হলমার্ক চালু করে পাওনা আদায়ের চিন্তা

রহমান আজিজ
| আপডেট : ০৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০৯:৪৮ | প্রকাশিত : ০৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০৮:২৫
ফাইল ছবি

প্রায় সাত বছর বন্ধ থাকা হলমার্ক গ্রুপ আবার চালু করে আয়ের টাকায় খেলাপি ঋণ আদায়ের চিন্তা করা হচ্ছে। মামলা এবং হলমার্কের প্রধানকে আটক করেও ঋণ আদায় করতে না পারার পর এই কৌশল নেয়া হচ্ছে।

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামালকে হলমার্কের কারাবন্দি ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর আহমেদ এ বিষয়ে একটি চিঠি দেন। আর এরপর অর্থমন্ত্রণালয় থেকে সোনালী ব্যাংকের কাছে মতামত চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়। সোনালী ব্যাংকও ইতিবাচক মতামত দিয়েছে এ বিষয়ে। এখন অর্থ, আইন ও ভূমি মন্ত্রণালয়, দুর্নীতি দমন কমিশন এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বসে এই বিষয়টি চূড়ান্ত করবে সোনালী ব্যাংক।

একাধিক বরেণ্য অর্থনীতিবিদ এবং পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন। তারা বলছেন, কারখানা বন্ধ রেখে কোনো লাভ হয়নি। সেটি চালু রাখলে লাভের অর্থ ব্যাংক নিয়ে নিতে পারে। আবার এতে বিপুলসংখ্যক মানুষের চাকরিও নিশ্চিত হবে।

তবে এ ক্ষেত্রে কারখানার নিয়ন্ত্রণ হলমার্কের বদলে সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত লোকদের হাতে থাকা এবং হলমার্ক কর্তৃপক্ষকে নানা শর্ত দিয়ে নিয়মের মধ্যে রাখার পরামর্শও এসেছে।

মন্ত্রণালয়ে পাঠানো সোনালী ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১২ সালের ৩১ মে পর্যন্ত গ্রুপটি সোনালী ব্যাংকের তখনকার শেরাটন শাখা থেকে জালিয়াতি করে দুই হাজার ৯৬৪ কোটি ৮১ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় এ পর্যন্ত মোট ৪৫৬ কোটি ৬১ লাখ টাকা আদায় করা সম্ভব হয়েছে। গত ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত হলমার্ক গ্রুপের কাছে সোনালী ব্যাংকের পাওনা ২ হাজার ৫১৩ কোটি টাকা। অবলোপন থাকায় এসব অর্থের সঙ্গে কোনো সুদ যোগ হচ্ছে না।

হলমার্ক গ্রুপ সোনালী ব্যাংকের কাছে যে সম্পত্তি বন্ধক রেখেছে, তার বাজারমূল্য ৪৭২ কোটি টাকারও কম। তাছাড়া হলমার্ক গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বন্ধকি সম্পত্তি চারবার নিলামে তোলার বিজ্ঞাপন দিয়েও কোনো ক্রেতা পাওয়া যায়নি।

২০১২ সালে হলমার্কের ঋণ জালিয়াতির খবর প্রথম প্রকাশিত হয়। ওই বছরের ৪ অক্টোবর রমনা থানায় মামলা করে দুদক। মামলায় হলমার্কের চেয়ারম্যান জেসমিন ইসলামসহ বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর তদন্ত শেষে ২০১৩ সালের ৭ অক্টোবর ১১ মামলায় চেয়ারম্যান জেসমিন ইসলাম, ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর মাহমুদ, তার ভায়রা তুষার আহমেদসহ ২৬ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র আদালতে জমা দেয়া হয়। পরে ঢাকার জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ আদালত ২০১৬ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি ও ২৭ মার্চ আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে। মামলাগুলো বিচারের জন্য ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-১-এ বদলি করা হয়।

আসামিদের মধ্যে কারাগারে আছেন হলমার্কের ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ আটজন। অন্যরা পলাতক রয়েছেন। তানভীর মাহমুদ কাশিমপুর কারাগারে আছে।

চলতি বছরের ১৫ জানুয়ারি অর্থমন্ত্রীর কাছে হলমার্ক গ্রুপ চালু এবং তার স্ত্রীকে মুক্তির দাবি জানিয়ে সমোঝতার চিঠি পাঠান তানভীর মাহমুদ। তাকে এবং স্ত্রীকে জামিনে মুক্তি দেওয়া হলে কারখানা চালু করে প্রথম বছর ১২ কোটি, দ্বিতীয় বছর ২৪ কোটি ও তৃতীয় বছর থেকে ১০০ কোটি টাকা করে ব্যাংকের দায় পরিশোধের কথা বলেন তিনি।

জানুয়ারিতে তানভীর মাহমুদের কাছ থেকে আবেদন পাওয়ার পর গত ৪ ফেব্রুয়ারি সোনালী ব্যাংককে চিঠি দেয় আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। তাতে হলমার্ক গ্রুপের ঋণ কেলেঙ্কারির সর্বশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদন সাত দিনের মধ্যে জমা দিতে নির্দেশ দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়।

সোনালী ব্যাংকের সিইও ও এমডি ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ (বর্তমানে রূপালী ব্যাংকের এমডি) স্বাক্ষরিত একটি চিঠিসহ প্রতিবেদনটি গত ৭ মার্চ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। প্রতিবেদনটি পর্যালোচনায় দেখা যায়, তাতে হলমার্কের সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তিতে অর্থ আদায়ে মত দিয়েছে সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ, সংসদীয় স্থায়ী কমিটি।

এর আগে জাতীয় সংসদের অনুমিত হিসাব সম্পর্কিত সাব-কমিটিও আদালতের বাইরে সমঝোতার ভিত্তিতে অর্থ আদায়ের পক্ষে সুপারিশ করে। তার ভিত্তিতে গত বছর ২৯ অক্টোবর সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভায় আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা করে হলমার্ক গ্রুপের কাছ থেকে ব্যাংকের বিপুল পরিমাণ পাওনা আদালতের বাইরে সমঝোতার মাধ্যমে আদায়ের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দপ্তরগুলোকে নিয়ে জরুরি সভা আয়োজনের অনুরোধ করে গত ২৮ নভেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয় সোনালী ব্যাংক।

পরে সোনালী ব্যাংকের প্রতিবেদনে কারখানা চালু রেখে অর্থ আদায়ের পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে বলা হয়, হলমার্ক ও অন্যান্য পাঁচটি গ্রুপ ও প্রতিষ্ঠানের কারখানায় প্রায় ২৮১.৭১ কোটি টাকা মূল্যের যন্ত্রপাতি আছে। ছয় বছরেরও বেশিকাল ধরে অব্যবহৃত থাকায় এগুলো কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে।

এর আগে ২০১৭ সালের ১৭ মে সোনালী ব্যাংকের চেয়ারম্যানের কাছে আবেদন করেছিলেন জেসমিন ইসলাম। এ তথ্য জানিয়ে সোনালী ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, জামিনে মুক্তি দিয়ে কারখানা চালুর সুযোগ দিলে বিভিন্ন ব্যাংকে আটকে থাকা ৮৪ কোটি টাকা তুলে সোনালী ব্যাংককে দেবে। জমি বিক্রি করে ১০০ কোটি ও বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কাছে পাওনা ২০০ কোটি টাকা আদায় করে সোনালী ব্যাংকের দায় পরিশোধ করা হবে। কারখানাগুলো চালুর পর প্রতিবছর ২০০ কোটি টাকা করে পরিশোধ করবে। জামিন পেলে হলমার্কের আরও সাত হাজার ৬৫৬ শতাংশ সম্পত্তি বন্ধক রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে, যার মূল্য প্রায় ৭৮০ কোটি টাকা।

এ বিষয়ে কথা বলতে গতকাল সোনালী ব্যাংকের সাবেক সিইও ও এমডি মো. ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ এবং বর্তমান এমডি আতাউর রহমান প্রধানকে মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল ও এসএমএস পাঠানো হলেও সাড়া দেননি।

অর্থমন্ত্রী যা বলছেন

হলমার্কের এই আবেদনের বিষয়ে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, ‘সোনালী ব্যাংক ঋণ দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত হলমার্ক গ্রুপ আবার ব্যবসায় ফিরবে। হলমার্ক টাকা দেবে। আমি নতুন করে ব্যবসায়ী সৃষ্টি করতে পারব না। যারা আছে, তাদের দিয়েই ব্যবসা করতে হবে। আমি চাই, আমার টাকাটা দিয়ে দিক, সুন্দরভাবে জীবনযাপন করুক।’

হলমার্ক নাকি চিঠি দিয়ে উল্টো সরকারের কাছে টাকা চেয়েছে? এমন প্রশ্নে মন্ত্রী বলেন, ‘ব্যবসা তারা করবে, তার আগে আমাদের টাকা তাদের শোধ করতে হবে। তাদের সব সক্ষমতা আছে। ব্যবসায়ীরা কখনো শেষ হয়ে যায় না। ব্যবসায়ীরা জানে সব সময় একটা বর্ষাকাল আছে, সেটা মাথায় রেখেই কাজ করে।’

সাভারে হলমার্কের কারখানা সম্পূর্ণ অচল হয়ে গেছে-সাংবাদিকরা এ প্রসঙ্গ তুললে মন্ত্রী বলেন, ‘ফ্যাক্টরি অচল হলে তার নিচে যে গোল্ড মাইন আছে সেটা কি করবেন? নতুন অ্যারেঞ্জমেন্ট যখন হবে, তখন জানতে পারবেন।’

এটিই সঠিক সিদ্ধান্ত

হলমার্ক চালু করে অর্থ আদায়ের চিন্তাটাকেই সঠিক বলে মনে করেন একাধিক অর্থনীতিবিদ এবং পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইর সভাপতি রুবানা হক। তারা বলেন, ছয় বছর কারাখানা চালু রেখে মুনাফার টাকা থেকে সোনালী ব্যাংক অর্থ আদায় করতে পারত। সেটা না করে যে প্রক্রিয়ায় চেষ্টা করা হয়েছে, তাতে কোনো অর্থ আসেনি, উল্টো বিপুল সংখ্যক মানুষের চাকরি গেছে। কারণ, হলমার্কের যে কারখাটি বন্ধ করা হয়েছে, সেটি ছিল বিশ্বমানের এবং সেখানে সরাসরি পাঁচ হাজারেরও বেশি মানুষ চাকরি করত।

বিজিএমইএ সভাপতি ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘হকমার্কের বিষয়ে সরকারের এ সিদ্ধান্ত ইতিবাচক বিষয়। দেশের স্বার্থে চালু করা দরকার। তবে এর একটি ক্ষতিকারক দিকও আছে, এসব প্রতিষ্ঠানের কারণে বিদেশি ক্রেতারা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। এখানে সুনাম নষ্ট হচ্ছে। এ ধরনের ঘটনা যেন পুরাবৃত্তি না ঘটে।’

‘নন-পারপামেন্স প্রতিষ্ঠান এখাতে থাকুক আমি চায় না। সরকারের উঠিত ছোট-ছোট প্রতিষ্ঠানকে তদারকি করে এগিয়ে নেয়া নইলে বন্ধ করে দেওয়া।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ফরাসউদ্দীন ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘এ উদ্যোগ আরো আগে নেয়া যেত। তবে অপরাধীদের কোনো শর্ত মানা যাবে না। সর্বোচ্চ ৫-৭ বছরের মধ্যে কীভাবে সব টাকা আদায় করা যাবে সেটি নিশ্চিত হয়ে প্রতিষ্ঠানটি চালুর সুযোগ দেয়া যেতে পারে।’

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আরেক সাবেক গর্ভনর সালেহ উদ্দীন আহমেদও একই কথা বলেছেন। তিনি বলেন, ‘এটি অবশ্যই ভালো উদ্যোগ। তবে সরকারের প্রতিনিধিকে প্রতিষ্ঠানটি চালুর দায়িত্ব দিতে হবে। হলমার্কের কোন পরিচালককে প্রতিষ্ঠানটির নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব দেয়া যাবে না।’

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিশেষ প্রতিবেদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন এর সর্বশেষ

কোন দিকে মোড় নিচ্ছে ইরান-ইসরায়েল সংকট

ছাদ থেকে পড়ে ডিবি কর্মকর্তার গৃহকর্মীর মৃত্যু: প্রতিবেদনে আদালতকে যা জানাল পুলিশ

উইমেন্স ওয়ার্ল্ড: স্পর্শকাতর ভিডিও পর্নোগ্রাফিতে গেছে কি না খুঁজছে পুলিশ

জাবির হলে স্বামীকে বেঁধে স্ত্রীকে জঙ্গলে ধর্ষণ, কোথায় আটকে আছে তদন্ত?

নাথান বমের স্ত্রী কোথায়

চালের বস্তায় জাত-দাম লিখতে গড়িমসি

গুলিস্তান আন্ডারপাসে অপরিকল্পিত পাতাল মার্কেট অতি অগ্নিঝুঁকিতে 

সিদ্ধেশ্বরীতে ব্যাংক কর্মকর্তার মৃত্যু: তিন মাস পেরিয়ে গেলেও অন্ধকারে পুলিশ

রং মাখানো তুলি কাগজ ছুঁলেই হয়ে উঠছে একেকটা তিমিরবিনাশি গল্প

ঈদের আনন্দ ছোঁয়নি তাদের, নেই বাড়ি ফেরার তাড়া

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :