অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ

শিরোপাহীন একজন সংশপ্তক

ড. আতিউর রহমান
 | প্রকাশিত : ০২ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১০:৫৫

‘দুপুরে পরিবারের সবাই ভাত খেতে বসেছি। দেখলাম, আমার পাতে বড়সড় কই। আর যারা কষ্ট করে মাছ ধরল, সেই কামলাদের পাতে কুচো চিংড়ি। এটা আমাকে প্রতিবাদী করে তোলে।’ ১৫ বছর বয়সি এক বালকের এমন সরল অথচ স্পষ্টবাদী উচ্চারণ দেখে সত্যিই বিস্ময় জাগে। বড় হয়ে এই বালকটিই বলেছিলেন, ‘ইতিহাস বলে সমাজ পরিবর্তনশীল, শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা হবেই’Ñএমনই দৃঢ়চিত্তের অঙ্গীকার যার কণ্ঠ থেকে ধ্বনিত হয়েছিল তিনি বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে এক চলমান অধ্যায় অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ। পরিপূর্ণ বয়সেই তিনি চলে গেলেন। অনেক দিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন। তবু মনে হতো মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অন্যতম বাতিঘর বেঁচে আছেন। সেই বাতিটিও নিভে গেল। অনেক দিন হলো তার সাথে কথা হয় না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী এক সরকার জেঁকে বসেছিল বাংলাদেশে। স্বদেশ হাঁটছিল অন্ধকারের দিকে। আমি তখন নিয়মিত বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ এবং দারিদ্র্য নিরসন বিষয়ে দৈনিক সংবাদ ও জনকণ্ঠে লিখতাম। আজকের কাগজ, ভোরের কাগজ ও প্রথম আলোতেও লিখতাম। আমার লেখা পড়ে ভালো লাগলেই তিনি টেলিফোন করতেন। কত পরামর্শই না দিতেন। সাধারণ মানুষের কল্যাণ ভাবনায় নিবেদিত সেই অভিভাবকসম মানুষটির অভাব খুব করে আজ অনুভব করছি।

ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ, সকল লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে থেকে তিনি সাম্প্রদায়িকতা, সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদী শোষণের বিরুদ্ধে মানবসেবার ব্রতে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। একজন খ্যাতিমান শিক্ষাবিদ থেকে দেশপ্রেমের আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে ১৯৩৭ সালে ছাত্র রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন। দেশপ্রেম ও জনসেবাকে রাজনীতির মূল লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করে যেকোনো ত্যাগের জন্য সদাপ্রস্তুত থেকেছেন। রাজনীতির নামে ব্যবসাকে ঘৃণা করতেন প্রবলভাবে। আজীবন স্বপ্ন দেখেছেন দেশে শোষণমুক্ত সমাজ গঠনের। বিশ্বাস করতেন, রাজনীতিকরা দেশ ও জনগণের স্বার্থে কাজ করলে এই স্বপ্নের বাস্তবায়ন সম্ভব।

রাজনৈতিক জীবনে অনুপ্রেরণা এবং আদর্শ মানতেন মহাত্মা গান্ধীকে। কথায় নয়, ছিলেন কাজে বিশ্বাসী। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক হিসেবে তার বাসায় রাজনৈতিক নেতাদের গোপন বৈঠক হতো। ১৯৫৪ সালে অধ্যাপনার চাকরি ছেড়ে সক্রিয় রাজনীতিতে আসেন। যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে মুসলিম লীগের একজন মন্ত্রীকে পরাজিত করে তিনি ঐতিহাসিক সেই নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলেন। সত্য ও আদর্শের জন্য সংগ্রাম করতে কখনো পিছপা হননি। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতাকে সুসংহত করার পথে কখনো কারাবরণ, কখনো করতে হয়েছে আত্মগোপন। ১৯৫৮ সালে আইয়ুবের সামরিক শাসনামলে তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ও হুলিয়া জারি করা হয়। এমনকি তাকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করেছিল তৎকালীন সরকার। ফলে এ সময় বাধ্য হয়ে তিনি ‘আবদুল মান্নান’ ছদ্মনামে আত্মগোপন অবস্থায় আইয়ুবী শাসনের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন সংগঠিত করার কাজে নিয়োজিত থাকেন। আত্মগোপন অবস্থায় বিভিন্ন বৈরী ও বিপদসংকুল অবস্থার মধ্যে দিনাতিপাত করেছেন, কখনো থেকেছেন বস্তিতে, কখনো শাক-লতাপাতা দিয়ে ভাত খেয়েছেন। দীর্ঘ ৮ বছর আত্মগোপনে থাকার পর ১৯৬৬ সালে পুনরায় প্রকাশ্য রাজনীতিতে ফিরে আসেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে ছিল তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে বেশ কিছুটা সময় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একই রাজনীতি ও পার্টিতে যুক্ত ছিলেন। দুজনেরই একটি বিষয়ে অসম্ভব মিল ছিল; তা হলো, স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে দুজনেই ছিলেন আপসহীন, শোষিতের পক্ষে। পরবর্তী সময়ে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে আলাদা দল করেন। সে দলেও থাকেননি বেশি দিন। ফের আলাদা হয়ে যান। ন্যাপ (রিকুইজিশন) গঠন করেন ওয়ালি খানকে প্রধান করে। পূর্ব পাকিস্তানে ওই দলের প্রধান ছিলেন তিনি। পরবর্তী সময়ে এই দলটি মোজাফফর ন্যাপ নামেই বেশি পরিচিতি পায়। বঙ্গবন্ধুর ছয় দফার মধ্যে বাংলার স্বাধিকারের কথাটি মোজাফফর আহমদ ১৯৫৭ সালের ৩ এপ্রিল পূর্ববঙ্গ প্রাদেশিক পরিষদেই সর্বপ্রথম উত্থাপন করেছিলেন। সেদিন সকলে সমালোচনা করলেও সোহরাওয়ার্দীর মতকে উপেক্ষা করেই বঙ্গবন্ধু তাকে সমর্থন করেছিলেন।

১৯৬৭ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান ন্যাপের সভাপতি নির্বাচিত হন। মূলত ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টির অবদানকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতি হতে পারে না। কারণ ষাটের দশকে বামপন্থি রাজনীতিতে বিভাজন হয়েছিল বিধায় বাংলাদেশের রাজনীতির পট পরিবর্তন হয়েছিল। অস্বীকার করা নিরর্থক যে, বামপন্থিরা মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। বাংলাদেশের সংবিধানে ও পরিকল্পনায় যেসব গণহিতৈষী ধারণা যুক্ত হয়েছে নিঃসন্দেহে সেসবের ক্ষেত্র তৈরিতেও তাদের ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না।

মোজাফফর আহমদকে ১৯৬৯ সালে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া এবং ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন কমিটি (উঅঈ) গঠনের কারণে কারাবরণ করতে হয়। তিনি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন কা-ারিবিহীন জাতির পাশে দাঁড়ান সাহস ও মনোবল হয়ে। ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তিনি একাত্তরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। প্রবাসী সরকারপ্রধান তাজউদ্দীন আহমদের সাথে ছিল তার অন্তরঙ্গ সম্পর্ক। বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্প এবং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণকেন্দ্রে ঝটিকার মতো ঘুরে বেড়ান। স্বাধীনতার পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সফর করেন। বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিত্ব করতে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে যোগ দিতে নিউইয়র্ক যান। ন্যাপ, সিপিবি ও ছাত্র ইউনিয়নের নিজস্ব ১৯ হাজার মুক্তিযোদ্ধা গঠন করে তিনি মুক্তিযুদ্ধে একটি অবিস্মরণীয় ভূমিকা রাখেন।

১৯৭১ সালে মওলানা ভাসানী, মনি সিংহ, মনোরঞ্জন ধর সমবায়ে তিনি তৎকালীন মুজিবনগর সরকারের অন্যতম উপদেষ্টা হন। ১৯৭৯ সালে আইন পরিষদে সাংসদ নির্বাচিত হন। ১৯৮১ সালে ন্যাপ, সিপিবি ও প্রগতিশীল শক্তির মনোনীত রাষ্ট্রপতি প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। পরবর্তী সময়ে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে আবারও কারারুদ্ধ হন।

দেশপ্রেমিক কর্মী সৃষ্টির জন্য তিনি মদনপুরে উপমহাদেশের একমাত্র শিক্ষায়তন ‘সামাজিক বিজ্ঞান পরিষদ’ স্থাপন করেন এবং হাজার হাজার ন্যাপ কর্মী ও প্রগতিশীল কর্মীদের রাজনৈতিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। তিনি বলতেন, ‘আমি সংশপ্তক। আমি খুঁজে ফিরি পরশ পাথরÑনিবেদিতপ্রাণ কর্মী।’ সত্যিকার অর্থে তিনি নিজেই ছিলেন একজন পরশ পাথর। অথচ নির্লোভ ও বিনয়ী এই মানুষটি ২০১৫ সালে রাজনীতিকের সর্বোচ্চ সম্মাননা স্বাধীনতা পদক গ্রহণ করেননি। জীবনে কোনোদিন রাজনৈতিক সুবিধাও নেননি। দেশের গরিব-দুঃখী মানুষের মুক্তির জন্য, তাদের সেবায় যিনি সারা জীবন সংগ্রাম করেছেন তিনি নির্বিকারচিত্তে উচ্চারণ করেন, ‘দেশের জনগণের সংগ্রামে বা মুক্তিতে আমি যৎসামান্যই করেছি। নিজেকে অতি মূল্যায়ন করা আমার নিকট সমীচীন নয়।’ কালের সাক্ষী এই মানুষটি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত নতুন প্রজন্মের প্রতি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের সমাজ বাস্তবতাকে বিবেচনায় নিয়ে শোষিত মানুষের মৌলিক অধিকার তথা ক্ষুধা, দারিদ্র্যমুক্ত, ধন-বৈষম্যহীন, অসাম্প্রদায়িক একটি সমাজব্যবস্থা তথা সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদের তৈরি হতে হবে। অভিজ্ঞতা বলে, নতুন প্রজন্মই সমাজ বদলের সংগ্রামের অগ্র সেনানী।’ নির্লোভ, গরিব-হিতৈষী, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বলিষ্ঠ ধারক অন্যতম প্রধান এই নেতার অভাব খুব সহজে পূরণ করা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। তার আত্মা শান্তিতে থাকুক সেই প্রত্যাশাই করছি।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :