মানব প্রেম ও স্বশিক্ষা

মো. রিয়াজুল ইসলাম
 | প্রকাশিত : ০১ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১৪:৫৫

মানুষের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা, ভক্তি ও নমনীয়তার মধ্যেই লুকায়িত রয়েছে মানব প্রেম। প্রেম নিয়ে কত শত গল্প, কাহিনি, ইতিহাস লেখা হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই, কিন্তু সব প্রেমের সার্থক মিলন মানুষের প্রতি সহমর্মিতায় প্রকাশ পায়। যে ব্যক্তির হৃদয় অভাবী, অসহায়, নিঃস্ব, এতিম ও দুর্বলকে দেখে আপ্লুত হয় না, কষ্টে চিত্ত ব্যথিত হয় না তার মনে প্রেম নেই, মায়া নেই, কোনো মমতা নেই। যার মনে মানব প্রেম নেই, মসজিদ কিংবা মন্দিরে গিয়ে যতই ক্রন্দনরত অবস্থায় থাকুক সৃষ্টিকর্তার প্রেম সে পাবে না, পেতে পারে না, সৃষ্টিকর্তা সবার প্রতিই করুণা করেন কিন্তু প্রেম সবার ললাটে জোটে না।

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আমি একজন শিক্ষককে দেখেছি দিন-রাত অসহায়, অভাবী শিক্ষার্থীদের উপকারে নিবেদিতপ্রাণ হয়ে থাকতে, নিজের অর্থ খরচ করে বিপদে মেধাবী ছাত্রদের পাশে দাঁড়াতে। আসলে মানব প্রেমে একবার কেউ সুখ পেয়ে গেলে তাকে সৃষ্টিকর্তার প্রেম থেকে সরানো যায় না। সৃষ্টিকর্তা তাকে ভালোবাসেন, তার প্রেমে সাড়া দেন।

প্রেমে কোনো জাতি-ধর্ম বিবেচনা নেই। প্রেমে নেই মুসলিম, হিন্দু, খ্রিস্টান কিংবা বৌদ্ধ ধর্মের ভেদাভেদ।

একবার ফরিদপুর ডিসি অফিসের সামনে এক অসুস্থ বৃদ্ধ মহিলাকে কাঁদতে দেখে তার পরিচয় জিজ্ঞাসা করতেই তিনি নিজেকে খ্রিস্টান বলে পরিচয় দিলেন, দীর্ঘদিন অসুস্থ, সেবা করার কেউ নেই বলেই কেঁদে ফেললেন, নিজে কিছু টাকা দিয়ে সাহায্য করার চেষ্টা করলাম। কিছুক্ষণ পর দেখলাম এক ভদ্রলোক এসে সব কিছু জিজ্ঞাসা করে নিজের কাছে যত টাকা ছিল সব টাকা দিয়ে দিলেন। তার মহৎ প্রেম দেখে একপলকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলাম।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপককে দেখেছি সারা জীবন মানুষের কল্যাণে বিলিয়ে দিতে। বন্যা, শীত কিংবা নদী ভাঙনে তার মতো নিজ উদ্যোগে মানব কল্যাণে, মানব প্রেমে উদ্বুদ্ধ হতে কাউকেই দেখিনি। ডা. লুৎফর রহমান তার ‘মানব জীবন’ বইয়ে মানব প্রেম ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিখ্যাত মনীষী জন উলমানের প্রসঙ্গ এনেছেন। উলমান বলেন, ‘মানুষের আর্তনাদ যদি আমাদের কানে না পৌঁছে, পিতৃহীনের করুণ নয়ন দৃষ্টি যদি আমাদের না আকর্ষণ করে, কারো রোগ-শোক দেখে যদি আমাদের মুখ বিবর্ণ না হয়, তাহলে বুঝতে হবে আমাদের অন্তরে প্রেম নেই।’ মানব প্রেমের ফেরিওয়ালা পলান সরকারকে দেখেছি স্বশিক্ষিত হয়ে দিনের পর দিন বই কাঁধে আর হাতে নিয়ে মানব শিক্ষায় ঝাঁপিয়ে পড়তে।

জাতিকে শিক্ষিত করার আপ্রাণ মহৎ চেষ্টা করাই তার কাছে মানব প্রেম, এই প্রেমে সবাই সিক্ত হতে পারে না। সুইডেনের রাজকুমারী ইউজীনের কথা অনেকেই হয়তো জানেন, তিনি মানব প্রেমে ব্রতী হয়ে নিজের সব অলংকার বিক্রি করে অসহায় রোগীদের সেবার জন্য একটি হাসপাতাল নির্মাণ করেছিলেন। একবার এক অসহায় রোগী তাকে বলেছিলেন আপনার তৈরি এই হাসপাতালটি না থাকলে হয়তো আমি মারাই যেতাম এই বলে কান্নাকাটি করছিলেন। তখন রাজকুমারী ইউজীন যে মন্তব্য করেছিলেন তা আজও বিশ্বসেরা মন্তব্য হিসেবে বিবেচ্য। তিনি বলেছিলেন ‘আপনার অশ্রুই আমার শ্রেষ্ঠ অলংকার, এই অলংকার অঙ্গে সবাই জড়াতে পারে না।’

মানব প্রেমে যারা ব্রতী হোন, সত্য-সুন্দর তাকে পরম-মমতায় আকর্ষণ করে, পৃথিবীর সব সুখ খেলা করে তার হৃদয় মন্দিরে। দেহের প্রেম ক্ষণস্থায়ী, ক্ষণিকের আবেশে তা হারিয়ে যায় মহাকালের স্রোতধারায় কিন্তু মানুষ যখন স্বশিক্ষায় দীক্ষা নিয়ে মানব প্রেমের অতল সাগরে ঝাঁপিয়ে পড়ে সে প্রেম কখনো ফুরায় না, কাল থেকে কালান্তরে তা টিকে থাকে জাতির ভাগ্য ললাটের উদাহরণ হয়ে। ডা. লুৎফর রহমানের ‘মানব জীবন’ পাঠ করলে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের একটি ঘটনা জানা যায়; মহাজ্ঞানী ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর একবার শীতের সকালে মা’কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন ‘মা, আপনাকে আমি তুলা দিয়ে লেপ তৈরি করে দেওয়ার পরও কেন আপনি বস্তার তৈরি কাপড় গায়ে সারা রাত কাটিয়ে দিলেন? তখন তার মা বলেছিলেন ‘বাবা, আমি গ্রামের অসহায় মানুষের শীতের যন্ত্রণা, কষ্ট অনুভব করার জন্য তোমার তৈরি তুলার লেপটি গায়ে জড়িয়ে ঘুমায়নি! কত সুন্দর, সাবলীল ও মহৎ মানব প্রেম। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মা স্বশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে যে মানব প্রেমের উদাহরণ সৃষ্টি করেছিলেন তা আজকের সমাজে বিরল।

মানুষ শুধু মানব প্রেমে সিক্ত হবে বিষয়টি কিন্তু এমন নয়, জীব-জন্তুও মানব প্রেমের উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারে, প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) ও হযরত আবু বক্কর (রা.) যখন মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করছিলেন তখন শত্রুপক্ষের হাত থেকে রক্ষার জন্য একটি গুহায় আশ্রয় নিয়েছিলেন, যখন শত্রুরা গুহার দিকে তাকিয়ে একটি মাকড়সার জাল দেখতে পেলো তখন তারা সেখান থেকে ফিরে গিয়েছিল। ওই সময়ে মাকড়সার জাল বিছানো ছিল মানব প্রেমের অন্যতম উদাহরণ। পোকা-মাকড়ও মানব প্রেমে মত্ত হয়, মহান আল্লাহ পাকের নির্দেশে মানুষের জীবন রক্ষার্থে রাখতে পারে অনেক বড় অবদান। বড় প-িত, অধ্যাপক, ডাক্তার, বিচারক, ব্যাংকার ও ধনী হয়ে লাভ কী, যদি না মানব সেবায়, মানব প্রেমে জীবনের কিছু অংশ ব্যয় করতে না পারি? হাজার হাজার উপাসনালয় তৈরি করে সৃষ্টিকর্তাকে পাওয়া যায় না, সৃষ্টিকর্তা থাকেন মানব সেবায় আর মানব প্রেমে মত্ত জীবের সঙ্গে। মানব প্রেমে যে জীব বলীয়ান হয় সে কখনো অবিবেচক, নিষ্ঠুর, ক্ষতিকারক ও দাম্ভিক হতে পারে না, সৃষ্টিকর্তা তাকে সব কিছুর ঊর্ধ্বে রাখেন।

লেখক: প্রভাষক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :