সেই দিনমজুরকে পেলে আবার দোয়া চাইতাম

ডা. আব্দুর নূর তুষার
 | প্রকাশিত : ০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০৯:০৮

মেডিকেল কলেজে পড়বার সময় আমার মা আমাকে সপ্তাহে ১০০ টাকা দিতেন যাতায়াত ভাতা, আর ৫০০ টাকা দিতেন মাসে অন্যান্য খরচের জন্য। সব মিলিয়ে ৯০০ টাকা। আমার সারা মাসে যাতায়াতের টাকা লাগত ৩০০ ।

সরাসরি মিনিবাসে চানখারপুল বা বখশিবাজার যেতে আসতে মীরপুর থেকে দিনে ১০ টাকা। মুড়ির টিনে (বড় বাস) চড়লে ছয় টাকা, ছাত্র আইডি কার্ড দেখালে হাফ ভাড়া তিন টাকা। তাই প্রতিবার মাসের শেষ সপ্তাহের শুরুতে ১০০ টাকা পেলেই আমি চলে যেতাম নিউমার্কেট। হেঁটে যেতাম যাতে পয়সা বাঁচে আর জমানো পুরো টাকা দিয়ে বই কিনতাম।

একবার সেরকম বই কিনে পকেটে আছে ১২ টাকা। রিকশা দিয়ে বাড়ি ফেরার সিদ্ধান্ত নিলাম। তখন দ্বিতীয় বর্ষে পড়ি। রিকশাওয়ালা অতিরিক্ত ভাড়া চাইতে থাকায় আমি হেঁটে কলাবাগান চলে আসলাম। কলাবাগান থেকে আমার বাসার রিকশা ভাড়া ছিল আট টাকা। কেন যেন কোন রিকশা সেদিন আর যেতে রাজি হয় না।

আমি রাগ করে হেঁটে চলে এলাম আসাদগেট। এবার একজন রাজি হলো যেতে কিন্তু ভাড়া তখনো বেশি। পকেটের ১২ টাকাই সে চায়, আমি সিদ্ধান্ত নিলাম হেঁটেই বাড়ি ফিরব। ঠিক কলেজ গেট আর শ্যামলীর সংযোগস্থলে আসতেই দেখি রাস্তায় দাঁড়িয়ে এক দিনমজুর কাঁদছেন আর বলছেন, “আল্লাহ তোমার দুনিয়ায় কি কেউ নাই আমাকে একবেলা ভাত খাওয়ায়।”

আমি তার সাথে কথা বলে মনে হলো তিনি সত্যি কথা বলছেন। সকালে এসেছিলেন তুরাগ নদীর ওপার থেকে বসিলা হয়ে। দেরি হয়ে যাওয়ায় কাজ পাননি। কাঁদতে কাঁদতে বললেন “আজকে না খেলে তো কালকেও কাজ করতে পারব না।”

উল্টোদিকের হোটেলে তাকে নিয়ে যেতে তিনি বললেন, কৈ মাছ দিয়ে ভাত খাবেন। হোটেলওয়ালা বলল, ভাত আর কৈ মাছ ১২ টাকা দাম। পকেটের সব টাকা দিয়ে তাকে ভাত আর কৈ মাছ খাওয়ালাম। তিনি হাত তুলে আমাকে দোয়া করলেন, আমার স্পষ্ট মনে আছে। “আল্লাহ, আমার ভাইটার জীবনে যেন কোনদিন ভাতের অভাব না হয়।”

আমি বাকি রাস্তা হেঁটে মিরপুরে আমার বাড়িতে ফিরলাম।

আমার পকেটে বহুদিন টাকা ফুরিয়ে গেছে। (যখন এভাবে বই বা খেলনা কিনেছি) এমনকি বিদেশেও একবার এমন হয়েছিল। পকেটে টাকা নাই। থাকতে হবে আরও দুই দিন। খিদে লাগার সাথে সাথে কেউ না কেউ আমাকে খাবার সেঁধেছে। আমার জীবনে এখনো ভাতের অভাব হয় নাই।

সেদিন কেন এতটা পথ হেঁটেছিলাম? এখন বুঝি আমি স্বেচ্ছায় হাঁটি নাই। সেই দিনমজুরের দোয়া কবুল হয়েছিল। আমি হেঁটেছিলাম। কারণ আল্লাহ সেদিন আমার মাধ্যমে তাকে ভাত পাঠিয়েছিলেন। তাকে আরেকবার খুঁজে পেলে আমার জন্য দোয়া করতে বলতাম।

বলতাম আল্লাহকে বলেন ভাই, “আমার ভাইটা যেন প্রিয় মানুষের ভালবাসার মধ্যে মরতে পারে।”

লেখক: চিকিৎসক ও উপস্থাপক

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফেসবুক কর্নার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :