স্কুলটি আজ মেয়েটির বিদেশ

সাদিক হোসেন
 | প্রকাশিত : ০১ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১৫:১৭
'আমার এখন কী হবে, 'গৌহাটির গৃহবধূ জমিরন পারভীন। তিনি বাদ পড়েছেন গতকাল প্রকাশিত আসামের চূড়ান্ত নাগরিক তালিকায়।

গতকাল অব্দি যে মেয়েটা স্কুলে গিয়েছিল, আজ সে স্কুলে যাবে না। স্কুলটি এখন বিদেশ। যে ঘাসের উপর পা ফেলে সে ঘরে ফিরে ছিল, আজ সেই ঘাসও তাকে ফিরিয়ে দিয়েছে। ঘাসের সবুজ পাতা, পাতলা; ব্লেডের মত, ছুরির মত চকচক করছে। মেয়েটি ভয় পাচ্ছে। আমগাছটির কাছে সে নিষিদ্ধ। জামগাছটির কাছে সে অচ্ছুৎ। রাধিকাপুর, হিম্মতনগর, মহিষাগোট, বেরনগবাটি তাকে চলে যেতে বলেছে।

রাস্তার পাশে নালা। নোংরা কালো জল। ছলছলে পিছল শ্যাওলা জমেছে। এইখানে সাইকেল নিয়ে একবার পড়ে গিয়েছিল সে। হাঁটুর উপর চামড়া ছলে গিয়েছিল। সেই দাগ এখনো হয়ত মিলিয়ে যায়নি। সে সেই দাগের উপর হাত বোলাতে পারছে না। তার হাত কেঁপে কেঁপে উঠছে। মনে হচ্ছে এই দাগটি কিভাবে তার পর হয়ে গেল?

কিংবা সেই যে দুই দিন, তিন দিন টানা বৃষ্টি নেমেছিল সেবার। উঠোনেও গোড়ালি ডুবে যাওয়া জল। সেই জলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলে, দেখা যেত– পায়ের পাতার উপর দিয়ে চিকি চিকি মাছেরা কেমন সরসর করে চলে যাচ্ছে। মাছেদের মা আছে। মাছেদের বাবা আছে। মাছেদের তবু কেউ না কেউ ঠিক ডেকে নেবে রাতে।

রাতের বেলা মাছেরা জ্যাঠাদের কোলে ঘুমিয়ে পড়ে। বুদবুদের মত নিঃশ্বাস নেয়। মাছেদের ঘরবাড়ি-বারান্দা, বারান্দায় তুক তুক ইটের গুড়োর মত বিছানা পাতা, বিছানায় চাঁদের আলো এসে পড়ে, পাখিরা গান গায়, দূর থেকে আইস্ক্রিমের গাড়ির ঘন্টি শোনা যায়। মাছেদের এইসব আছে। উঠোনের জলে, পায়ের পাতার উপর মাছেরা এইসব লিখে লিখে যায়।

ছাগলের গলায় ঝুনঝুনি বাঁধা, টুং টুং শব্দ হচ্ছে- এই শব্দটুকু আজ থেকে মাছেদের, ফাঁকা ফাঁকা বাগানের, পানপাতার, সুপুরি গাছের– এই শব্দগুলি থেকে সে মুছে যায়। প্যাঁচার পাখনা ঝাপ্টানোর মত সে নিঃশব্দে ঝরে যায়।

যেন সে কোনদিন এইখানে ছিল না। তার চিহ্নটুকুও বেয়াড়া মনে হয়। দেশ তো মাটি, ধুলো, হো হো হাসি, দেশ তো ইয়ার্কি, খেলনা, পুতুলের বাড়ি- সে পুতুলের বাক্স ফেলে রেখে চলে যাবে। হাতঘড়ি ফেলে রেখে চলে যাবে। পেনসিলের টুকরো পুকুরের জলে ছুঁড়ে দেবে।

সে পেছনে তাকাবে না। সে সামনে তাকাবে না। শীতকালের সোয়েটারে সে কোনদিন আর নরম নরম আদর খুঁজবে না।

তার আঁকার খাতায় পাহাড়, সূর্য– তাও হলুদ রঙের, সূর্যের উপর দিয়ে কালো কালো কাক উড়ে যাচ্ছে- সে এই সবকিছু স্কুলে, মাঠে, রাস্তায়, ট্রেনের কামরায় ছড়িয়ে দেবে।

আকাশে ভাসিয়ে দেবে। সে চলে যাবে। যেভাবে মানুষ দেশ ছেড়ে চলে যায়। যেভাবে সে সমুদ্রে ভেসে ওঠে। তারপর আবার ছবি হয়ে ফিরে আসে খবরের কাগজে।

লেখক: ভারতীয় কবি ও কথাসাহিত্যিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :