হায়াৎ মামুদের সঙ্গে এক দুপুর

হাবিবুল্লাহ ফাহাদ
| আপডেট : ০৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১২:৪৬ | প্রকাশিত : ০৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১২:৩২

মুঠোফোনে সময় চাইতেই বললেন, ‘এখুনি পারলে চলে এসো না। আমি আছি।’ অ্যাপে মোটরসাইকেল ডেকে ইস্কাটন থেকে যখন গেন্ডারিয়ার পথ ধরলাম তখন ঘড়িতে বেলা সাড়ে ১১টা। যানজটের পথ ঠেলে দয়াগঞ্জ হয়ে সাধনা ঔষধালয়ের গলিতে পৌঁছতে লেগে গেলো পাক্কা এক ঘণ্টা। ড্রেনেজের কাজ হয়েছে। রাস্তা কাটা। এখনো ঠিক হয়নি। কোথাও কোথাও বড় গর্ত। আবার কোথাও মাটির স্তূপ। ভাঙা ইটের খোয়ায় এবড়োখেবড়ো পথ। তার দু পাশের সরু অংশ দিয়ে পিঁপড়ের সারির মতো চলতে হয়। মোটরসাইকেলে ওই পথ পার হওয়া কী যে কঠিন! চালক-আরোহী দুজনেরই কোমরের হাড় নড়ে যাওয়ার জোগাড়। পথ গিয়ে শেষ হলো গেন্ডারিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে।

এবার ঠিকানা খোঁজার পালা। ১০২/এ দীননাথ সেন রোড। হোল্ডিং নম্বর শুনে কেউ সন্ধান দিতে পারলেন না। এবার বললাম, ‘লেখক হায়াৎ মামুদ স্যারের বাড়িটা কোনদিকে বলতে পারেন?’ একজন পথচারী মাথা চুলকে বললেন, ‘নাম শুনছি। এইদিকে থাকেন। কিন্তু কোন বাড়িটা যে—’

শ্রাবণের আকাশ। এই ভালো, এই মন্দ। মাথার ওপর মেঘ ঘুরঘুর করছে। বৃষ্টি নামে নামে ভাব। হাঁটতে হাঁটতে এলাম মূল গলির মুখে। একজন রিকশাচালক পা তুলে বসেছিলেন সিটে। ‘লেখক হায়াৎ মামুদ স্যারের বাসাটা চেনেন?’ মুহূর্তে জবাব দিলেন, ‘কবি স্যারের বাড়ি? ওই গেটটাই। সুইচে চাপ দেন, খুইলা দিবো।’

বাড়ির গেটে খুব বেশি শানশওকত নেই। লাল ইটের মাঝে সাদা ফলকে লেখা ‘রওশন মঞ্জিল’। ভেতর থেকে গাছের সংসার দেয়াল টপকে উঁকি দিচ্ছে। গ্রিলের গেট। বাইরে থেকে ভেতরের অনেকটাই দেখা যায়। বেল চাপতেই সাদা শ্মশ্রুম-িত একজন এসে গেট খুলে দিলেন। জানতে চাইলেন, ‘কাকে চান?’

পরিচয় দিয়ে উদ্দেশ্য বললে তিনি ভেতরে ডেকে নিলেন। ঢুকতেই স্বাগত জানালো রঙ্গন, নয়নতারারা। নজর কাড়লো কমলা রঙের ঝুমকো জবা। ঝুলে আছে ঝাড় বাতির মতো। ইংরেজি এলের মতো দেখতে তেতলা বাড়িটা শুরু হয়েছে বাগান দিয়ে। অতীতের চিহ্ন আগলে বনেদি ঢঙে দাঁড়িয়ে আছে।

লম্বা বারান্দার এক কোণে কাঠের বেঞ্চি। খিড়কি-দরজাতে কাঠের কপাট। গেট খুলে দেওয়া লোকটা ভেতর থেকে কাঠের দরজা খুলতেই চোখে পড়লো বসার ঘর। তার এক কোণে আধ সোয়া হয়ে সোফায় বসে আছেন যিনি, আমি তাঁর কাছেই এসেছি।

দরজার দিকে তাকিয়ে হাত ইশারা করে বললেন, ‘ভেতরে এসো।’ তিনি হায়াৎ মামুদ। খ্যাতিমান লেখক। আধুনিক কবি, প্রবন্ধকার এবং অনুবাদক। বসার এই ঘরটার দুই দেয়ালেই বইয়ের তাক। একপাশে কাজের স্বীকৃতি পুরস্কারগুলো কাচের শোকেসে শোভা পাচ্ছে। ভেলভেটের গদিওয়ালা সোফা ঘরের দুপাশে সারি সারি সাজানো। ঢুকতেই সামনের দেয়ালে চোখ গেল ফ্রেমে বাঁধানো সাদাকালো ছবিতে। ছবির মানুষটার চুল পেছনের দিকে আঁচড়ানো। চোখে কালো মোটা ফ্রেমের চশমা। সাদা শার্টের বুক পকেটে কলম গোঁজা। পরে জানলাম তিনি শামসের আলী। লেখকের বাবা।

ঘরের শেষ দিককার সোফায় পা তুলে নরম কুশনে কাত হয়ে বসেছিলেন হায়াৎ মামুদ। মুখ নাড়ছেন। সামনে ফালি ফালি করে কেটে রাখা পেয়ারা, আমড়া। তার পাশে বাটিতে টুকরো টুকরো পনির আর টোস্ট। এক কামড় টোস্ট আর এক টুকরো পনির মুখে পুরে বললেন, ‘বসো পেয়ারা খাও।’ আমি তাঁকে সাপ্তাহিক এই সময়-এর ঈদুল ফিতরের সংখ্যাটি হাতে দিতেই সাগ্রহে নিলেন। তারপর একটার পর একটা পাতা উল্টে যেতে লাগলেন। দু-একটি পৃষ্ঠায় একটু বেশি সময় থাকলেন। কিছু কিছু পড়তে লাগলেন।

এই ফুরসতে আমি চোখ বোলাচ্ছিলাম বইয়ের তাকে। দস্তয়েভস্কি, তলস্তয়, ম্যাক্সিম গোর্কিরা শোভা পাচ্ছেন কাঠের পুরোনো তাকে। আছে ভারতীয় সভ্যতা, রুশ লেখকদের ছোটগল্পের বাঁধানো বই। সবই ইংরেজি ভাষায়। দু-একটি বাংলা বইও আছে। খুব একটা যতœ নেই বোঝা গেল। ধুলাঝুল জমে সাদা হয়ে আছে তাকগুলো।

নিস্তব্ধতা ভেঙে লেখক বললেন, ‘কই তুমি তো খেলে না!’

খেলাম তো। আপনি বই পড়ছিলেন। খেয়াল করেননি হয়তো।

হবে হয়তো। বয়স তো কম হলো না। কত কিছু দেখি। কত কিছু ভুলে যাই। পত্রিকাটা হাত থেকে নামিয়ে রেখে বললেন, ‘ভালো হয়েছে। তা কী যেন বলবে বলছিলে?’

‘আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাই।’

‘কী নিয়ে?’

‘ফেলে আসা দিনের স্মৃতি। মনে পড়ে কি না। এখন সময় যাচ্ছে কী করে। এসব নিয়ে।’

তিনি হাসলেন। বললেন, ‘এসব শুনে কী হবে? কাজে তো আসবে না।’

বললাম, ‘প্রিয় লেখক সম্পর্কে পাঠকের জানার আগ্রহের তো শেষ নেই। তাদের বঞ্চিত করা কি ঠিক হবে?’

‘প্রিয় লেখক হতে পেরেছি কি না জানি না। তবে গদ্য বোধহয় আমি খারাপ লিখি না। হা হা হা’

‘এ বছর জীবনের ৮০ বছর পূর্ণ করেছেন। কিন্তু এখনো কেমন চশমা ছাড়া দিব্যি পড়ে গেলেন। অসুবিধে হয়নি?’

‘নাহ্! খুব একটা পরিষ্কার যে দেখি তা না। তবে কাছে নিলে সমস্যা হয় না।’

‘অতীতের সময়গুলো মনে আছে? আপনার জন্মস্থানের কথা। শৈশবের কথা।’

কিছুক্ষণ থামলেন। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বললেন, ‘মুড নেই। মন চাইছে না বলতে।’ তারপর আবারও নিস্তব্ধতা। তিনি চোখ বন্ধ করে রইলেন। ক্লান্তির ছাপ এসে জমেছে চেহারায়। দীর্ঘ জীবনে কত কথাই তো বলেছেন। বলতে বলতে এক সময় মানুষ ক্লান্ত হয়। আবার আট দশকে তো কম বলেননি। আর কী বা বলার থাকতে পারে।

আমি নরম গলায় বললাম, ‘আমরা অন্য কোনো প্রসঙ্গে কথা বলবো?’ তিনি চোখ খুললেন। বললেন, ‘আমার জন্ম তো এ দেশে নয়। ভারতে। হুগলির (জেলার) মৌড়া গ্রামে। আষাঢ় মাসে। বাংলায় ১৩৪৬ সাল ১৭ আষাঢ়। ইংরেজি বছর হিসেবে ১৯৩৯ সালের ১০ জুলাই। দেশভাগের পর বাবা আমাদের নিয়ে ঢাকায় চলে এসেছিলেন। আত্মীয়স্বজনরা রয়ে গেলেন। এখনো আছেন।’

‘মৌড়া গ্রামে মুসলমানদের সংখ্যা বেশি ছিল বলে আপনার এক লেখায় জেনেছি। তখনকার কথা কি মনে পড়ে?’ ‘হ্যাঁ মনে পড়ে। আমাদের গ্রামের পুবে ছিল জেলে পাড়া। নি¤œ শ্রেণির হিন্দুরা ছিল ওই গ্রামে। উত্তরের রাস্তা দিয়ে মাইলখানেক গেলে খেজুরদহ গ্রাম। আমরা বলতাম খাজুরদ্যে।’

‘আপনার বিদ্যালয়ে যাত্রা তো হুগলিতে থাকতেই, তাই না?’ ‘হ্যাঁ। ওই খাজুরদহ গ্রামের বি-বকাউল্লাহ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আমার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবনের হাতেখড়ি। ওই স্কুলকে আমরা এমই স্কুল বলতাম। এমই মানে মিডল ইংলিশ। শুকনো দিনে শুকনো ফসলের মাঠ বরাবর সোজা স্কুলে চলে যেতাম। বর্ষার দিনে অবশ্য মাঠে পানি থাকতো। উত্তরের রাস্তা ঘুরে যেতে হতো।’

টি-টেবিলে রাখা পেয়ারায় বিট লবণ লাগিয়ে মুখে দিলেন। মুখে নাড়তে নাড়তে বললেন, ‘আমার নামের কথাটা জানো তো? আমার আসল নাম কিন্তু মনিরুজ্জামান। ছোট করে মনির বলে ঢাকতো সবাই। মনির থেকে হয়ে গেলাম হায়াৎ মামুদ।’

‘হ্যাঁ শুনেছি। লেখালেখি শুরুর পর বদলে ফেলেছিলেন। কিন্তু হায়াৎ মামুদ নামটি বেছে নেওয়ার কারণ কী?’

‘এটা তো অনেক আগের কথা। তখন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে পড়ি। ১৯৬০ সাল-টাল হবে হয়তো। খুব মনে নেই। একদিন মধুর ক্যান্টিনে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম। আমি, জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, হুমায়ূন চৌধুরী (বিটিভিতে ছিল), আমরা সব বাংলার ছাত্র ছিলাম। তখন কথা হচ্ছিল নাম নিয়ে। তখন তো মনিরুজ্জামান নামে অনেক লেখক ছিলেন। ওই নামে তো পত্রিকায় লেখা যাবে না। নতুন নাম লাগবে। বন্ধুরা সবাই খুঁজেটুজে বার করলো মধ্যযুগের একজন কবির নাম। হেয়াৎ মামুদ। তার হেয়াৎ কে আকার দিয়ে হায়াৎ করে দিলো। সেই থেকে হায়াৎ মামুদ হয়ে গেলাম (হাসি)।’ জীবনে কী হতে চেয়েছিলেন?

“আমি লেখক হতে চেয়েছি। এটাই আমার ইচ্ছে ছিল। লেখালেখি আর পড়াশোনার জগতেই থাকতে চেয়েছি। বাড়ি থেকেও কোনো চাপ দেওয়া হয়নি। আমাদের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল। আমার বাবা শামসের আলী ব্যবসা করতেন। তিনি ইউনিয়ন বোর্ডের ভাইস প্রেসিডেন্টও ছিলেন। সিমেন্টের রিং পাইপের ব্যবসা ছিল। যা সেই সময় কুয়া বানানোর কাজে লাগতো। গ্রামের পাশে খালি মতো জায়গায় সিমেন্টের পাইপ বানানোর কাজ চলত দিনভর। বাবা দেশভাগের পর ঢাকায় এসেও একই ব্যবসা শুরু করলেন। নাম ছিল রটোবার্ন অ্যান্ড কোম্পানি। বাংলাদেশে প্রথম তিনিই এই ব্যবসা শুরু করেন। পড়াশোনা শেষ করে চিন্তা করলাম বাবার সঙ্গে ব্যবসা দেখি। বাবা হয়তো শুনে খুশি হবেন। কিন্তু বাবা শুনেই বললেন, ‘না না। তোমাকে এসব করতে হবে না। এ আমি বুঝবো। তুমি পড়াশোনা করো।’ বাবা তো খুব বেশি পড়তে পারেননি। দরিদ্র ছিলেন। অর্থের অভাব ছিল। আগে তো লেখাপড়া করতে অনেক টাকা-পয়সা লাগতো। তিনি লেখাপড়া করতে পারেননি বলে মনে দুঃখ ছিল। তিনি চাইতেন তার সন্তানরা অনেক পড়াশোনা করুক। নিজে যা পারেননি সন্তানদের মাঝে তার প্রতিফলন দেখতে চেয়েছেন। তিনি আমাকে লেখাপড়া থেকে কখনো সরিয়ে নিতে চাননি। আমি যে খুব পড়াশোনা করতাম, এ নিয়ে তার ভেতরে ভেতরে গর্ব ছিল।”

বাবার ব্যবসাটি কি এখনো টিকে আছে?

‘না, স্যুয়ারেজ পাইপের ব্যবসাটি এখন আর নেই। শ্যামবাজারের এই কারখানাটি কয়েক বছর আগেও আমার ভাই সিরাজ দেখাশোনা করতো। এখন বন্ধ।’

দেশভাগের পর ঢাকায় এলেন। ওখানকার সহায়-সম্পত্তির কী হলো?

‘ভারতে আমাদের অবস্থা খুব ভালো ছিল। চাষাবাদের জমি ছিল। ওগুলো রেখে আসতে হয়েছে। ওখানে আমাদের আত্মীয়স্বজনরা ওগুলো ভোগ করতো। এখনো করে।’

‘এখানে এসে কোথায় পড়াশোনা শুরু করলেন?’

‘ঢাকায় তখন নামকরা স্কুল সেন্ট গ্রেগরি। লক্ষ্মীবাজারে। ওখানে ভর্তি হলাম। বাবা ব্যবসা শুরু করলেন। গেন্ডারিয়ার এই বাড়িটা বাবাই করেছেন।’ আপনারা কয় ভাইবোন?

‘আমি সবার বড়। কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তরটা দিতে গেলে আমাকে অসুবিধায় পড়তে হয়। কারণ আমার চাচি তার ছেলেকে খুব ছোট রেখে মারা গিয়েছিলেন। সেই ভাইটি পরে আমাদের বাড়িতেই বড় হয়েছে। তাকে আমরা নিজের ভাই হিসেবেই মনে করি। তাই ‘কয় ভাইবোনের’ উত্তর দিতে গেলে তাকে বাদ দিতে হয়। এজন্য এই প্রশ্নের উত্তর আমার মন থেকে আসে না।’

কথা বলতে বলতে সোজা হয়ে বসেছিলেন। একবার একটু দম নিলেন। বাঁ পাশে খানিক কাত হয়ে বললেন, ‘আমার জীবন স্বাচ্ছন্দ্যেই ছিল। পয়সাকড়ি নিয়ে সারা জীবনে আমাকে একবারও ভাবতে হয়নি। কারণ বাবা ব্যবসা-বাণিজ্য করে বেশ ভালো ছিলেন। আমার অবশ্য কোনো বাজে অভ্যাস ছিল না।’ আবারও থামলেন। কিছু একটা মনে করার চেষ্টা করছেন মনে হলো। তারপর হারিয়ে যাওয়া কথা খুঁজে পাওয়ার ভঙ্গিতে বললেন, ‘সিগারেট খেতাম কিছুকাল। পাইপ খেতাম।’

কথার মাঝে প্রায়ই খেই হারিয়ে ফেলছিলেন তিনি। বয়সে স্মৃতির অনেকটাই ঝাপসা হয়েছে। হাতড়ে হাতড়ে মনে করছিলেন সেইসব। কর্মজীবনের শুরুতে কিছুদিন বাংলা একাডেমিতে চাকরি করেন। ১৯৭৮ থেকে ২০০৪ পর্যন্ত দীর্ঘকাল তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অধ্যাপনা করেছেন। শিশুসাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য তাঁকে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার প্রদান করা হয়। জীবনব্যাপী শিশুসাহিত্য রচনার জন্য তাঁকে ২০১৩ সালে বাংলাদেশ শিশু একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার প্রদান করা হয়। ২০১৬ সালে তিনি একুশে পদক লাভ করেন।

এখন সময় কী করে কাটছে?

ত্বরিত উত্তর, ‘বই পড়ে। নাতি-নাতনিদের সাথে খেলা করে।’

খুব ভোরে ঘুম ভেঙে যায়। কিন্তু বিছানা ছাড়ি না। আমি কিন্তু খুবই অলস প্রকৃতির। খুব পরিশ্রমী নই। দুপুরে খাবারের পর বিশ্রাম নিই।

বয়স ৮০ পার হলো। এখন মনে হয়, অনেকদিন তো বাঁচলাম।’

আপনি অলস কথাটা মানতে পারছি না। একজন অলস মানুষ কী করে এত এত লিখেছে। ৭৫টির মতো বই লিখেছেন।

‘তা ঠিক। লেখালেখি পরিশ্রমের কাজ। মাথা খাটিয়ে কাজ করতে হয়। চিন্তা করাও তো পরিশ্রমের কাজ।’

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধুদের কথা মনে পড়ে?

‘বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার খুব ঘনিষ্ঠ ছিল জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত। জ্যোতির সুবাদে আমি আরেকজন খুব বিখ্যাত মানুষকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি। জ্যোতি তাঁর পালক পুত্রের মতো ছিল। তিনি বিয়ে-থা করেননি। ড. জি সি দেব (গোবিন্দ চন্দ্র দেব)। এ দেশে তো বটেই, পশ্চিম পাকিস্তানেও তিনি খুব বিখ্যাত দার্শনিক ছিলেন। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের দর্শনবিদ্যার অধ্যাপক। তিনি জি সি দেব নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন। আমি কখনো ড. জি সি দেবকে কাউকে গালমন্দ করতে শুনিনি। খুবই বড় মনের মানুষ ছিলেন। আমার বাবাকেও কখনো কাউকে গালমন্দ করতে শুনিনি। তিনিও খুব ভালো মনের মানুষ ছিলেন।’

বাবা কেমন ছিলেন? মনে আছে তাঁর কথা?

‘আমাদের সময় সব বাবাই অত্যাচারী বাবা ছিলেন। (শব্দ করে হাসলেন)। আদরও করতেন। পেটাতেনও। বাবা খুব আড্ডাবাজ ছিলেন। এই যে ঘরটায় বসে আছি, এখানেই বসতো তাঁর আড্ডার আসর। এলাকায় সমবয়সিরা আসতেন বাবার কাছে। বাড়িতে এখনকার মতো কাজের মেয়ে ছিল। সেও কাপের পর কাপ চা সরবরাহ করতো। আড্ডা দেওয়ার স্বভাবটা আমি বাবার কাছ থেকে পৈতৃক সূত্রে পেয়েছি বলে মনে হয়। তবে হ্যাঁ বাবা খুব ভালো বাংলা জানতেন। নিজের চর্চাতেই। তিনি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে খুব বেশি পড়তে পারেননি বলে বইয়ের প্রতি আগ্রহ ছিল। আমার যে বই কেনার শখ ছিল, এতে বাবা খুব খুশি হতেন। আমি যে লেখালেখি করতাম বাবা খুব খুশি হতেন। আমাকে লোকে লেখার সূত্রে জানে, এটা তার খুব ভালো লাগতো।’

কাজী নজরুলকে নিয়ে আপনি লিখেছেন। এতটা যতœ করে নজরুলের কিশোর জীবনী কেউ লিখেছে বলে নজির নেই।

‘কাজী নজরুল ইসলাম নিজেকে তৈরি করে নেওয়া মানুষ ছিলেন। তিনি নিজেই নিজেকে গড়েছিলেন। তখনকার সময়ে তো অনেক কুসংস্কারচ্ছন্ন সমাজ ছিল। হিন্দু-মুসলমানে বিভেদ ছিল। কিন্তু নজরুলের এসব নিয়ে কোনো মাথাব্যথা ছিল না। তিনি একজন হিন্দু নারীকে বিয়ে করেছিলেন। এটা কিন্তু ওই সময়ে অনেক সাহসের ব্যাপার ছিল। তিনি খুব রোমান্টিক মানুষ ছিলেন।’

আপনার লেখালেখি শুরুর প্রস্তুতি সম্পর্কে যদি বলতেন। কী করে শুরু করেছিলেন? ভিতটা তৈরি হয়েছিল কী করে? ‘আমার সৌভাগ্য হচ্ছে ওই সময় আমি ঢাকার সবচেয়ে ভালো স্কুলে পড়েছি। সেন্ট গ্রেগরি হাইস্কুলে। কারণ ওখানে যাঁরা শিক্ষকতা করতেন তাঁরা খুব ভালো শিক্ষক ছিলেন। অনেক জানতেন। তখন তো খুব ভালো ভালো শিক্ষকরা স্কুলে পড়াতেন। তাঁরা চাইলে অন্য কোনো চাকরিতে যেতে পারতেন। যাননি। তাঁরা পাঠদানকে ভালোবেসে, স্কুলকে ভালোবেসে এই পেশায় এসেছিলেন। যে জন্য পড়াশোনায় তাঁদের ঝোঁক ছিল। তাঁরা শিক্ষার্থীদের অনেক শেখাতে পেরেছেন।’

স্কুলজীবনের কোনো শিক্ষকের কথা কি মনে আছে?

‘আমার এক শিক্ষকের কথা মনে আছে। তাঁর কপালের মাঝ বরাবর একটা আব ছিল। আমরা বলতাম কপাল ফুলো মাস্টার। থাকতেন শ্যামবাজারে। বাংলা পড়াতেন। তিনিও বিয়ে-থা করেননি। যতটুকু মনে পড়ে দোতলায় থাকতেন। দোতলার করিডোরে সারি সারি বইয়ের আলমারি সাজানো ছিল। হোমিওপ্যাথি প্র্যাকটিস করতেন। অবসরে যাওয়ার পর সেন্ট গ্রেগরি হাইস্কুলের রাস্তার শেষ দিকে হোমিওপ্যাথির একটা চেম্বার নিয়েছিলেন। আমাদের স্কুলের হেডমাস্টার আমেরিকান ছিলেন। বাঙালি ছিলেন না।’

ভাষা আন্দোলনের কথা মনে পড়ে? ওদিন কী দেখেছিলেন? ‘মনে আছে বায়ান্নর ২১ ফেব্রুয়ারি স্কুল খোলা ছিল। সেদিন ক্লাস বন্ধ করে দেওয়া হলো। ছেলেরা সবাই স্কুলের বাইরে মিছিল নিয়ে বেরোলো। আমিও গেলাম তাদের সঙ্গে।’

স্কুলজীবন শেষ করে কোন কলেজে পড়েছেন? ‘আমি নটরডেম কলেজে পড়েছি। কিন্তু সেখান থেকে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিতে পারিনি। আমাকে এক স্যার বললেন, তোমার তো মার্কের পার্সেন্টেজ ভালো না। তুমি এক কাজ করো, কায়েদে আযম কলেজে (বর্তমানে শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ) যাও। সেখানে আমি বলে দিচ্ছি। আমি সেখানে গিয়ে ভর্তি হলাম। সেখান থেকে পরীক্ষায় অংশ নিলাম। রেজাল্টের দিক দিয়ে আমি ছাত্র অতটা ভালো ছিলাম না। কিন্তু ছোটবেলা থেকে অনেক বই পড়েছি। বইয়ের প্রতি ঝোঁক ছিল।’

আপনার প্রিয় লেখকদের একজন বুদ্ধদেব বসু বলে জানি। তাঁর সম্পর্কে কিছু শুনতে চাই। ‘আমার খুব প্রিয় লেখক বুদ্ধদেব বসু। তিনি তো ঢাকার মানুষ ছিলেন। এটা শুনেই তাঁর প্রতি আমার আগ্রহ বাড়ে। আমাদের স্কুলের লাইব্রেরিটা খুব ভালো ছিল। ওই যে কপাল ফুলো স্যার তিনি লাইব্রেরি দেখাশোনা করতেন। তিনিই আমাদের বইপত্র দিতেন। তাঁর সুবাদেই বুদ্ধদেব বসুর লেখার সঙ্গে পরিচয়।’

প্রিয় লেখকের সঙ্গে দেখা হয়েছে কখনো? ‘বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে দেখা হয়েছে। আলাপ হয়নি কখনো। আমি যখন ভারতে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করতে যাই তখন বুদ্ধদেব বসুর ছেলে আমার বন্ধু ছিলেন। একদিন দুপুরবেলা তাদের বাড়িতে গেলাম। বুদ্ধদেব বসু খুব ফিটফাট থাকতেন। সাদা পাঞ্জাবি আর ধুতি পরা মানুষ। দেখে চোখ ভরে গিয়েছিল। কথা হয়নি কোনো।’

এখনো প্রতিদিন নিয়ম করে বাসা থেকে বের হন। সদরঘাটে পুঁথিনিলয় নামে একটি প্রকাশনা সংস্থায় যান বলে শুনেছি। ‘হ্যাঁ, রিকশায় করে সদরঘাটে যাই। সাথে সহকারী থাকে। ওখানে গিয়ে বইপত্র দেখি। যেগুলো ছাপা হবে সেগুলো। ওখান থেকে ৮টার মধ্যে বেরিয়ে যাই। বাসায় ফিরে এসে খাওয়া তারপর ঘুম।’

এখন তো লিখতে পারেন না। যখন লিখতেন, তখন কি নির্দিষ্ট কোনো সময় মেনে টেবিলে বসতেন? ‘লেখালেখির জন্য আমার নির্দিষ্ট কোনো সময় ছিল না। যখন ভালো লাগতো লিখতাম।’

বসার ঘর থেকে সদর দরজা সোজাসুজি দেখা যায়। একটা গাড়ি এসে থামলো। গেট খুলতে বেরিয়ে এলো ফুটফুটে দুটি শিশু। স্কুলের পোশাক পরা। তাদের দেখেই হঠাৎ লেখকের মনটা চনমনে হয়ে উঠল। মুখে হাসি ফুটলো। বললেন, ‘বুবুরা এসেছে।’ বলতে বলতে পাখির ছানার মতো কিচিরমিচির করতে করতে ঘরে ঢুকল একজন। লেখক হায়াৎ মামুদ তাদের দাদু ভাই। ডেকে বললেন—

‘কই বুবু? কোত্থেকে এলে তুমি?’

‘স্কুল থেকে।’

তুমি স্কুলে যাও নাকি?

‘হু।’

‘তুমি পড়াশোনা করো নাকি?’

‘হু।’

‘যাহ্!’

‘হ্যাঁ।’ এবার একটু উচ্চৈঃস্বরে।

‘আমি তো শুনেছি তুমি ওখানে গিয়ে গান গাও।’

‘গানও গাই।’

‘তাই?’

‘হু।’

শিশুটি টেবিলের ওপর রাখা সাপ্তাহিক এই সময় পত্রিকাটি নিয়ে নাড়তে লাগলো। লেখক তাকে কোলে টেনে নিলেন। আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললেন, ‘এখানে কী লেখা আছে বলো তো?’

শিশুটি জবাব দিল, ‘এ’

‘এইটা।’

‘ই।’

‘মিলে হলো-এই। এইটা’

‘স।’

‘এইটা?’

‘ম।’

‘এইটা’

‘য়।’

‘এবার হলো-সময়’

‘হ্যাঁ।’

হাতে একটা ব্যাগ নিয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে দ্বিতীয় শিশুটিও ঘরে ঢুকলো। ‘এই যে দেখো, এটা কী?’

লেখক এবার মনোযোগী হলেন তার দিকে, ‘কী এইটা বুবু?’

‘জুতো।’

‘বাহ্, কী সুন্দর জুতো।’

চেহারা বলছে ওরা যমজ। নাম জানতে চাইলাম। জানালো, একজন অদিতা, অন্যজন মিলিতা। ওদের বয়স পাঁচ বছর। স্কুলে কেজি ওয়ানে পড়ছে। লেখক এবার আদুরে গলায় অদিতাকে বললেন, ‘কার জুতো বুবু কার জুতো?’

‘আমাদের।’

‘হ্যাÑয়্! জুতো কিনেছো?’

‘না, ...আপুরা যে কসসোবাজার (কক্সবাজার) গিয়েছিল, কসসোবাজার থেকে এনে দিয়েছে।’

‘বাহ্ কী সুন্দর বুবু। কী সুন্দর রং!’

আদিতা: ‘আমি পরে থাকি?’

মিলিতা: ‘বাসায় গিয়ে পরো।’

ব্যাগ থেকে কিছু একটা বের করতে করতে আদিতা বলল: ‘আরো আছে বোন (মিলিতা), আরো আছে। খাবার দিয়েছে খাবার।’

এই সময় ঘরে ঢুকলেন আদিতা-মিলিতার মা তানজিয়া পলি। পুত্রবধূর দিকে তাকিয়ে লেখক বললেন, ‘কীরে মা!’

‘এই তো বাবা। আপনি খেয়েছেন কিছু?’

‘এই তো খেলাম।’

আলাপে পলি জানালেন, আদিতা-মিলিতার বাবা আলী মো. শহিদুজ্জামান। তিনি লেখকের বড় ছেলে। চাকরি করেন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি বেসরকারি সংস্থায়। তার একটি বোন আছেন। নাম লোপ।

পলি জানালেন, তার দুটো মেয়েই বেশ দাদাভাই-ভক্ত। যদিও ওদের দাদি ওদের অনেক কিছু খেতে দেন। আদর করেন। তারপরও দাদাভাইয়ের সঙ্গেই ওদের বেশ ভালো লাগে। ওদের কাছে যদি জানতে চাওয়া হয়, ‘কাকে তোমাদের বেশি ভালো লাগে? দাদাকে না খুকোদাদুকে (দাদি)?’ ওরা বলে, ‘দাদাভাইকে অনেক ভালোবাসি।’

লেখকের শারীরিক অবস্থা প্রসঙ্গে কথা তুললে পলি জানালেন, গত চার-পাঁচ বছরে তিনি অনেকটাই কাবু হয়ে গেছেন। বয়সের কারণে স্মৃতিতেও ধুলা জমেছে। অনেক কিছু ভুলে যান। কেউ মনে করিয়ে দিলে আবার বলতে পারেন।

শ্বশুরকে শ্বশুর নয়, বাবা বলেই জানেন পলি। লেখকও তাকে ভালোবাসে মেয়ের মতো। বললেন, ‘প্রগতি প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত বাবার অনুবাদের বই আমি পড়েছি। শ্বশুর হওয়ার পর ওভাবে পড়া হয়নি।’

প্রগতি প্রকাশনীর কথা শুনে লেখক বললেন, ‘প্রগতি প্রকাশনীতে কাজ করেছি। রাশিয়াতে গিয়েছিলাম। খুব আনন্দে ছিলাম। স্ত্রীও সাথে ছিল। সেখানে তিন বছরের মতো ছিলাম। অনুবাদই কাজ ছিল। রুশ থেকে বা ইংরেজি থেকে অনুবাদ করতে হতো। আমার সঙ্গে দ্বিজেন শর্মা গিয়েছিলেন। কলকাতা থেকে গিয়েছিলেন অরুণ সোম। ননী ভৌমিক তো আগে থেকেই ছিলেন।’

কথা শেষে পলি বিদায় নিলে আমরা আবার প্রসঙ্গে ফিরলাম। এবার তিনি বেশ ফুরফুরে আগের চেয়ে। জানতে চাইলাম, লেখক হওয়ার জন্য কী ধরনের প্রস্তুতি থাকা দরকার?

জবাবে বললেন, ‘এটা একেক জনের একেক রকম। তবে প্রচুর পড়তে হয়। আমি তো জীবনের বেশির ভাগ সময় শুধু পড়েছি আর লিখেছি। আর কোনো কাজ তো করতাম না।’

কথা হলো লেখকের দর্শন নিয়ে। তার ভাষায়, ‘মানুষ যে বাঁচে তা থেকেই এক ধরনের দর্শন তৈরি হয়। আগে দর্শন হবে পড়ে লিখবে, এটা হয় না।’ জানালেন কারো ফরমায়েশ মেনে লিখতে তাঁর কোনোকালেই ভালো লাগতো না। যা লিখেছেন স্বেচ্ছায়। নিজের তাড়না থেকে। বললেন, ‘আমি জীবনে অনেক লিখেছি বটে। কিন্তু কারো কথা শুনে আমার লিখতে ভালো লাগতো না। ফরমায়েশি লেখা আমাকে দিয়ে হয়নি। আমার যেটা মন চেয়েছে লিখেছি। বলে কয়ে লেখানো আমার পছন্দ না।’

কথায় কথায় জানালেন নিজের পছন্দের কিছু কথা। বুদ্ধদেব বসুর ‘তিথিডোর’ তাঁর খুব প্রিয়। অনেকবার পড়েছেন। যে ফুলে গন্ধ আছে সেই ফুলই তার ভালো লাগে। একটা সময় ভ্রমণ করতে ভালো লাগতো। এখন আড্ডা দিতে ভালো লাগে। এখন ভ্রমণ করতে কষ্ট হয়। বয়সের কারণে পারেন না। ছোটবেলা থেকেই গান খুব পছন্দ করতেন। বললেন সে কথাও। ‘গান শুনতে আমার ভালো লাগে। আমি গানের খুব ভালো শ্রোতা। গান মানুষের মনকে পরিশীলিত করে। আবার এমন অনেকে আছে গান যাদের টানে না। আমার বন্ধু-বান্ধবের মধ্যেই আছে।’

সাহিত্যের নানা দিক বলতে গিয়ে বললেন, জনপ্রিয় সাহিত্য ও মূলধারার সাহিত্য বলতে আলাদা কিছু নেই। সবই সাহিত্য। পাঠক কখন কোনটাকে পছন্দ করবে, এটা পাঠকের বিষয়। পাঠকেরও তো লেখাপড়া করে তৈরি হওয়ার বিষয় থাকে। সেই রুচিশীল পাঠকেরও প্রয়োজন আছে। সব বই সব সময় জনপ্রিয় হয় না। যাযাবরের ‘দৃষ্টিপাত’ বইটি একসময় খুবই জনপ্রিয় ছিল। এখনো জনপ্রিয়। এখনকার জনপ্রিয় ধারার লেখার সঙ্গে তো তার খুব মিল নেই।’

নিজের লেখালেখি প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমি গদ্য ভালো লিখি জানি। গল্প লেখার চেষ্টাও করেছি। তবে অতটা হয়ে উঠেছে বলে মনে হয় না। ঘটনার পর ঘটনা সাজাতে পারি না। নিজের লেখা নিয়ে আমার কোনো দুর্বলতাও নেই। আমার লেখা না পড়লে কারো জীবন থেমে থাকবে, তা নয়।’ একটা আক্ষেপের কথাও বললেন খ্যাতিমান অনুবাদক হায়াৎ মামুদ। ‘দেশে খুব বেশি ভালো অনুবাদ হচ্ছে না। এখন অনেকেই লিখছেন। লেখার পাশাপাশি অনুবাদ করছেন। কিন্তু বিশে^র অন্যান্য দেশে লেখকদের অনেকে শুধু অনুবাদই করেন। তাদের কাজই অনুবাদ করা। আমাদের এখানে শুধু অনুবাদ করেন এমন লোকের সংখ্যা কম। বিশ^সাহিত্যের অনেক কিছু আমাদের অজানা থাকছে। অনুবাদ হচ্ছে না বলে। এটিতে আরও জোর দেওয়া প্রয়োজন।’

কথার ফাঁকে বাড়ির কাজের সহকারী এসে বলে গেলেন, ‘স্যার, উপরে ডাকছেন আপনাকে। গোসল করতে হবে।’ বললাম, ‘আপনার এখন ওঠা প্রয়োজন বোধহয়। ২টা পার হয়েছে । দুপুরের খাবার খাবেন।’

লেখক এবার স্বভাবসুলভ হেসে বললেন, ‘আমাদের বাড়িতে ৩টার আগে খাবার হয় না। দেরি হয়নি।’

আমি আর সময় নিতে চাইলাম না। দীর্ঘ সময় কথা বলতে গিয়ে লেখককেও বেশ ক্লান্ত মনে হচ্ছিল। সোফায় প্রায় শুয়ে পড়ে চোখবুজে রইলেন। ফ্যাকাশে ঠোঁট দুটো কিঞ্চিৎ নেড়ে উঠল। বললেন, ‘নিজেকে নিয়ে আমার কোনো দুঃখ নেই। ভালো হোক খারাপ হোক, যা চেয়েছি তাই হয়েছে।’ আমি খানিকক্ষণ স্থির হয়ে বসে রইলাম। তারপর বিদায় চাইতে চোখ মেলে তাকালেন। বললেন, ‘যাবে?’ গা টেনে উঠে বসলেন। আমি বললাম, ‘একটা ছবি তোলার ইচ্ছে হচ্ছে। যদি অনুমতি দেন তো।’

বললেন, ‘ছবি নেবে? পোশাকের যা অবস্থা। একেবারে কেবলাকান্ত লাগছে। কেবলাকান্তই তো। হা-হা-হা। নাও ছবি নাও।’ সদর দরজায় পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এলেন। সিঁড়ির ধাপ ভেঙে দাঁড়িয়ে পড়লেন বাগানের সামনে। অপলক তাকিয়ে রইলেন নয়নতারায়। আমি নিঃশব্দে গেটের দিকে পা বাড়ালাম। তিনি পেছন থেকে বললেন, ‘আবার এসো।’

সংবাদটি শেয়ার করুন

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :