবে?’

চিঠিতে যে যুক্তি

গত ৬ জুলাই বিআরটিএতে খন্দকার এনায়েত স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, ‘এ বছরের ১ জুলাই থেকে সিএনজির দাম প্রতি ঘনমিটারে ৩৮ টাকা থেকে ৫ টাকা বাড়িয়ে ৪৩ টাকা করা হয়। এ কারণে যানবাহনের পরিচালনা ব্যয় সাড়ে ৭ শতাংশ বেড়ে গেছে। ঢাকা ও আশপাশের জেলায় চলাচলকারী বাস-মিনিবাসের ৪০ শতাংশ সিএনজিতে চলে। সিএনজিচালিত বাসের ভাড়া সবশেষ ২০১৫ সালে পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছিল। এছাড়া গত ৪ বছর ধরে ডিজেলচালিত বাসের ভাড়াও বাড়ানো হয়নি।’

‘বিগত অর্থবছরগুলোর বাজেটে গাড়ির টায়ার-টিউব, খুচরা যন্ত্রাংশের আমদানি শুল্ক বহুগুণ বেড়েছে, এতে গাড়ির পরিচালন ব্যয়ও বেড়েছে। এ কারণে সারাদেশের পরিবহন মালিকরা ভীষণ ক্ষতির মুখে পড়েছেন।’

এই আবেদনের পর গত ২৬ আগস্ট বিআরটিএর প্রধান কার্যালয়ে বৈঠকও হয়েছে। সেখানে বাজার যাচাই করার সিদ্ধান্ত হয়।

বিআরটিএর চেয়ারম্যান মশিয়ার রহমান এ বিষয়ে বলেন, ‘আমরা আগে দেখব, তারা যে দাবি করছেন, তা যৌক্তিক কি না। মিটিংয়ে আমরা তাদের বলেছি বাজারে একটা টিম পাঠাতে। আমরাও একটা টিম পাঠাব বাজার যাচাই করতে। যাচাইয়ের পর মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেব।’

‘যদি মনে হয় যে ভাড়া বাড়ানোর প্রয়োজন আছে, সেটাও আমরা মন্ত্রণালয়কে জানাব। যদি মনে হয় ভাড়া বাড়ানোর প্রয়োজন নেই সেটাও জানাব।’

যাত্রীদের মতামত ‘উপেক্ষা’

যাত্রীদের অধিকার নিয়ে সোচ্চার যাত্রীকল্যাণ সমিতি মনে করে, ভাড়া বৃদ্ধির বিষয়ে যাত্রীদের মতামত গ্রহণ জরুরি। কিন্তু সরকার ভাড়া বৃদ্ধির বিষয়ে কেবলে বাস মালিক এবং শ্রমিকদের সাথেই আলোচনা করছে, কিন্তু যাত্রী প্রতিনিধিনের সম্পৃক্ত করছে না।

সংগঠনের মহাসচিব মোজাম্মেল হক ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘ভাড়া নির্ধারণ যারা করে থাকেন (বাস মালিক সমিতি) তারা এটিকে বাস্তবায়ন করতে পারেন না। আমরা অনেক ক্ষেত্রে লক্ষ করি, নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে দুই- তিন গুণ বেশি ভাড়া আদায় করা হয়। ভাড়া নির্ধরণের যে সাংগঠনিক নিয়ম সেটা হচ্ছে বাস মালিক, শ্রমিক এবং যাত্রী সবার অংশগ্রহণে হবে। কিন্তু সেটা করা হয় না।’

‘২০১৫ সালের পর থেকে আমরা যেটা দেখি, ভাড়া নির্ধারণ করা হয় মালিক এবং শ্রমিকদের নিয়ে। সেখানে যাত্রীদের কোনো অংশগ্রহণ থাকে না। যার ফলে জনগণের বিষয়টি সরকারের নজরে আসে না। আমরা আশা করব, ভাড়া নির্ধারণের ক্ষেত্রে সরকার মালিক এবং শ্রমিকদের পাশাপাশি জনগণের অংশগ্রহণটাও নিশ্চিত করবে।’

এ বিষয়ে জানতে বাস মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি সময় দিতে পারেননি। ব্যস্ততার কারণে পরে যোগাযোগ করতে বলে তিনি ফোন কেটে দেন। পরে কল করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।

ঢাকাটাইমস/৩১আগস্ট/কারই/ডব্লিউবি

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিশেষ প্রতিবেদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :